নীলকণ্ঠ চরিত্রের সার্থকতা লেখো।

নীলকণ্ঠ টাইপ-চরিত্র হলেও বিশিষ্ট, ফ্ল্যাট-চরিত্র নয়। এছাড়া জমিদারে কৃত্য দুষ্কর্মগুলি এ-গল্পে তার দ্বারাই সমাধা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিপুণ কলমের একটিমাত্র আঁচড়ে নীলকণ্ঠের ভিতর-বাহির আমাদের সম্মুখে তুলে ধরেছেন:- ‘...নীলকণ্ঠের দেহে তাহার অস্থিকঙ্কালের উপর কোনোপ্রকার আব্বু নাই বলিলেই হয়। বাবুর ঐশ্বর্য ভাণ্ডারের দ্বারে সে মূর্তিমান দুর্ভিক্ষের মতো পাহারা দেয়। বিষয়টা মনোহরলালের কিন্তু তাহার মমতাটা সম্পূর্ণ নীলকণ্ঠের।'


কবিস্বভাব রোমান্টিক প্রকৃতি খোলামেলা চরিত্রের বনোয়ারিলালের সঙ্গে তার বনিবনা হয় না এই কারণেই। বনোয়ারি বাপের কাছ থেকে স্ত্রীর একটা নতুন গয়না গড়াবার হুকুম আদায় করেছে, কিন্তু নিজের পছন্দমতো জিনিসটা ফরমাশ করবার ক্ষমতা নেই। কারণ—নীলকণ্ঠ। দুপক্ষের বিরোধ সামান্য পাঁচ-দশ টাকা নিয়ে। নীলকণ্ঠ যে পাকা বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন—তা জেনেও বনোয়ারি বুঝতে চায় না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : 'মনিবের ধন সম্বন্ধে নীলকণ্ঠের একটা কৃপণতার বায়ু আছে। মধুকৈবর্তের ঘটনায় বনোয়ারির সঙ্গে নীলকণ্ঠের রেষারেষি, যোঝায়ুঝি বেড়ে গেল। নীলকণ্ঠ বজ্জাত প্রজাকে শায়েস্তা না-করে ছাড়বেনা, বনোয়ারি তাকে সর্বপ্রকারে সাহায্য করবে। বনোয়ারি নিজের একটি বন্দুক ও হীরের আংটি বেচে টাকাপয়সা জোগাড় করে মধুর পক্ষে মামলা করল, নীলকণ্ঠকে জেলের ঘানি পর্যন্ত ঘোরাতে বাধ্য করল, কিন্তু তাকে দমাতে পারল না। সে শেষ পর্যন্ত জমিদার সরকারের অর্থ ব্যয় করে মধুকে সপরিবারে কাশীবাসী করে ছাড়ল, বড়োবাবুর মানসম্মান বাঁচাতেই সে এমন অনিয়মটিকে হজম করে নিতে বাধ্য হল, কিন্তু প্রকাশ্যে সে এ গুজব রটনা করতে ভুলল না যে— 'মধুকে তাহার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-সমেত অমাবস্যারাত্রে কালীর কাছে বলি দিয়া মৃতদেহগুলি ছালায় পুরিয়া মাঝ গঙ্গায় ডুবাইয়া দেওয়া হইয়াছে। অভীপ্সিত ফলও মিলল—'ভয়ে সকলের শরীর শিহরিয়া উঠিল এবং নীলকণ্ঠের প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধা পূর্বের চেয়ে অনেক পরিমাণে বাড়িয়া গেল?'


নীলকণ্ঠের প্রভুবংশবদতার চরম পরিচয় ফুটে উঠেছে কর্তা মনোহরলালের মৃত্যুর পর। মনোহরলাল সমস্ত বিষয়সম্পত্তি বংশীর নাবালক সন্তান হরিদাসকে উইল করে দিয়ে গেলেন। নীলকণ্ঠ তার যথাকর্তব্য করতে একতিল দেরি বা গাফিলতি করল না।


‘বনোয়ারি দেখিল, নীলকণ্ঠ অন্তঃপুরে আসিয়া ঘরে ঘরে সমস্ত জিনিসপত্রের লিস্ট করিতেছে এবং যেখানে যত সিন্দুক বাক্স আছে তাহাতে তালাচাবি লাগাইতেছে।


শুধু তাই নয়, বনোয়ারি তাকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে লাগল সে নম্র ভাবে বলেছে:- ‘বড়োবাবু, আমার তো কোনো দোষ নাই। কর্তার উইল অনুসারে আমাকে তো সমস্ত বুঝিয়া লইতে হইবে। আসবাবপত্র সমস্তই তো হরিদাসের।'


আপাতভাবে তার এই কথায় স্পর্ধা প্রকাশ পেয়েছে মনে হবে, কিন্তু এ তার অবিচল কর্তব্যপরায়ণতা। সে যে চোর তা কিন্তু গল্পে কোনো ঘটনাতেই প্রমাণ হয়নি। দলিলের কাগজপত্র হারিয়ে গেলে বনোয়ারি সন্দেহবশে তাকে দায়ী করলে সে একটি কথায় জবাব দিয়েছে—না। অর্থাৎ সে চুরি করেনি। চোর নয়।


জমিদারের সামান্য মাইনের কর্মচারী, অর্থের লোভ নেই, অথচ কর্তব্যকাজে অটল অচল এরকম চরিত্র রবীন্দ্রসাহিত্যে দ্বিতীয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। নীলকণ্ঠের চরিত্র-রচনায় রবীন্দ্রনাথ অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।