গদ্যের সুচনা ও বিকাশপর্ব : উইলিয়ম কেরী (১৭৬১ খ্রীঃ-১৮৩৪ খ্ৰীঃ)

উইলিয়াম কেরীর জন্ম ও কর্মজীবন :


১৭৬১ খ্রীস্টাব্দের ১১ই আগস্ট উইলিয়াম কেরীর জন্ম হয় ইংলন্ডের পলার্সপুরী গ্রামে। তাঁর পিতামহ পলাসপুরীর পাঠশালার শিক্ষক এবং গ্যারিশ ক্লার্ক ছিলেন। তিনি অল্প বয়সে মারা যান। তার ছিল দুই পুত্র এডমন্ড এবং হেনরী। হেনরী জাহাজের কাজ নিয়ে আমেরিকায় চলে যান। এডমন্ড পশমের কাপড় প্রস্তুত করার কাজে যুক্ত থেকে বিধবা মাকে সাহায্য করতেন। তার স্ত্রীর নাম ছিল এলিজাবেথ। এই এডমন্ড এবং এলিজাবেথের গৃহে কেরীর জন্ম হয়। তাঁর ‘উইলিয়াম' নাম রেখেছিলেন ঠাকুমা। “.. ঠাকুমাই তাহাকে উইলিয়াম নাম দান করেন। পিতামাতা উভয়ে বস্ত্র নির্মাণ এবং সংসারের অন্যান্য নানাবিধ কার্যে ব্যস্ত থাকিতেন, সুতরাং বালক উইলিয়ামের কৈশোরে। প্রায় সমস্ত শিক্ষাই ঠাকুমার কাছে হইয়াছিল”


১১ই নভেম্বর ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে কেরী প্রধানত ধর্মপ্রচারের জন্য বাঙলায় পদার্পণ করেন। দেশীয় ভাষায় বাইবেল রচনার জন্য তার ভাষা শিক্ষা প্রথমে জাহাজে টমাসের কাছে, তারপর এদেশে এসে রামরাম মুন্সীর কাছে। স্বভাবতই দেশীয় ভাষায় বাইবেল প্রচার ছিল এর মূলে নিহিত— "How long will it be till I shall know so much of the language of the country as to preach Christ crucified to them. But bless God. I make some progress (Carey's Journal)" ক্রমাগত দু'বছরের চেষ্টায় অবশেষে তা আয়ত্ত হয়। শুধু তাই নয়, ১৭৯৫ খ্রীস্টাব্দের মধ্যেই দেখা যায় তিনি বাংলায় বক্তৃতা দান, ব্যাকরণ ও অভিধান রচনা এবং বাইবেলের অনুবাদে নিযুক্ত হয়েছেন।


শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে কেরীর নিউ টেস্টামেন্টের বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়। তিনি শ্রীরামপুর কলেজে যোগদান করে অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত (১৮১৮-১৮৩১) হন। কেরীর প্রতি লর্ড ওয়েলেসলীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। তার নির্দেশে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রভোস্ট ডেভিড ব্রাউন এই কলেজের বাংলা বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করে চিঠি দেন। কিছুদিন চিন্তাভাবনা করার পর কেরী সম্মত হন। ১৮৩১ খ্রীস্টাব্দের ১লা মে তিনি নিযুক্ত হন। ৪ঠা মে (জন ক্লার্ক মার্শম্যানের মতে, ১২ই মে) থেকে তিনি কলেজে যোগদান করেন (দ্রষ্টব্য : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’, সজনীকান্ত দাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮৭)। শিক্ষক রূপে তার মাসিক বেতন হয় প্রথমে ৫০০ টাকা। পরে বাংলা ও সংস্কৃতের অধ্যাপক এবং মারাঠী ভাষার শিক্ষা হিসাবে ১০০০ টাকা পর্যন্ত বেতন পান। (দ্রষ্টব্য : “উন্মেষ যুগের বাংলা গদ্য”, “আধুনিক বাংলা সাহিত্য, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, বাংলা একাডেমী : ঢাকা তৃতীয় সংস্করণ, জুন ১৯৮২, পৃষ্ঠা ৫)। কেরীর কাজে সাহায্য করার জন্য আরও একাধিক লেখক-পণ্ডিত-মুন্সী নিয়োগ করা হয়, যেমন মাসিক ২০০ টাকা বেতনে প্রধান পণ্ডিতের পদে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, ১০০ টাকা বেতনে দ্বিতীয় পণ্ডিতের পদে রামনাথ বাচস্পতি, ৪০ টাকা বেতনে সহকারী পণ্ডিতের পদে শ্রীপতি রায়, আনন্দচন্দ্র শর্মা, রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়, কাশীনাথ, পদ্মলোচন চূড়ামণি ও রামরাম বসু প্রমুখ ব্যক্তি।


