বাংলা গদ্যের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠাপর্ব : প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১ খ্রীঃ-১৯৪১ খ্রীঃ)

বাংলা গদ্যে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ


কাব্যে হৃদয়বৃত্তির স্থান মুখ্য, প্রবন্ধে চিদবৃত্তি। প্রথমটির পথ সংশ্লেষণের, দ্বিতীয়টির বিশ্লেষণের। একটির লক্ষ্য কল্পনার রসায়নে সৌন্দর্য-মাধুর্যের সৃষ্টিছাড়া আনন্দলোক রচনা, অন্যটির উদ্দেশ্য তথ্য প্রয়োগে সত্য প্রতিষ্ঠা। চিন্তার প্রাখর্যে, তথ্যের অন্বয়ে এবং তর্কের ক্রম সংবদ্ধতায় প্রবন্ধের সার্থকতা। কিন্তু আরো এক ধরনের প্রবন্ধ আছে, যেগুলি তথ্য-বিনির্ভর এবং যুক্তিরিক্ত, ব্যক্তিরস এবং ব্যক্তির স্বগতঃ গুঞ্জরণই সেখানে মুখ্য। রবীন্দ্রনাথের এই দুই ধরনের প্রবন্ধ সৌন্দর্য-মনোহর।


রবীন্দ্রনাথের রচনাগ্রন্থ:

(ক) শিক্ষা-সমাজ-রাজনীতি : মন্ত্রী অভিষেক’ (১৮৯০), ‘সংস্কৃত শিক্ষা’—দ্বিতীয় ভাগ (১৮৯৬), ‘আত্মশক্তি' (১৯০৫), 'ভারতবর্ষ' (১৯০৬), ‘শিক্ষা’ (১৯০৮), ‘রাজা প্রজা’ (১৯০৮), 'স্বদেশ' (১৯০৮), 'সমাজ' (১৯০৮), 'সমূহ' (১৯০৮), ‘পরিচয়’ (১৯১৬), ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম' (১৯১৭), ‘সমবায় নীতি' (১৯২৮), 'কালান্তর' (১৯৩৭), ‘সভ্যতার সঙ্কট’ (১৯৪১), ‘পল্লীপ্রকৃতি' (১৯৬২)।


(খ) ধর্ম ও দর্শনমূলক : উপনিষদ্ ব্রহ্ম’ (১৯০১), ‘ধর্ম’ (১৯০৯), ‘শান্তিনিকেতন’ (১৯০৯-১৯১৬), ‘সঞ্চয়' (১৯১৬), ‘মানুষের ধর্ম’ (১৯৩৩), ‘প্রাক্তনী’ (১৯৩৬), ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ (১৯৪১), 'বিশ্বভারতী' (১৯৪১)।


(গ) সাহিত্য-সমালোচনা : ‘সমালোচনা’ (১৮৮৮), ‘প্রাচীন সাহিত্য' (১৯০৭), ‘সাহিত্য’ (১৯০৭), ‘আধুনিক সাহিত্য' (১৯০৭), ‘লোকসাহিত্য' (১৯০৭), '‘সাহিত্যের পথে’ (১৯৩৬), '‘সাহিত্যের স্বরূপ' (১৯৪৩)।


(ঘ) ব্যক্তিগত প্রবন্ধ : ‘পঞ্চভূত’ (১৮৯৭), ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ (১৯০৭), ‘লিপিকা’ (১৯২২), ‘ভারতপথিক রামমোহন রায়' (১৯৩৩)।


(ঙ) জীবনী ভ্রমণকথা ও পত্রসাহিত্য : য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’ (১৮৮১), ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ (১৮৩৩), ‘রামমোহন রায়’ (১৮৮৫), '‘চিঠিপত্র' (১৮৮৭), ‘য়ুরোপযাত্রীর ডায়েরী’ (১৮৯১-১৮৯৩), 'চরিত্র পূজা' (১৯০৭), 'বিদ্যাসাগর চরিত' (১৯০৯), ‘জীবনস্মৃতি’ (১৯১২), 'ছিন্নপত্র' (১৯১২), 'জাপানযাত্রী' (১৯১৯), ‘যাত্রী’-‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়রি’ ও ‘জাভা-যাত্রীর পথ’ (১৯২৯), 'ভানুসিংহের পত্রাবলী' (১৯৩০), ‘রাশিয়ার চিঠি’ (১৯৩১), 'জাপানে পারস্যে' (১৯৩৬), ‘পথে ও পথের প্রান্তে' (১৯৩৮), ‘পথের সঞ্চয়' (১৯৩৯), 'ছেলেবেলা' (১৯৪০), 'চিঠিপত্র' প্রভৃতি।


