ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রথম প্রতিষ্ঠা, সেখানে অভিনীত নাটক সেখানকার নাট্য সমাবেশ ও গিরিশচন্দ্রের ভূমিকা এবং পরবর্তীকালে এই থিয়েটারের প্রভাব কতটা সুদূর প্রসারী হয়েছিল তা আলোচনা করো।

সৌখিন থিয়েটার বঙ্গীয় সমাজের অভিজাত সম্প্রদায় এবং স্কুল কলেজকে আশ্রয় করেছিল। কোনো অভিজাত শ্রেণির ধনীর উৎসাহে এবং অর্থানুকূল্যে তাঁর নিজ বাড়িতে বা বাগানবাড়িতে কিংবা স্কুল কলেজের শিক্ষক মহাশয়দের ইচ্ছা ও প্রেরণায় স্কুল কলেজ ভবনে মঞ্চ তৈরি করে এই অভিনয় হত। সমাজের উচ্চবিত্ত সম্প্রদায় এবং পদস্থ শ্বেতাঙ্গগণ সাধারণত এইসব অভিনয়ের দর্শক হোতেন। সমাজের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌভাগ্যবশত কেউ কেউ এ অভিনয় দেখতেন। কিন্তু নিম্নবিত্তগণের এই সমস্ত অভিনয় দেখার সুযোগ ছিল না। তাছাড়া ওই সব ধনী ব্যক্তিদের আগ্রহ মন্দীভূত হলে, মত পরিবর্তিত হলে কিংবা হঠাৎ কারও মৃত্যু হলে সখের নাট্যশালাটি বন্ধ হয়ে যেত। তাই সাধারণ মানুষদের অভিনয় দেখার জন্যে সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া, এইকালে বাংলাভাষায় বহু নাটক লেখা হয়ে গিয়েছিল। সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে লেখা নাটক এবং হাস্যরসাত্মক ফার্স-এর অভিনয় দেখার আগ্রহ সাধারণ মানুষদের মধ্যে তীব্রভাবে দেখা দিয়েছিল। এইভাবে সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে সাধারণ নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার কামনা জেগে উঠেছিল। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ধনীর খেয়ালখুশি চরিতার্থতার জন্যে নাট্যশালা প্রমোদভবন হয়ে থাকতে চাইল না। সাধারণ লোকের জীবন-সমস্যা ও কামনা-বাসনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাট্যশালা সাধারণের নাট্যশালা হতে চাইল। থিয়েটারের সাজসজ্জা, নানা সরঞ্জাম ও অভিনেতৃগণের সংসার চালনার প্রয়োজনে অর্থের প্রয়োজনও খুব বেশি। তাই থিয়েটারকে পেশাদারি করারও দরকার হয়ে পড়েছিল।


অবশেষে, বাগবাজারে কয়েকজন অর্থসম্পদহীন ঘরছাড়া যুবকের দল নাট্যাভিনয়ের প্রতি প্রাণের টানে যা করে বসলেন তার দ্বারা সাধারণ মানুষের দীর্ঘকালের চাহিদা ও অভাবপূরণ হল। 'বাগবাজারের অ্যামেচার থিয়েটার' বা সখের নাট্যশালাটি কলকাতায় 'ন্যাশানাল থিয়েটার' নাম নিয়ে প্রথম পেশাদারি নাট্যশালায় পরিণত হয়। মহড়া শুরু হল দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ' নাটকটির। অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেনঃ “নবগোপাল বসু আমাদের থিয়েটারের নাম 'The Calcutta National Theatre' রাখার প্রস্তাব দেন ; শেষে মতিবাবুর প্রস্তাবানুযায়ী 'Calcutta' টুকু বাদ দিয়ে কেবল 'The National Theatre' রাখা হয়। এই নবগোপাল হলেন হিন্দু মেলার প্রতিষ্ঠাতা এবং মতিলাল হলেন মতিলাল সুরী। তবে এদল থেকে গিরিশচন্দ্র ঘোষ বাদ পড়লেন, কারণ তাঁর আপত্তি ছিল—ন্যাশালাল নাম দিয়ে নাটকের জন্যে টিকিট বিক্রি করা চলবে না। তাই তিনি দল থেকে নিজে থেকে বাদ গিয়েছিলেন। অর্থাৎ শ্যামবাজার নাট্যসমাজে অভিনীত 'লীলাবতীর' অভিনয়ে খুব সুখ্যাতি অর্জন করায় ও অসংখ্য দর্শক সমাগমকে অব্যহত রাখতে দলের কয়েকজন নাট্যশালাটিকে স্থায়ী করতে টিকিট বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এখান থেকেই গিরিশ ঘোষের সঙ্গে শুরু হয় মতানৈক্য।


