একাঙ্ক নাটক কাকে বলে? একাঙ্ক নাটকের রূপ, রীতি ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করে একটি বাংলা একাঙ্ক নাটক সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

নাট্য সমালোচক অজিত কুমার ঘোষ বলেছেন : “ঘটনার অবিচ্ছিন্নতা ভাবগত অখণ্ডতা, ঘনীভূত রসময়তা, এগুলি একাঙ্ক নাটকের অপরিহার্য লক্ষণ।” আবার সমালোচক সাধনকুমার ভট্টাচার্য বলেছেন : “দেশকালের অবিচ্ছেদ্য বা ঐকান্তিক এককত্বকে আমরা একাধিকবার অপরিহার্য লক্ষণ বলেই স্বীকার করি। স্থান ঐক্য, কাল ঐক্য এবং ঘটনা ঐক্যের আদর্শ সমন্বয়ের মধ্যেই একাঙ্কিকার বিশেষত্ব নিহিত রয়েছে।” অর্থাৎ একাঙ্ক নাটক বলতে সাধারণভাবে বোঝায় একটি দৃশ্যে সীমিত সময়ে এক ঘণ্টার মধ্যে অভিনয়যোগ্য এক ধরনের নাটক। সুতরাং একাঙ্ক নাটকের একটি দৃশ্যে অভিনয় যোগ্যতার কথা স্মরণ রেখে একটা নিখুঁত সংজ্ঞা এমনভাবে নিরূপণ করা যেতে পারে।


“একাঙ্ক নাটক হল এক দৃশ্যে অভিনয়যোগ্য দ্রুত সংঘটিত, বাহুল্য বর্জিত এমন এক ধরনের সংবদ্ধ নাটক যার প্রধান বৈশিষ্ট্য তীব্র এক মুখীনতা, অথচ নাটকের মৌল লক্ষণ অধিকৃত রেখে যাতে প্রচুর স্বাধীনতা গ্রহণের অবকাশ রয়েছে।”


একাঙ্ক নাটকের লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য :

একাঙ্ক নাটকের বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করতে গিয়ে জন্ হ্যাম্পডেন বলেছেন: “An one act play deals with a single dominant dramatic situation and aims at producing a single effect, since the play is to be acted in a short space of time the greatest artistic unity and economy are essential to success."


একাঙ্ক নাটকের এই সকল লক্ষণ নির্দেশ এবং বাংলা একাঙ্ক নাটক নিয়ে যাঁরা আলোচনা করেছেন তাঁদের কথা স্মরণ রেখে একাঙ্ক নাটকের প্রধান লক্ষণগুলি এমনভাবে নির্দেশ করা যেতে পারে- (ক) তীব্র একমুখীনতা (খ) সংঘবদ্ধ ও বাহুল্যবজর্ন (গ) ত্রিবিধ ঐক্যের আদর্শ সমন্বয় (ঘ) ঘটনার দ্রুতময়তা (ঙ) নাটকের মৌলিক সত্য অক্ষুণ্ণ রেখে প্রচুর স্বাধীনতা।


একাঙ্ক নাটক এবং ছোটোগল্প মোটামুটি একই প্রেরণা ও তাড়নায় একই সাহিত্য প্রযত্নে ও সচেতনায় সৃষ্ট। জীবনের কোনো তীব্র অভিজ্ঞতা বা গাঢ় অনুভূতি এ দুয়েরই জন্মদাতা। একমুখীনতা দুটি সাহিত্য প্রকরণের মূল কথা। ছোটোগল্পের মতোই একাঙ্ক নাটকের দৃষ্টি থাকে একটি বিশেষ চরিত্রের ওপর, আখ্যানের বিশেষ এক চরম মহূর্তের ওপর, সত্য আবিষ্কারের বিশেষ ভঙ্গির ওপর, বা কোনো একক উদ্দেশ্যের ওপর। সবদ্ধতা নাটকের অন্যতম গুণ, কারণ তার আয়তন সীমিত। একাঙ্ক নাটকের ক্ষেত্রে তা লঙ্ঘন করা অমার্জনীয় শিল্পস্খলন। এর ক্ষেত্রে ত্রিবিধ ঐক্যও আবশ্যক। আধুনিক জীবনে ছোটোগল্পের মতোই একাঙ্ক নাটকের আবেদন তীব্র। এরফলে একাঙ্কিকার জনপ্রিয়তা সুপ্রচুর। বাংলা সাহিত্যে এই একাঙ্ক নাটকের উদ্ভবের জন্য আমরা ইউরোপীয় ও ইংরেজি সাহিত্যের কাছে ঋণী। ইংরাজি নাটক ও নাট্য আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন জন মিলিংটন সিজে ও করি ইয়েট, তাঁদের রচিত বিভিন্ন নাটকই পরবর্তীকালে বাংলা নাট্যকারদের প্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায়।


