অরণ্যের অধিকার উপন্যাসের আঞ্চলিকতা।

কোনো সাহিত্য আঞ্চলিক অভিধায় ভূষিত হতে গেলে তাকে কয়েকটি শর্ত পালন করতে হয়। প্রথমত, ভৌগোলিক সীমা সংহতি। সারাদেশ জুড়ে আঞ্চলিক উপন্যাসের পটভূমি হতে পারে না। একটা নির্দিষ্ট ভূ-প্রকৃতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য তার সীমাসংহতির মধ্যে ধরা দেবে। দ্বিতীয়ত, নির্দিষ্ট ভূ-প্রকৃতিই মানবমনের উপর সর্বাত্মক প্রভাব বিস্তার করবে, যে ভূ-প্রকৃতিকে উপজীব্য করে আঞ্চলিক উপন্যাস লিখিত হবে, সেই ভূ-প্রকৃতিই তার আশেপাশের মানুষজনের উপর সম্পূর্ণরূপে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে। তৃতীয়ত, মানুষ এবং প্রকৃতিতে সৃষ্ট হবে সুদৃঢ় বন্ধন। কেউ কারুর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না, প্রকৃতি যেমন তার মানুষজনকে চালিত করবে অনরূপ মানুষও তার আশেপাশের প্রকৃতিকে সযত্নে লালন-পালন করবে। চতুর্থত, জীবন স্বাদের অনন্য একমুখীনতা কল্পনা ও সার্বভৌমিতা আঞ্চলিক উপন্যাসের অন্য গুণ। তবে মনে রাখতে হবে, একটা নির্দিষ্ট ভূ-প্রকৃতি আঞ্চলিক উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় হলেও আঞ্চলিক গল্প উপন্যাসের পটভূমি রূপে কেবল প্রকৃতিকে চাই, একথা যথার্থ নয়, কারণ নতুন করে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চল, বন্দর, শহর-এর পটভূমি রূপে ব্যবহৃত হতে পারে তবে তার মধ্যে অবশ্যই চাই ভৌগোলিক সীমা সংহতি। চাই সেই অঞ্চলের মানব মনের উপর প্রকৃতির সর্বাত্মক প্রভাব। চাই জীবন স্বাদের একমুখীনতা, সর্বোপরি চাই সার্বভৌমিতা। সব মিলিয়ে বলা যায়—“আঞ্চলিক উপন্যাসের লক্ষ্য জীবন বোধের বিস্তার।” তবে এর জন্য চাই অঞ্চলটি সম্পর্কে ঔপন্যাসিকের দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতা ও সহানুভূতি। এরই নিরিখে আমরা দেখব মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসখানি আঞ্চলিকতার সর্থকতা দাবি করতে পারে কিনা।


মহাশ্বেতা দেবীর অরণ্যের উপন্যাসখানি গড়ে উঠেছে ছোটোনাগপুরের অরণ্যবেষ্টিত আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। সে অঞ্চলের মানুষজন শহরের আধুনিক আদব কায়দা থেকে নির্বাসিত। যাদের দু-বেলা দু-মুঠো ভাত জুটত না, কেবলমাত্র ঘাসের দানা সেদ্ধ ‘ঘাটো’ খেয়ে জীবনধারণ করত। জীবিকারূপে ছিল চাষবাস। পশুশিকার আর অরণ্যের ফলমূল আহরণ। তাদের কর্মপদ্ধতি আচার-আচরণ সমস্তই বন্য প্রকৃতির। বাইরের জগৎ থেকে তারা ছিল একেবারেই সম্পর্ক শূন্য। আপন আপন জীবন জীবিকার মধ্যে তারা ছিল সীমাবদ্ধ। কাজেই আঞ্চলিকতার বহুগুণ আলোচ্য উপন্যাসের মধ্যে নিহিত—স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা থাকে না।


