পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসের ঘটনা প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে কুসুম চরিত্রের গুরুত্ব নিরূপণ করো।

সমালোচক ড. নিতাই বসুর মূল্যবান অভিমত: “কুসুম রহস্যময়ী, কুটিল মনের অধিকারিণী, জীবন ও পারিপার্শ্বিক থেকে কোনো কিছু না পেয়ে সে যেন প্রবঞ্চিতার মতো জ্বালাময়ী, চালচলনে বেপরোয়া, মুখে সর্বদা ব্যঙ্গের হাসি। কুসুমকে সকলে সমীহ করে।” হারু ঘোষের ছেলে পরাণ। কুসুম তার স্ত্রী। গৃহস্থ বাড়ির সে বউ। শাশুড়ি মোক্ষদা বেজায় খাপ্পা তার উপর। সে গ্রামীণ সংস্কারকে বিশেষ আমল দেয়নি। অনেকটা স্বাধীনচেতা মনোভাবের প্রকাশ রাখে। তেইশ বছরের জীবনে তার কোনো সন্তান আসেনি। বাঁজা বলে গায়ের জোরও বেশি। মোক্ষদা পড়ে গেলে কুসুম তাকে আড়কোলে শূন্যে তুলে শোবার ঘরের দাওয়ার নিয়ে যায়। অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে সে। তার বাবা বেশ অবস্থাপন্ন। সেদিক থেকে পরাণের অবস্থা যে অনেকটা খেলো সে কথা উপন্যাসেই প্রমাণিত। শাসন ও সম্ভ্রমে কুসুমের অবস্থান : “কুসুমকে এ বাড়ির সকলে ভয় করে। এ বাস্তুভিটাটুকু ছাড়া হারু ঘোষের সর্বস্ব কুসুমের বাবার কাছে বাঁধা আছে সাত বছর। তাই বলিয়া কুসুমকে বাড়ির লোকগুলিকে শাসন করিয়া বেড়ায়, তা নয়। বরং সে অনেকটা নিরীহ সাজিয়াই থাকে।” এ তার ছলনা মাত্র। বকাবকি করলে কানেও তোলে না, নিজের মনে ঘরের কাজ সামলায়। কাজে মন না বসলে ঘরের দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে তালপুকুরের ধারে পড়ে থাকা তালগাছটার উপর সারাক্ষণ একাকী বসে থাকে। তাকে বোঝাই দায়। এককথায় বেশ দুর্বোধ্য ধারার চরিত্ররূপে লেখক তাকে তুলে ধরেছেন, অর্থাৎ এক রহস্যময়ী নারী কুসুম।


শশী ডাক্তারকে ভালোবাসে কুসুম। রহস্যময়ী নারীর এ এক দুর্বোধ্য ভালোবাসা। এই কুসুম বহুবার বহুভাবে শশীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। মিথ্যা অসুখের ভান করে সে শশীর সান্নিধ্যে আসতে চেয়েছে। উপন্যাসে দেখা যায়, মিথ্যা হাত ভাঙা, কোমর ভাঙার নাম করে কুসুম শশীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভের জন্য বিশেষভাবে প্রয়াসী হয়েছে, গ্রামীণ হয়েও সে সাপ খোপের ভয় না করে মরণকে উপেক্ষা করে শশীর কাছে আসে। শশী তাকে “সাপে কামড়াবে যে ?” প্রশ্ন করলে কুসুম পরিষ্কার জানিয়ে দেয়—“সাপে আমাকে কামড়াবে না ছোটোবাবু, আমার অদৃষ্টে মরণ নেই।” কুসুমের মধ্যে শশীকেন্দ্রিক প্রেমের পাগলামি আছে। ওর খাপছাড়া কথায় ব্যবহারে তা প্রকট। কুসুমের কথাগুলিও শশীর মন্দ লাগে না–ঔপন্যাসিকের ভাষায়—“মুখস্থ বুলির মতো একরাশ তোশামোদের কথা কুসুম বলিয়া যায়, শুনিতে মন্দ লাগে না শশীর। কতবছর আজ সে কুসুমের এমনি পাগলামি দেখিতেছে। ওর এইসব খাপছাড়া কথায় ব্যবহারে একটা যেন স্পষ্ট ছন্দ আছে।” শশীকে কেন্দ্র করে কুসুমের রোমান্টিক ভাবনা দানা বাঁধতে থাকে। কুসুমের মনেও জাগে কবিত্ব—

