নবকুমারের স্ত্রী হরকামিনীর ভাগ্য বিড়ম্বিত জীবন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করো।

হরকামিনী

নবকুমারের স্ত্রী হরকামিনীর ভাগ্যবিড়ন্বিত জীবন আমাদের বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। অন্তঃপুরের এই গৃহবধূ নারীকে যে লাঞ্ছিত জীবন ভোগ করতে হয়েছিল তা হল তৎকালীন উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীদের বিধিলিপি মাত্র। আধুনিকতার অন্ধমোহে তখনকার নব্যযুবকরা সীমাহীন লাম্পট্য ও ভোগবিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল। সেই জীবনের সঙ্গে এই অস্তঃপুরিকাদের কোনো যোগ ছিল না। গল্পগুজব, তাসখেলা ও আলস্যের মধ্যে দিয়ে তাদের জীবন কেটে যেতে। তবে বাড়ির গৃহিণীর তাস খেলা পছন্দ করেন না তাই তাঁকে আসতে দেখে হরকামিনী তাস খেলা বন্ধ করে তাসগুলো বালিশের তলায় লুকিয়ে ফেলে। বাড়ির গৃহিণীর প্রতি তার যে একটা মর্যাদা সম্ভ্রমবোধ ছিল তার পরিচয় এখানে নিহিত।


এই সম্ভ্রম ও মর্যাদাবোধ কিন্তু স্বামীর প্রতি হরকামিনীর বিন্দুমাত্র ছিল না। যে স্বামী মাতাল, তার সঙ্গে নিবিড় বন্ধন কখনই প্রত্যাশা করা যায় না। তার স্বামী মাতাল হয়ে প্রায়ই জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা থেকে মধ্যরাতে বাড়ি ফিরত। ফলে যে মধুর দাম্পত্য জীবন সংসারে সুখ শান্তি এনে দেয় তা থেকে হরকামিনী ছিল বতি। একটা নিষ্ঠুর দহন জ্বালা নীরবে তাকে সহ্য করতে হয়েছে।


হরকামিনী শিক্ষিতা বা আলোকপ্রাপ্তা নারী নয়। সেই কারণেই তার রসিকতা মাঝে মাঝে শালীনতার সীমা অতিক্রম করে গেছে। একদিন মধ্যরাতে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা থেকে মদ্যপ অবস্থায় ফিরে এসে সাহেবি কায়দায় নবকুমার নিজ ভগ্নীর মুখে চুম্বন করেছিল। সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সে স্থূল রসিকতা করেছে ননদের সঙ্গে—“তুই ভাই তোর দাদাকে নে না কেন ? আমি না হয় বাপের বাড়ি গিয়ে থাকি।” এ ধরনের রসিকতা গ্রাম্যতা দোষে দুষ্ট, একেবারেই স্থূল ও কদর্য।


একদিন মধ্যরাতে নবকুমার মাতাল অবস্থায় 'জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’ থেকে ফিরে এসে ‘মদ ল্যাও' বলে চিৎকার করেছে, বৃদ্ধ পিতাকে 'ভণ্ড ফুল' বলে সম্বোধন করেছে, তখন হরকামিনী ভীত সংকুচিত হয়েছে, একথা ভেবে, এবার কর্তামশায় পুত্রের সব কুকীর্তির কথা জেনে যাবেন। সেজন্য সে প্রসন্নকে বলেছে নবকুমারকে চুপ করবার জন্য। কিন্তু প্রসন্ন রাজি না হওয়ায় সে নিজেই তাকে প্রতিনিবৃত্ত করতে গেলে নবকুমার মদের ঝোঁকে তাকে ‘পয়োধরী’ বলে সম্ভাষণ করলে হরকামিনী এসবের কোনো অর্থ বুঝতে না পেরে ঠাকুরঝির শরণাপন্ন হয়। এথেকে প্রমাণিত হয় মদ্যাসক্তি ছাড়াও নবকুমারের চরিত্রের অন্যান্য বদগুণগুলি যেমন তার পতিতাসক্তি, বারাঙ্গনা-প্রীতি প্রভৃতির সঙ্গে হরকামিনী যথেষ্ট পরিচিত ছিল না।


সবশেষে বলতে হয়, হরকামিনীর সংসার জীবন মন্থনে অমৃত নয়, জুটেছে শুধুমাত্র গরল। তাই নিজ জীবনের প্রতি বীতস্পৃহ হয়ে সে আক্ষেপোক্তি করেছে–“এমন স্বামী থাকলেই বা কি, আর না থাকলেই বা কি। এসব দেখেশুনে আমার ইচ্ছে করে যে, গলায় দড়ি দিয়ে মরি।” জীবন-যন্ত্রণায় দগ্ধ এই নারীর এ হেন মর্মান্তিক উক্তির মধ্য দিয়ে তৎকালীন যুগের অন্তঃপুরিকাদের গোপন বেদনার অশ্রু নীরবে ঝরে পড়েছে। নাট্যকারের যা অভিপ্রায় তা হরকামিনীর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। তার শেষ উক্তি—“মদ মাংস খেয়ে ঢলাঢলি করলেই কি সভ্য হয়”—সচেতন শিক্ষিত মানুষের কাছে এক সরব প্রতিবাদের মতো এই কথাগুলি শোনায়। মধুসূদন তাঁর অভিপ্রায় ও উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করার জন্যই হরকামিনীর চরিত্রটি বেছে নিয়ে এমনভাবে উপস্থাপনা করেছেন।