কবি-সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ বাংলা প্রবন্ধেরও এক অনন্য স্রষ্টা। তাঁর প্রতিভার ‘সোনার কাঠির’ স্পর্শে পাষাণপুরীর স্বর্ণপুরীতে রূপান্তর এক স্বাভাবিক ঘটনা। শিক্ষা, রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম, সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রভৃতি তথ্য-নির্ভর প্রবন্ধে তিনি যুক্তি-নির্ভর, তীক্ষ্ণ বাক্য-সন্নিবেশে তৎপর এবং শ্লেষ ও ব্যঙ্গ প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত। ব্যক্তিগত প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য, অন্তরের অতল তলে অবগাহন এবং সেখান থেকে সাহিত্যের সপ্ত রঙের মণি-মাণিক্য আহরণ। তার ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধাবলী ঐশী স্পর্শলোভাতুর কবির আবেগময় আকুতির কাব্যময় প্রকাশ। ‘শান্তিনিকেতন'-এর ব্যাখ্যানমূলক লেখাগুলি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ধর্মমত ও উপনিষদের প্রভাবপুষ্ট। কিন্তু তত্ত্ব এখানে অমূর্তবাণী নয় সে দৃশ্যে, বর্ণে, গন্ধে, গানে মূর্ত। তাঁর শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধগুলিতে লেখকের উদার মানসমুক্তি এবং প্রকাশিত শিক্ষা পদ্ধতির যান্ত্রিকতা ও অপূর্ণতা উদ্‌ঘাটিত “ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি একটা শিক্ষা দিবার কল।... পরীক্ষার সময় এই বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার উপর মার্কা পড়িয়া যায়।” আদর্শ শিক্ষা প্রসঙ্গে তার মন্তব্যটিও সমর্থনযোগ্যঃ “যিনি জাত শিক্ষক ছেলেদের ডাক শুনলেই তার ভিতরকার আদিম ছেলেটা বেরিয়ে আসে,” কিম্বা “যে গুরুর অন্তরে ছেলেমানুষটি একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়েছে তিনি ছেলেদের ভার নেবার অযোগ্য। উভয়ের মধ্যে শুধু সমীপ্য নয়, আন্তরিক সাযুজ্য ও সাদৃশ্য থাকা চাই, নইলে দেনাপাওনায় নাড়ীর যোগ থাকে না।” তার রাজনৈতিক প্রবন্ধে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রনীতির ভোগস্পৃহা ও শোষণ বৃত্তি নিন্দিত, আর ভারতে ইংরাজ-শাসনের কলঙ্কিত অধ্যায় ধিকৃত। মৃত্যুর প্রাক্কালে রচিত ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধে আপাতসমৃদ্ধ কিন্তু ভিতরে মৃত্যুজীর্ণ এই দস্যু সভ্যতার প্রতি কবির ঋষি-সুলভ চরম অভিশাপবাণী উচ্চারিত। আর সেই সঙ্গে ধ্বনিত হয়েছে এক চিরন্তন বাণী— “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ”।


সমালোচনা-সাহিত্য সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ অদ্বিতীয়। ‘প্রাচীন সাহিত্য’, ‘লোকসাহিত্য’, ‘আধুনিক সাহিত্য’, ‘সাহিত্য’, ‘সাহিত্যের পথে’ প্রভৃতি গ্রন্থ কবির মৌলিক গূঢ়সঞ্চারী অনুভূতির আলোকে সমুজ্জ্বল। উপনিষথিত যে আনন্দ থেকে নিখিল বিশ্বের উদ্ভব, সেই আনন্দই মহাকবির মতে, সাহিত্যের আদর্শলোক সৃষ্টির মৌল কারণ। ‘প্রাচীন সাহিত্য’-এর ‘মেঘদূত’ রবীন্দ্র-সৃষ্ট নব মেঘদূত। কবি এই মেঘদূতকে নিয়ে চলে গিয়েছেন আপন কল্পরাজ্যে, সেখানে তার ‘মানস সরোবরের অগম তীরে’ পরম দয়িত প্রতীক্ষারত। অতলস্পর্শ বিরহ কবি চিত্তে ঘনীভূত। সেই গভীর বিরহের মধ্যে কবির আশ্বাস“এক অপূর্ব সৌন্দর্যলোকে শরৎ পূর্ণিমা রাত্রে তাহার সহিত চিরমিলন হইবে।”


রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সমালোচনা অভিনব সাহিত্যসৃষ্টি। কবির মতে, কালিদাসের প্রকৃত মাহাত্ম্য ভোগাসক্ত প্রেমের বর্ণাঢ্য চিত্রণে নয়, তপশ্চৰ্য্যাপূত প্রেমের নিরুচ্ছাস পরিণতিতে। ‘কাব্যে উপেক্ষিতা' প্রবন্ধে ঊর্মিলার প্রতি গুরুকবির উপেক্ষা কাহিনী কবিগুরুর লেখনীতে বিবৃত। বাণভট্টের হাতে পত্রলেখার আতপ্ত যৌবনের অবমাননায় কবিচিত্ত ব্যথিত। তাই কাব্যে উপেক্ষিতারা প্রাচীন কাব্যের যজ্ঞভূমি থেকে উত্থিত হয়ে রবীন্দ্র-চিত্তের স্বর্ণসিংহাসনে অধিষ্ঠিত।