চিৎপুরে ‘ঘড়িওয়ালা বাড়ি নামে প্রসিদ্ধ মধুসূদন স্যান্যালের বৃহৎ অট্টালিকার বাইরের বাড়ির উঠোনটি মাসিক চল্লিশ টাকা ভাড়ায় রঙ্গমঞ্চ স্থাপনের জন্যে ভাড়া নেওয়া হল। মঞ্জু নির্মাণে প্রধান শিল্পী ছিলেন ধর্মদাস সুর। ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ও একাজে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি ছিলেন সেকালের বাঙালিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ organiser আর অভিনয় শিক্ষক ছিলেন অতুলনীয় অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী। ‘সুলভ সমাচার' পত্রিকায় ১৮৭২ সালের ১০ নভেম্বর অভিনয়ের কথা জানিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। বিজ্ঞাপনে কিন্তু থিয়েটারটির নাম দেওয়া হয়েছিল; 'কলকাতা ন্যাশানাল থিয়েট্রিক্যাল সোসাইটী', এই সোসাইটীর উদ্দেশ্য ছিল ; ‘রঙ্গভূমি বা রঙ্গভাষার অঙ্গপুষ্টি, টিকিটের মূল্য প্রথম শ্রেণি ১ টাকা ও দ্বিতীয় শ্রেণি আটআনা। বিজ্ঞাপনে প্রদত্ত দীর্ঘ নামটির সংক্ষিপ্ত রূপ হল—‘National Theatre' ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর শনিবার ‘ন্যাশানাল থিয়েটার' দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ' নাটকটির অভিনয় হল। এই অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রতিষ্ঠা—তাই ওই দিনটি বাংলা নাট্যশালার ইতিহাসে এক গৌরবময় দিন।


সাধারণ রঙ্গালয়ে সর্বপ্রথম নাটক ‘নীলদর্পণের’ অভিনয় যে অপূর্ব হয়েছিল তার প্রমাণ মেলে বিভিন্ন সমকালীন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে। যাইহোক—‘নীলদর্পণের’ অভিনয়ের কয়েকদিন পর অর্থাৎ ১৮৭২-এর ১৪ ডিসেম্বর ‘ন্যাশানাল থিয়েটার'-এ দীনবন্ধুর— ‘জামাই বারিক’ অভিনীত হয়। এ নাটক সম্পর্কে অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল— ‘ন্যাশানাল থিয়েটারে নীলদর্পণের অভিনয় দেখিয়া আমরা যেমন ক্রন্দন করি, গত শনিবারে জামাই বারিক দেখিয়া তেমনি হাসিয়া ছিলাম।” এরপর দীনবন্ধুর সধবার একাদশী (১৮৭২, ২৮ ডিসেম্বর) নবীনতপস্বিনী (৪.১.১৮৭৩) এবং লীলাবতী (১১.১.১৮৭৩) নাটকের অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়। এরপর অভিনীত হয় মধুসূদনের ‘কৃষ্ণক্ষ্ণকুমারী’ নাটকখানি। একখানি নাটক ছয়মাস বা একবছর অনুশীলন-শিক্ষা করে সাধারণত নাট্যশালায় অভিনীত হত। কিন্তু ন্যাশানাল থিয়েটারে প্রতি সপ্তাহে অনেক সময় যে নতুন নাটক অভিনীত হয়েছিল তার কারণ এইসময় থেকে নাট্যশালায় প্রমটার রাখার ব্যবস্থা হয়। এটি ন্যাশানাল থিয়েটারের বড়ো অবদান।


তাৎপর্য : 

১। সখের নাট্যশালায় সাধারণের প্রবেশ অবাধ ছিল না, ন্যাশানাল থিয়েটারে যে-কোনো ব্যক্তি টিকিট কিনে নাটক দেখার সুযোগ পেলেন।