উইলিয়াম কেরীর গ্রন্থপ্রকাশে ভূমিকা:

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণের পর কেরী পাঠ্যপুস্তকের অভাব লক্ষ্য করেন। এই অভাব পূরণে তাঁর ভূমিকা হল


(ক) তিনি স্বয়ং পাঠ্যপুস্তক রচনার কাজে যুক্ত হয়ে তাঁর অধীনস্থ পণ্ডিতদের এই কাজে অনুপ্রাণিত করেন।


(খ) তাঁরই অনুরোধে কলেজ কর্তৃপক্ষ দেশীয় ভাষায় সাহিত্যরচনার জন্য ১৮০১ খ্রীস্টাব্দের ৬ই জুলাই লেখকদের নগদ পুরস্কার দানের প্রস্তাব করেন : "... Resolved that premiums shall be proposed to the learned natives for encouraging literary works in the Native Languages."


এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রামরাম বসু, রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়কে কলেজের পাঠ্যগ্রন্থ রচনার জন্য যথাক্রমে ৬০০ ও ১০০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়। কেরী লিখেছিলেন "...I have examined these work and thanks them to be worthy of the patro nage of the College, and recommend the writers as deserving some reward for their labours."

(গ) পুস্তক মুদ্রণের ব্যয়ভার বহনে সাহায্য করার জন্য কলেজ লাইব্রেরীতে অনেক খণ্ড বই কেনার ব্যবস্থা করা সম্ভবত কেরীর আবেদনেই করা হয়েছিল।


(ঘ) কলেজের সিভিলিয়ান শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে লেখানো হলেও অনেক সময় কেরী স্বয়ং প্রশংসা করে গ্রন্থকারের পরিচয় দিয়েছেন বা তার মূল্যায়ন করেছেন; যেমন, রামরাম বসু সম্পর্কে তার অভিমত : "(He) was one of the most accomplished' Bengali scholar of the day, and wielded the power of sarcama inherent in the language with singular effect" তার বিচারে, রামরাম বসু ছিলেন 'a good persian scholar'


উইলিয়াম কেরীর রচনাসমূহ :

বহুভাষাবিদ এবং গ্রন্থকর্তা কেরীর বাঙ্গলা গ্রন্থ বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট ও ১৮০০ খ্রীঃ নিউ টেস্টামেন্ট অনুবাদ (মুদ্রণ ১৮০২-১৮০৯ খ্রীস্টাব্দ), 'A Grammar of the Bengali language' (মুদ্রিত ১৮০১ খ্রীঃ), 'বাঙ্গালা-ইংরেজী অভিধান' (মুদ্রণ ১৮১৫ খ্রীঃ), ‘কথোপকথন’ (প্রকাশকাল ১৮০১ খ্রীঃ), ইতিহাসমালা’ (প্রকাশকাল-১৮১২ খ্রীঃ)।


উইলিয়াম কেরীর গদ্যরীতি :