বাংলা সাহিত্যে প্রথম একাঙ্ক নাটক কী? এ সম্পর্কে, ড. সেন বলেছেন : “অজ্ঞাত নাট্যকার রচিত 'বল্লালীখাত নাটক (১৬৬৮) প্রথম বাংলা একাঙ্ক নাটক ' তবে সাহিত্য সন্দর্শন' গ্রন্থের প্রণেতা শ্রীশচন্দ্র দাশ মহাশয় গিরিশচন্দ্রের—‘বৃষকেতু’ ও ‘প্রহ্লাদচরিত্র’ এ দুটি নাটকের নাম করেছেন। এই মত সমর্থন করেছেন ড. সরোজমোহন মিত্র। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর ‘নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস' গ্রন্থে গিরিশচন্দ্রকেই একাঙ্ক নাটকের পথিকৃৎ বলেছেন। অন্যান্য নাট্যকারদের মধ্যে পথিকৃতের দাবীদার হলেন— জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (কিঞ্চিৎ জলযোগ) এবং অমৃতলাল বসু (চাটুজ্যে বাঁড়ুজ্যে)। এছাড়া আছেন রাজকৃষ্ণ রায় (ডাক্তারবাবু) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (বিনিপয়সার ভোজ), প্রমুখ নাট্যকার। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে, সার্থক বাংলা একাঙ্ক নাটকের প্রথম পথিকৃৎ মন্মথ রায়। মন্মথ রায়ের প্রথম একাঙ্ক নাটক ‘মুক্তির ডাক'। এরপর বহু একাঙ্ক নাটকই তিনি লিখেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—চাঁদ সদাগর, দেবাসুর, কারাগার, সাবিত্রী, মাতৃমূর্তি, খনা, বিদ্যুৎপর্ণা, রাজনটী, রূপকথা প্রভৃতি। মন্মথ রায় ছাড়া বহু নাট্যকারই বাংলা একাঙ্ক নাটক রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন প্রবোধ মজুমদার (শুভযাত্রা) বনফুল (শিবকাবাব), শিবরাম চক্রবর্তী (চাকার তলে), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (নতুন তারা) শচীন সেনগুপ্ত (ঝড়ের রাতে), দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (দাম্পত্য কলহেচৈব), বিধায়ক ভট্টাচার্য (তাহার নামটি রঞ্জনা) প্রভৃতি।


একটি বাংলা একাঙ্ক নাটক :

‘রাজপুরী’ মন্মথ রায়ের অন্যতম বিখ্যাত একাঙ্ক নাটক। রাজপুরী নাটকের কাহিনি মন্মথ রায় গ্রহণ করেছেন বৌদ্ধ আখ্যান 'ভদ্রশাল জাতক' থেকে। এর কাহিনি হল “বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছে সম্মান ও প্রতিষ্ঠা লাভ করার জন্য কোশলরাজ প্রসেনজিৎ বিবাহ করেছিলেন শাক্যদুহিতা বাসব ক্ষত্রিয়াকে। নাটক শুরু হয় এমন একটি দিনে যেদিন রাজপুরীতে বিরাট উৎসব, একদিকে চৈত্রমাসের বসত্তোৎসব পালন—তার ওপর আবার মাতুলালয় থেকে সেদিনই ফিরছেন ষোলো বছরের যুবরাজ বিরূধক, তাকে নিয়ে আসছেন বাসব ক্ষত্রিয়ার পূর্বপ্রণয়ী সুগায়ক কবিশেখর। উৎসব উপলক্ষ্যে শাস্তার পায়ে আবির কুঙ্কুম ভুঁইয়ে এনেছেন রাজা, রানিকে বলেন প্রজাদের মঙ্গলের জন্য তাদের সেই পবিত্র ধূলি বিতরণ করতে। রানি কিন্তু কৌশলে সে অনুরোধ এড়িয়ে যান। মান অভিমানের পর রানি রাজাকে বলেন—তিনি জানেন রাজা তাঁকে ভালোবাসেন না—বিবাহ করেছেন শুধু বংশমর্যাদা বৃদ্ধির জন্য। রাজা একথা স্বীকার করলে তিনি ভালোবাসার জন্য আর্তি জানান।