"ভিনদেশী পুরুষ দেখি চাদের মতন।

লাজরক্ত হইয়া কন্যা পরথম যৌবন।।”


কুসুম শশীর সঙ্গে বাঁধা পড়ে দুর্বোধ্য জটিল সম্পর্কের বন্ধনে। পরাণ পত্নী কুসুম শশীর জীবনে প্রথম থেকে উপেক্ষিতা অনাদৃতা। কুসুমের উপবাসী হৃদয়ের প্রেম শশীর কাছে প্রথম পর্বে মূল্য না পেলেও যখন শশী এ প্রেমের, এ উপবাসী হৃদয়ের মূল্য দিতে গেছে তখন বেলা বয়ে গেছে বড়ো দেরি হয়ে গেছে, কুসুমের আত্মনিবেদনের প্রতিদান দিতে শশী ব্যগ্র হয়ে উঠলে সেই মুহূর্তে কুসুমের প্রেমে পড়েছে ভাটা। উচ্ছ্বাসটা হয়েছে মন্দীভূত। তবে মান অভিমানের মধ্য দিয়ে শশী ও কুসুমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং পরিণতির পথে অগ্রসর হয়। ভালোবাসার গভীরতায় কুসুম শশীর সঙ্গে ঝগড়াও করে। আসলে এটা অভিমানাহত নারীর অভিমানের বহিঃপ্রকাশ। উভয়ের মধ্যে অকারণে হয়ে গেছে তুমুল ঝগড়া। দিনাচারের মধ্যেই কুসুম দুপুর বেলা চুপি চুপি চোরের মতো ক্ষমা চাইতে এল শশীর কাছে। শশীর বাগানে সাধের গোলাপ চারাটিকে কুসুম পা দিয়ে মাড়িয়ে দেয়। কুসুম সেই নারী চরিত্র, যে শশীর মতো বৈজ্ঞানিক ডাক্তারকে আলোড়িত করেছে। শশী গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা ভাবলে তার মনে হয় কুসুম যেন তার পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে। “এই গ্রাম ছাড়িয়া কোথাও যাইবার শক্তি নাই। নিঃসন্দেহে এজন্য দায়ী কুসুম। শশীর কল্পনার উৎস সে যেন চিরতরে রুদ্ধ করিয়া দিয়াছে।”


এক বিস্ময় বালিকা যেন কুসুম। তার অন্তরেই সদাসর্বদা একটি বালিকা বসবাস করে। এই বিস্ময়কর সত্তার দিক শশী বিশেষভাবে উপলব্ধি করে। পরিণত দেহমনেও কুসুমের সেই বালিকা সত্তার বিশ্লেষণে শশীর অভিব্যক্ত : “একটি বালিকা আছে কুসুমের মধ্যে, মতির চেয়েও সে সরল, মতির চেয়েও নির্বোধ, সংসারকে দেখিয়া শুনিয়া কুসুমের যে অংশটা বড়ো হইয়াছে, এই বালিকা কুসুমটি তার আড়ালে বাস করে।” এই কুসুম সংসারকে যখন ভুলতে বসে জীবনের যত দায়িত্ব যত জটিলতা কিছুই যখন তার নাগাল পায় না, তখন তার এই বিস্ময়কর দিকটি চোখে পড়ার মতো। শশরী বুঝতে বিলম্ব হয় না এতদিন কুসুমের পাগলামি যেভাবে যে লক্ষ্য করেছে তা শান্ত, সহিষ্ণু ও গম্ভীর প্রকৃতির কোনোদিন খাপ খাবে না। কুসুমের বর্তমান দেহমনে যার অস্তিত্ব কল্পনা করা সুদূর পরাহত। কুসুম শশীর কাছে মাঝেমধ্যে স্পষ্ট ভাষায় প্রেমও নিবেদন করে বসে। সে বলে—“এমনি চাঁদনি রাতে আপনার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে সাধ হয় ছোটোবাবু।” শুধু কি তাই, দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে শশীর পাশে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট করে সে তার আত্মনিবেদনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে : “আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর কেমন করে ছোটোবাবু।”


