জোড়াসাঁকো নাট্যশালা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

চারটি বড়ো সখের নাট্যশালার মধ্যে 'জোড়াসাঁকো নাট্যশালা হল তৃতীয়। এর প্রতিষ্ঠার মূলে ছিলেন সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক পত্র থেকে জানা যায় গোপাল উড়ের যাত্রা শুনে নাট্যশালাটি প্রতিষ্ঠার সংকল্প তাঁদের মনে জাগ্রত হয়। ফলে কেশবচন্দ্র সেনের ভ্রাতা কৃষ্ণবিহারী সেন, অক্ষয় চৌধুরি ও যদুনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিরা সবকিছুর ব্যবস্থাপনা ও নাটকের বই নির্বাচনের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। কৃষ্ণবিহারী সেন হলেন অভিনয় শিক্ষক।


সর্বপ্রথম মধুসূদন দত্তের 'কৃষ্ণকুমারী' ও পরে 'একেই কি বলে সভ্যতা' নাটকের অভিনয় হয়। এখানকার অভিনেতারা শিক্ষাপ্রদ উপযুক্ত নাটকের অভাব অনুভব করলেও ওই পাঁচজনের কমিটি ওরিয়েন্টাল সেমিনারীর প্রধান শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র নন্দীর পরামর্শ নেন। তাঁর নির্দেশ অনুসারে একটি সামাজিক বিষয়কে উপজীব্য করে নাটক লেখার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় এবং পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। বিষয়টি ছিল 'বহু বিবাহ'। পরে বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করে ওই কমিটি পণ্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্নের ওপর নাটকটি রচনার ভার ন্যস্ত করে। ফলে রামনারায়ণ বহু বিবাহ সম্বন্ধে 'নবনাটক' রচনা করে দুইশত টাকা পুরস্কার পান। ১৮৬৭-এর ৫ জানুয়ারি ‘নবনাটকের অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে নাটকটি নয়বার অভিনীত হয়।


কৃষ্ণকুমারী ও নবনাটকের অভিনয়ের পর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিশেষত তৎকালীন ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় বিস্তর ধন্যবাদ ও প্রশংসা প্রকাশ পেয়েছিল। এথেকে সহজেই অনুমেয় জোড়াসাঁকো নাট্যশালা অভিনয়ে প্রথমত, বাস্তবরীতি অনুসরণ করেছিল। এই বাস্তবরীতি আনবার চেষ্টা কত যে প্রবল ছিল, তার প্রমাণ মেলে আটা দিয়ে অরণ্যের দৃশ্যে জীবস্ত জোনাকি পোকা আটকানোর চেষ্টায়। দ্বিতীয়ত, আলোকসম্পাত সম্পর্কে নাট্যশালাটি বেশ কৃতিত্ব দেখিয়েছিল। তখন গ্যাসের আলো হয়তো ছিল কিন্তু তার দ্বারা সূর্যাস্ত ও সন্ধ্যার দৃশ্যকে মনোহর করে তোলায় নৈপুণ্য প্রকাশ পেয়েছে। তৃতীয়ত, এ দেশের শিল্পীরাই দৃশ্যাঙ্কনে দক্ষতা দেখিয়েছিলেন, আর সব শেষ হল, ‘নবনাটকের’ অভিনয় পরবর্তীকালে বাংলার একজন বিখ্যাত নটের জীবনকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। সেই নট অর্ধেন্দুশেখর মুফী-র অভিনয়ে এমনই মুগ্ধ হন যে তিনি প্রায়ই বলতেন- “নবনাটকের অভিনয় আমাকে সবকিছু দেখা, শোনা, অভিনয়ের শিক্ষা দিয়েছে।” যাইহোক, ১৮৬৭-র শেষের দিকে এ নাট্যশালা লুপ্ত হয়ে যায়।


সর্বোপরি, জোড়াসাঁকো নাট্যশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয় এদেশের সখের থিয়েটারের জৌপব্রের সময়। ধনী বাঙালির প্রাসাদ মঞ্চের সঙ্গে এই নাট্যশালার পার্থক্য এই, এখানে বাড়ির সবাই মুক্ত হয়ে অভিনয় করত এবং শুধুমাত্র আমোদ-প্রমোদ বা রাজবাড়ির জৌলুষ দেখানোই এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না। পাশ্চাত্য নাট্যরীতির সঙ্গে ভারতীয় নাট্যরীতি এবং বাংলার নিজস্ব দেশজ নাট্যরীতির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নাট্য উপস্থাপন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটা নতুন নাট্যধারা সৃষ্টির প্রয়াস এখানে লক্ষ করা যায়। এই সময়েই ঠাকুর বাড়িতে হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠিত হয়ে জাতীয়তাবোধের উদ্বোধন ঘটে। এখানেই জোড়াসাঁকো নাট্যশালাটির বিশেষত্ব।