এরপর সভাগৃহে কবিশেখরের গান শুরু হবে। রাজা সেখানে যেতে রানিকে অনুরোধ জানান। রানি এ প্রস্তাবও এড়িয়ে যান বিরূধকের সঙ্গে দেখা করার অজুহাতে। যেতে হয় রাজাকে একা। কবিশেখর নিজেই এসে দেখা করেন রানির সঙ্গে। গুপ্ত বিদ্রোহের খবরে রাজা চলে গেছেন দুর্গে রাতে ফিরবেন না, রানি খুশি হলেন কবি শেখরের সঙ্গ পেয়ে। ক্ষণিক দুর্বলতায় তিনি কবি শেখরের সঙ্গে পালিয়ে যেতে চাইলে কবিশেখর রুষ্ট হয়ে রানিকে ছেড়ে চলে যান। ক্রুদ্ধ রানি মূক ক্রীতদাসকে নির্দেশ দেন কবিশেখরের চোখ উপড়ে আনতে। ক্রীতদাস ভুল বোঝে, সে উপড়ে নিতে যায় রাজশেখরের চোখ। জীবন বিপন্ন করে তাকে বাঁচান কবিশেখর এবং রানির আদেশ বুঝতে পেরে নিজের চোখ দুটি উপড়ে উপহার পাঠান রানিকে। যন্ত্রণাদগ্ধ রানি রাজপুরী ত্যাগ করে চলে যান বুদ্ধের আশ্রমে।


রাজা ফিরে এলে বিরূধক ভয়ংকর দুঃসংবাদ দেয়। সে জানায় রানিয় আসল পরিচয়। রানি মোটেই শাক্যবংশের মেয়ে নয়, রাজার এক নর্তকীর কন্যা। প্রসেনজিৎকে ঠকাবার জন্য শাক্যরা এই কৌশল করেছে। বিবৃধক শাক্যদের রক্তে বন্যা বইয়ে দিতে চলেছে, চেয়েছে শাস্তার ছিন্ন মুন্ড। রাজা ক্রুদ্ধ ও মর্মাহত হয়ে রানিকে নির্বাসন দণ্ড দেন। কিন্তু শোনেন রানি স্বেচ্ছায় নির্বাসনে গেছেন। পিতা ও পুত্র দুজনেই ব্যথিত। এমন সময় প্রতিহারি স্বর্ণপাত্রে এক ছিন্নমুণ্ড নিয়ে এসে হাজির। আবরণ উন্মোচন করতেই দেখা গেল তা রানির। নাটক এখানে শেষ হয়েছে।


এই নাটকটি সার্থক একাঙ্কিকা। কারণ প্রথমত প্রায় একঘণ্টা সময়ে অভিনয়যোগ্য এই একাঙ্ক নাটকটিতে যা শ্রোতাদের মুগ্ধ করবে তা এর উদ্দেশ্যের একমুখীনতা।


দ্বিতীয়ত অনেকগুলি কাহিনির স্রোেত একটি দৃশ্যে সংহত হওয়ায় নাটকটির সংবদ্ধতা ও বাহুল্য বর্জন-ক্ষমতা যথোপযুক্ত হয়েছে রাজপুরীর চৌহদ্দির মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই নাটকের সমগ্র ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সমাপ্ত হয়েছে। সংলাপে ও আচরণে কোথাও নাট্যকার একাগ্রতা নষ্ট হতে দেননি।


তৃতীয়ত নাটকটি অত্যন্ত গতিশীল। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শক কোথাও ক্লান্তি অনুভবের বা একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হবার সুযোগ পান না।


চতুর্থত নাটকটির শুরু এবং শেষ পর্যন্ত মৌলিক সত্য কোথাও এতটুকু ক্ষুণ্ন হয়নি। একটা বিশেষ লক্ষ্য এর মধ্যে প্রকটিত।


এইসব কারণেই সার্থক একাঙ্ক নাটকের লক্ষণ বিচারে মন্মথ রায়ের 'রাজপুরী'-কে একটি রসোত্তীর্ণ ও শিল্পোত্তীর্ণ একাঙ্ক নাটক হিসেবে স্বীকৃত জানানো যায়।