২। টিকিটের মূল্য ইংরাজদের থিয়েটারের থেকে অনেক কম ছিল। তাই সাধারণ মানুষ টিকিট কিনে ঢুকতে পারতো। 


৩। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই যোগ এবং প্রবেশধিকার স্বীকৃতিও সহজ ছিল বলেই প্রধানত একে সাধারণ রঙ্গালয় বলা হয়ে থাকে। ন্যাশানাল থিয়েটার থেকে এদেশে সাধারণ রঙ্গালয়ের সুত্রপাত। 


৪। সাহেবদের বিলিতি থিয়েটারের উচ্চমূল্য, বিদেশি নাটকের পাত্রপাত্রী—কোনো কিছুর সঙ্গেই বাঙালির প্রাণের যোগ ছিল না। ন্যাশানাল থিয়েটার বাঙালির সকলের নিজস্ব থিয়েটার।


৫। ন্যাশানাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ধনী ব্যক্তির আঙিনা ভাড়া নিয়ে। ফলে সেই ধনী ব্যক্তির মালিকানা বা কর্তৃত্ব কিংবা খেয়ালখুশি একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। 


৬। একটি ভাড়া করা স্থানে, ভাড়া করা সরঞ্জাম দিয়ে অস্থায়ীভাবে তৈরি নাট্যশালায় অভিনয় হলেও কিন্তু তা ছিল নিয়মিত। সখের নাট্যশালায় এইরকম নিয়মিত অভিনয়ের ব্যবস্থা ছিল না।


৭। অভিনেতারা প্রয়োজনে কিছু অর্থ পেতেন। পেশাদারের চুক্তিগত ভাবে না হলেও অভিনেতাদের অর্থ সংগ্রহের মধ্যে পেশাদারি থিয়েটারের বীজ তৈরি হয়েছিল। 


৮। একটি সংঘবদ্ধ নাট্যদল এই থিয়েটার পরিচালনা করেছিল। ফলে ব্যক্তির আওতা থেকে থিয়েটার মুক্তি পেল।


৯। জাতীয় ভাবোদ্দীপনায় তৈরি হলেও এই থিয়েটারকে যথার্থ জাতীয় নাট্যশালা বলা যায় না। সীমাবদ্ধ অর্থে জাতীয়তার চেতনা 'ন্যাশানাল থিয়েটার' নামকরণে কার্যকরী হয়েছিল।


১০। ন্যাশানাল থিয়েটারের অভিনেতা-অভিনেত্রীগণ ও উদ্যোক্তরা পরবর্তী ২৫ বছর ধরে বাংলা থিয়েটারগুলির সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত থেকে নাট্যাভিনয়ের প্রধানতম দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলি পালন করেছে।


সর্বোপরি বলতে হয়, জাগতিক নিয়মে নাট্যোম্মাদ কিছু স্বার্থত্যাগী যুবক যে কষ্ট স্বীকার করে ন্যাশানাল থিয়েটার গড়ে তুলেছিলেন বহু মানুষের শুভেচ্ছা নিয়ে, তা নিজেদের মধ্যেকার বিবাদের ফলে একদিন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এদল ভেঙে যাওয়ার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হল— (ক) মতান্তর ও আত্মকলহ (খ) কর্তৃত্ব নিয়ে দলাদলি (গ) খ্যাতির ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে মনোমালিন্য (ঘ) ব্যক্তিত্বের সংঘাত (ঙ) নাটকের সাজসরঞ্জাম রাখার নির্দিষ্ট জায়গার অভাব (চ) অকস্মাৎ বর্ষা নেমে আসায় অভিনয় বন্ধ হয়ে যায়। অস্বীকার করার উপায় নেই শুরুরও যেমন শেষ আছে তেমনি জগতেও কোনো জিনিস বা বিষয়ের চিরস্থায়িত্ব নেই। প্রকৃতির নিয়মে তা একদিন শেষ হবেই। ন্যাশানাল থিয়েটারও অনুরূপ একদা কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। তবে যে স্মৃতিচিহ্ন সে রেখে গেছে তা যে প্রতিটি নাট্যপিপাসু বাঙালি আজীবন সহৃদয় চিত্তে গ্রহণ করবে সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।