উইলিয়াম কেরীর বাংলা ভাষা সম্পর্কে বিশিষ্ট ধারণার পরিচয় পাওয়া যায় তার গ্রন্থ এবং চিঠিপত্র থেকে। তাঁর অবদান হল সংক্ষেপে

  • (১) বাংলাভাষার মধ্যে দুটি পৃথক শ্রেণীর আবিষ্কার, অর্থাৎ উচ্চবর্ণের মধ্যে প্রচলিত সাধু বাংলা এবং সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যবহৃত ফারসি-মিশ্রিত কথ্যভাষা। (Carey's Letter to Sutcliff p. 198)
  • (২) দেশীয় সাধারণ মানুষদের আপন ভাষা অথবা উপভাষাগুলি সম্পর্কে অজ্ঞতার উল্লেখ (Ibid, p. 242 )।
  • (৩) বাংলা ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আবিষ্কার। 
  • (৪) বাংলা ভাষার ব্যাপ্তি এবং ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে মন্তব্য।

বাংলা গদ্যের সেই আদিম পর্যায়ে তার এ ধরনের সজাগ মনোভঙ্গী নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। তবু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর ভ্রান্তি দেখা যায়। তিনি যখন বলেন "...the Bengali, spoken by the Brahmans and higher Hindus; and the Hindustani spoken the Mussalmans and lower Hindus, which is a mixture of Bengali and Persian" তখন কিন্তু তা মানা যায় না। কেননা বাংলায় নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে হিন্দুস্থানী ভাষা প্রচলিত ছিল না, বাংলাই ছিল, তবে ফারসি মিশ্রিত লোকভাষা। মুসলমানরা ও বাঙালী মুসলমান, সেক্ষেত্রে তাদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা বা তা বাংলারই কোনো না কোনো উপভাষা। দ্বিতীয়ত, দেখা যায় সর্বসাধারণের জন্য নয়, তার গদ্য কিছু সমষ্টি মানুষের কাছেই উদ্ঘাটিত হয়েছে : "All who can speak the language well, or can read or write can perfectly understand me; yet the labouring people can understand but little." প্রকৃতপক্ষে, শুদ্ধ শীলিত বাংলা ও চলতি বাংলার মাঝে পড়ে কেরী যেন কিছু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। রামরাম বসুর সহায়তায় উচ্চবর্ণের মধ্যে প্রচলিত সাধু বাংলা আয়ত্ত হলেও তার চলতি রূপ শিখতে বা বলতে পারছিলেন না। কারণ ভাষার টান বল (Stroke), উচ্চারণের ঢং এবং ফারসি প্রভাবের দুর্বোধ্য মিশ্রণ বাধা হয়ে উঠেছিল। তার প্রথম বাংলা রচনায় তাঁর চিহ্ন স্পষ্টরেখ— “বাহিরে আইস এবং আলাদা হও এবং অপবিত্র বস্তু স্পর্শ করিও না এবং আমি কবুল করিব তোমারদিগকে এবং তোমরা হইবে আমার পুত্রগণ এবং কন্যাগণ এই মত বলেন সর্বশক্তি ভগবান”


কেরী বাইবেলের প্রখ্যাত বঙ্গানুবাদক। শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় টমাস অনূদিত এবং কেরীর দ্বারা সংশোধিত মিঙ্গল সমাচার মতীয়ের রচিত’ প্রথম প্রকাশিত বাংলা গদ্যগ্রন্থ। অনুরাগীরা তাকে উইক্লিফ এবং টিনডালের সঙ্গে তুলনা করেছেন। দেখা যায় ১৭৯৬ খ্রীস্টাব্দের পূর্বেই তাঁর ‘নিউ টেস্টামেন্টের’ অনুবাদ সম্পন্ন হয়। কিন্তু তবু নিরপেক্ষভাবে বলা যায় বাইবেল অনুবাদ করে ধর্ম বা ভাষা—কোনটিরই তিনি উন্নতি-বিধান করতে পেরেছিলেন কিনা সন্দেহ। “হেরোদ রাজার কালে যখন যিশু জন্মেছিলেন য়িহোদার বীতলক্ষমে তখন দেখ পণ্ডিত” ইত্যাদি উক্তি বিবৃতিপ্রবণ এবং পদ-বিন্যাস যে অস্বাভাবিক, একথা অস্বীকার করা যায় না।