ভাটায় ক্ষীণা তরঙ্গিনী পুনঃ দুকূল ভাঙলেও, নারীজীবন থেকে যৌবনের উচ্ছ্বাস চলে গেলে তা আর ফিরে আসে না। চূড়ান্ত মুহূর্তে এইরকম সত্যটি বুঝিয়ে দিয়েছে কুসুম। শশী কুসুমের মনের অবস্থা বুঝতে না পেরে যখন বলে : “তোমার কী হয়েছে বুঝতে পারছি না।” উত্তরে কুসুম বলে: “কী করে বুঝবেন ? মেয়ে মানুষের কত কী হয় সব বোঝা যায় না।" চিরকালের জন্য গাওদিয়া ছেড়ে কুসুম বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার স্থির সিদ্ধান্ত নিলে। শশী তার এ সিদ্ধান্ত বদলাতে তৎপর হলে, কুসুম ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয় তার উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়েছে। “আকাশের মেঘ কমে নদীর জল বাড়ে নইলে কি জগৎ চলে ছোটোবাবু।” বঞ্চিতা নারী কুসুম মাঝেমধ্যে প্রতিহিংসার দাবানলে জ্বলে উঠতে চায়। অবশ্য কার্যে পরিণত হয় না। কেবল শশী সকল আহ্বান অকাতরে খণ্ডন করে সে তা প্রতিশোধ নেয়। উপন্যাসের অন্তিম স্তরে দেখা যায় প্রাণচঞ্চল কুসুমের বিশেষ, সত্তার অপমৃত্যু। “কুসুম মরিয়া গিয়াছে। সেই চপল হাস্যময়ী, আধো বালিকা, আধো রমণী, জীবনী শক্তিতে ভরপুর, অদম্য অধ্যবয়সী কুসুম।” তার উচ্ছল ভালোবাসা, উদ্দাম জীবনী শক্তি, প্রেমোম্মত্ত প্রাণোচ্ছলতা ক্রমে ক্রমে নির্জীব হয়ে শবাকার প্রাপ্ত হয়েছে। এটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক পরিণতি।


তবে অভিযোগ মুখর নারী কুসুম শশীর বিরুদ্ধে যতই অভিযোগের তির নিক্ষেপ করুক না কেন তার কাছে শশী দেবপ্রতিম। সে তো নিজেই বলেছে—“আপনি দেবতার মতো ছোটোবাবু।” এই কল্পিত দেবতার 'পরেই কুসুম করেছিল তার হৃদয় নিবেদন। নিরুত্তপ্ত গ্রামজীবন। এই গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে ক্রমেই শশীর জীবনে কুসুম একটি সতেজ কুসুম হয়ে ফুটে উঠেছিল। শশীর জীবনকে দারুণভাবে নাড়া দিয়ে সে শেষ পর্যন্ত সরে যায় ; শশীর জীবন থেকে সরে যায় দূরে বহুদূরে—গাওদিয়া গ্রাম ছেড়ে তার বাপের বাড়ির দেশে। কোনো দিনও শশীর সান্নিধ্যে ফেরেনি, তার চলে যাওয়ায় কেবলমাত্র গাওদিয়া গ্রাম শশীর মনোজগৎ শূন্য হয়নি সাথে সাথে পরিচিতের অবকাশে যেমন অতৃপ্তির আবেশে মগ্ন রেখে যায়। তাই বলতে হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসাধারণ সৃষ্টি এই কুসুম চরিত্র। উপন্যাসে কুসুম চরিত্রের চারিত্রিক প্রবণতা বিশ্লেষণে সিংহভাগ ব্যায়িত হয়েছে, মানিক লেখনীর কৃতিত্বে এই নারী চরিত্রটি বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের এক অতুলনীয় নারী চরিত্রে উন্নীত হয়ে তার অনন্যতাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।