রবীন্দ্রনাথের ‘লোকসাহিত্য’ অবিস্মরণীয়। “এই সকল ছড়ার মধ্যে একটি চিরত্ব আছে,” অখ্যাত গ্রাম্যকবির রচনা সম্বন্ধে মহাকবির রাজসিক প্রশস্তি“এই স্বাভাবিক চিরত্বগুণে ইহারা আজ রচিত হইলেও পুরাতন এবং সহস্র বৎসর পূর্বে রচিত হইলেও নূতন।”


‘আধুনিক সাহিত্যে’র সমালোচনাগুলি রবীন্দ্রনাথের সূক্ষ্মদর্শিতার পরিচায়ক। এর মধ্যে বঙ্কিমের ‘রাজসিংহ' উপন্যাসের সমালোচনা এককথায় অসাধারণ। তবু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে স্বীকার্য, ‘প্রাচীন সাহিত্যে' তার সমালোচনা যতটা সৃষ্টিধর্মী ‘আধুনিক সাহিত্য' তার অভাবদুষ্ট।

স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর সৃষ্টি তার 'বিচিত্র প্রবন্ধ'। যুক্তিতর্ক-বিনির্ভর কবির ধ্যান দৃষ্টির একটি অতর্কিত উৎক্ষেপ, স্বপ্নাতুর কল্পনার এক বর্ণাঢ্য চিত্রকল্প এবং ভাবহীন সহজের রস এখানে অপরূপ কাব্য-সৌন্দর্যে অভিব্যক্ত। শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের লক্ষণ 'Is a kind of lucky dip into the experience or into fantasy-often into both. The ordinary essayist dips again and again, and seldom brings up anything worth showing to his neighbours.' রবীন্দ্রনাথ "dipped again and almost invariably come back with a parcel of treasure." (Lind) তাই দেখি, ‘পাগল', ‘কেকার ধ্বনি', 'নববর্ষা', 'পরনিন্দা', 'রুদ্ধগৃহ’, ‘পথপ্ৰাস্তে', প্রভৃতি লেখা রবীন্দ্র ভাষ্য অনুযায়ী 'বাজে কথা', বেকনের ভাষায় 'dispersed meditation' এলোমেলো চিন্তা। কিন্তু সাহিত্য জগতে সেগুলিই দুর্লভ নিটোল মুক্তো। কারুকার্য করা ভাষার নৌকা বেয়ে লেখক যেন বিষয় থেকে বিষয়াত্তরে স্বেচ্ছাভ্রমণে রত। আর সেখানে রসস্রোতের সোনার তরী লেখকের অন্তরের স্পর্শে ও আনন্দের ফসলে ভরপুর হয়ে উঠেছে।


রূপকাশ্রয়ী ‘পঞ্চভূতের’ লেখাগুলি কবির এক নতুন ধরনের রচনা নিদর্শন। অগ্রজ বঙ্কিমের ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’র সঙ্গে আঙ্গিক সাদৃশ্য থাকলেও, ভাব-ভাষা এবং বস্তু তথ্যে রবীন্দ্রনাথের রচনা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী জগৎ পঞ্চ উপাদানে কায়ানির্মিত। লেখকের মতানুযায়ী কম-বেশি এক একটি উপাদানের এক একটি বিশেষ গুণ মানুষকে পৃথক বৈশিষ্ট্য এনে দিতে সক্ষম। ‘ক্ষিতি’ বস্তুনিষ্ঠ, ‘অপ্’ কবির ভাষায় স্রোতস্বিনী উচ্ছল প্রেমধারার প্রতীক, ‘তেজ’ কবির ভাষায় দীপ্তি, প্রাণের প্রেরণাদাত্রী, ‘মরুৎ’—কবি অনুভূতিতে ‘সমীর’ একটু কল্পনাশ্রয়ী লঘু গতিসম্পন্ন, 'ব্যোম'—শূন্যমার্গে জল্পনার ফাঁদ তৈরি করায় ব্যাপৃত। এই পঞ্চ চরিত্রের সাথে কবি-দ্রষ্টা নিজে হয়েছেন ষষ্ঠ সঙ্গী। এই ছয়জনের মাধ্যমে বিচিত্র জীবন সমস্যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচিত। সরস টিপ্পনী, গভীর তত্ত্বে, দ্রষ্টার নিস্পৃহ দর্শনে এবং প্রেম-দীপ্তি ও কল্পনার গুণে রচনাটি সমৃদ্ধ।


প্রচ্ছন্ন পরিহাসরস, বক্তব্যের স্পষ্টতা, উপমা ও উপমানের অজস্রতা, ভাষার প্রসাদগুণ ও কাব্যধর্মিতা রবীন্দ্র-প্রবন্ধের কালজয়িতার স্মারক। তার প্রতিটি কথায় অনুভব করা যায় অন্তর্নিহিত রসসত্তার ধ্বনিময় প্রস্ফুটন। তাই শুধু কবি রবীন্দ্রনাথ নন, প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথও বাংলা সাহিত্যে মৃত্যুহীন কৃতিত্ব।