কিন্তু ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ প্রকাশের পাশাপাশি বাংলা ভাষার ব্যাকরণটিতে কেরীর বাংলা ভাষা পর্যালোচনার অন্তরঙ্গ পরিচয় আছে। কেরীর জীবদ্দশাতেই গ্রন্থটির চারটি সংস্করণ (১৮০১, ১৮০৫, ১৮১৫ ও ১৮১৮ খ্রীঃ) হয়। হ্যালহেডের তেইশ বছর পরে প্রকাশিত এই ব্যাকরণে লক্ষ্য করা যায়

  • (ক) বাংলা ভাষার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে উত্তরে ভুটানের পর্বতমালা এবং রামগড় থেকে আরাকানের সীমানা পর্যন্ত ব্যাপ্তির উল্লেখ।
  • (খ) হিন্দুস্থানীর সঙ্গে বাংলার সম্বন্ধ-নির্ণয় প্রচেষ্টা।
  • (গ) ভারতের অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষা অপেক্ষা এই ভাষায় চার-পঞ্চমাংশ শব্দের সংস্কৃত-নির্ভরতার দিকে সজাগ দৃষ্টিদান।
  • (ঘ) বাংলা ভাষার শক্তি ও সম্ভাবনা দেখিয়ে তাকে উজ্জ্বল স্বীকৃতিদান ঃ "...it may be esteemed one of the most expressive and elegant language of the East." অন্তত এই ভবিষ্যৎবাণী পরবর্তীকালে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের রচনায়, ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার প্রবন্ধ রচনায় ঊনবিংশ শতকে আংশিকভাবে প্রমাণিত হয়েছিল।

কেরীর বিশ বছরের পরিশ্রমের স্বাক্ষর বাংলা-ইংরেজী অভিধান শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে পরিচিত। ‘ক্যালকাটা রিভিয়্যু'-এর সম্পাদক অভিধানটিকে 'by far the most copious, but rather unweildy' বলেছিলেন। সম্পূর্ণ গ্রন্থ দুটি খণ্ডে বিভক্ত। সংখ্যা অন্যূন পঁচাশি হাজার। ভূমিকাতে গিলক্রিস্ট, হান্টার এবং ফরস্টারের ঋণ স্বীকার করেছেন গ্রন্থকার। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদেরও সাহায্য ছিল।


‘কথোপকথন’ এবং 'ইতিহাসমালা'কে কেন্দ্র করেই প্রধানতঃ কেরীর গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় প্রতিষ্ঠালাভ। 'কথোপকথন' দ্বিভাষিক গ্রন্থ, বাঁ দিকের পাতায় বাংলা অন্য পাতায় ইংরেজী, পুরো নাম : "Dialogues intended to facilitate the acquiring of the Bengali Language": 'Colloquies' নামেও বইখানি প্রসিদ্ধ ছিল। বইটির ভূমিকা থেকে জানা যায় কিছু তথ্য–প্রথমত, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ছাত্রদের শাসনকার্যের সঙ্গে দেশের আভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা গঠনের জন্য বইখানি লেখা। দ্বিতীয়ত, কথা ভাষার অবলম্বন। তৃতীয়ত, সম্ভবত কিছু বিজ্ঞ বাঙালী ছিলেন এর রচয়িতা। চতুর্থত, কেরী ছিলেন গ্রন্থটির পরিকল্পক ও সম্পাদক।


বইটির পরিচ্ছেদ সংখ্যা ৩১। বিবিধ নামেই বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য লক্ষণীয়—যেমন ‘চাকর ভাড়া করণ’, ‘মহাজন আসামী’, ‘ঘটকালি’, ‘তিয়ারিয়া কথা' ইত্যাদি। সবগুলিই সংলাপিকা, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও স্তরের মানুষের ভাষায় মুখর এই গ্রন্থ।


উচ্চবর্ণের ভাষা : “ভট্টাচার্য আমাদের দেশে একটা প্রধান লোক বিদ্যাংশে বিবেচনাতে অতি ভাল লোক তিনি গেলেই আমাদের দেশের পাঠ গেল।” (“প্রাচীনে প্রাচীনে’)

প্রকৃতপক্ষে বাংলা বাক্যরীতি বা বাংলা Syntax সম্বন্ধে কেরীর ধারণা কতটা স্বচ্ছ ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছেন ড. সুকুমার সেন তাঁর গ্রন্থে (দ্রষ্টব্য : ‘বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য’, চতুর্থ সংস্করণ, কলকাতা ১৩৭৩, পৃষ্ঠা ১৯); যেমন কেরীর 'A Grammar of the Bengali Language' (4th edition, Serampore, 1818, p. 93) বইতে 'I have no money'-র বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে— 'আমার কিছু টাকা নয়’, অর্থাৎ ‘নয়’ এবং ‘নেই’-এর তফাৎ তিনি ১৮১৮ সালেও বোঝেন নি। এমনকি, তার মৃত্যুর পরে গ্রন্থটির পঞ্চম সংস্করণেও এই একই ভুল রয়ে গেছে।


‘কথোপকথন’ গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় রচিত ও শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত তৃতীয় গ্রন্থ। প্রকাশকাল ১৮০১ খ্রীস্টাব্দের ৪ঠা আগস্ট, তৃতীয় সংস্করণের শেষভাগে একটি সংক্ষেপিত বাংলা ব্যাকরণ সংযোজিত হয়েছিল। ছাত্রদের বাংলা ভাষা শিক্ষা এবং দেশের আভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সম্বন্ধে ভাল রকম ধারণা গঠনের উদ্দেশ্যেই কেরীর পরিকল্পনায় কিথোপকথন' রচিত হয়।


উইলিয়াম কেরীর ভাষা সম্পর্কে অভিমত : 

১. কেরীর দৃষ্টিতে তাঁর গদ্য সর্বসাধারণের জন্য নয়— "All who can speak the language well, or can read or write can perfectly understand me; yet the labouring people can understand but little."


২. বাংলাভাষাকে তিনি দুভাগে ভাগ করেছেন— "Indeed, there are two distinct languages spoken all over the country. viz; the Bengali, spoken by the Brahmans and Higher Hindus; and the Hindustani, spoken by the Mussalmans and lower Hindus, which is a mixture of Bengali and Persian" (Carey's letter to Sutcliff p. 198).

বাংলাদেশে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে হিন্দুস্থানী ভাষা প্রচলিত ছিল না, বাংলাই ছিল, তবে তা ফারসি-মিশ্রিত লোকভাষা। মুসলমানেরাও বাঙালী মুসলমান, মাতৃভাষা বাংলাই, তা বাংলারই কোনো না কোনো উপভাষা। তাই লক্ষ্য করলে দেখা যায় উদ্ধৃত বাংলা গদ্যের দৃষ্টান্তে ('কবুল’, ‘অপবিত্র বস্তু' ইত্যাদি) তিনি প্রচলিত উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের সাধু ‘ফারসি'-মিশ্রিত বাংলাকে অভিন্ন ভেবেছেন। কেরী নিজে কিন্তু এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। তার বিচারে সাধারণ মানুষের স্বভাষা অথবা দেশীয় উপভাষাগুলি সম্বন্ধে উদাসীনতা বা অজ্ঞতাই এর কারণ— "One of my great difficulties arises from the common people being so extremely ignorent of their language, and various dialects which prevail in different parts of the country",