অরণ্যের অধিকারের দাবি নিয়ে আদিবাসী উপজাতি মুণ্ডাদের নেতা বীরসা মুণ্ডার ১৮৯৫–১৯০০ খ্রি. তৎকালীন ইংরাজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা আলোচ্য উপন্যাসের পটভূমি রূপে স্থাপন করেছেন লেখিকা। ফলে এ উপন্যাসে ঐতিহাসিক উপাদান থাকার জন্য ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা গেলেও এর মধ্যে আঞ্চলিকতার উপাদান কোথায় তা স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে। এতে আঞ্চলিকতার সন্ধান করতে যাওয়া কেমন যেন অস্বাভাবিক ও অবান্তর। এ প্রশ্নের একটা সারসত্য থাকলেও তবু বলতে হয় কেবলমাত্র সাম্প্রতিক কালের সামাজিক সীমাসংহতির পটভূমি আঞ্চলিক উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয় হলেও ইতিহাসের বিষয়কে আহরণ করে লেখক যদি সেই সময়কার হুবহু বাস্তবচিত্র, অর্থাৎ তার সমাজ, সংস্কার, কৃষ্টি, সংস্কৃতি যাবতীয় বিষয় সত্যরূপে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়, এবং আঞ্চলিকতার যাবতীয় সত্য পূরণে অগ্রণী ভূমিকা নেন তা হলে সেই রচনা ঐতিহাসিক হয়েও আঞ্চলিকতার দাবি করতে পারে। মহাশ্বেতা দেবীর অরণ্যের অধিকার উপন্যাসখানিতে তেমনই যুক্তি পোষণ করা চলে। মুণ্ডাদের জীবনচর্চা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে কীরূপ ছিল তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা আলোচ্য গ্রন্থে সুন্দরভাবে বিশ্লেষিত। মুণ্ডাদের সামাজিক ব্যবস্থা কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য চমৎকারভাবে লেখিকা তুলে ধরেছেন। কাজেই ‘অরণ্যের অধিকার’ বিশেষ রূপে আঞ্চলিকতার দাবি করতে পারে।


আঞ্চলিক উপন্যাসের একটা বড়ো বৈশিষ্ট হল মানুষজনের কথাবার্তায় ফুটে উঠবে আঞ্চলিকতার ধারা, যেভাব একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী দ্বারা প্রভাবিত। 'অরণ্যের অধিকার’ যেহেতু মুণ্ডাদের বিদ্রোহকে উপজীব্য করে গঠিত, সেইহেতু এই মুণ্ডাদের ভাষা যাকে বলা হয় মুণ্ডারী ভাষা তা হুবহু তাদের সংলাপের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, বীরসা তার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন সম্পর্কে মাসি জোনিকে বলেছে—


“মারে বোরা ভরালবন এনে দিব, খুঁচি ভরা চাল আর দানা।

–তুই কি ডাকাত হবি?

–প্রচারক হব।

–কেমন করে ?

–পাটশালে পড়ে।

–আর কি করবি ?

–তোর গাই চরায়ে দিব, বেড়া বেঁধে দিব, কাঠ এনে দিব।”


এখানে বীরসার সংলাপের মধ্যে স্পষ্টতই ফুটে উঠেছে ঝাড়খণ্ডী অঞ্চলের উপভাষার বৈশিষ্ট্য। আর এক স্থানে আছে বীরসা জেল থেকে ছাড়া পাবার পর যে সমস্ত মুণ্ডারা মিশনে ছিল তারা স্বগ্রামে ফিরে আসার আনন্দে মেতে উঠেছে। তারা মিশনের পলুস প্রচারকে বলেছে—


“আর তোর গির্জা যাব না, যা তুই। ভগবান এসে গিয়াছে। 

–মিশনের সাহেবরা তোমাদের খাওয়ায় নাই আকালে?

–খাওয়ালে কী হয়াছে?

–তোরা আমাদের বিপদে ফেলালি।

–বিপদে তুই নিজেরে ফেলছিস যখন ভগবানের ধরা করাতে গিয়াছিলি।


এসমস্ত সংলাপে একটা বিশিষ্ট অঞ্চলের ভাবধারা ফুটে উঠেছে। ভাষাতত্ত্বের বিচারে এভাষা হল ঝাড়খণ্ডী উপভাষা। এই আদিবাসী ভাষাকে লেখিকা অত্যন্ত সুচারুভাবে উপন্যাসে প্রয়োগ করে, আঞ্চলিকতার বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে জয়যুক্ত করেছেন।


এ উপন্যাসে এক নির্দিষ্ট উপজাতি মুণ্ডাদের সামাজিক রীতিনীতি বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রকাশ পেয়েছে। যা তাদের সামাজিক ধর্ম সংস্কৃতির অঙ্গস্বরূপ। মুণ্ডাদের লোকাচার ও ধর্মীয় আচার-আচরণের কয়েকটি দিক হল—হোলিতে 'জাপি' গান ও নাচ, শিকার করতে যাওয়া, পৌষ পুর্ণিমায় ‘মাগে' উৎসব পালন, শাল গাছে ফুল ফুটলে ‘বা পরবে’ মেয়েরা মাথায় ফুল দিয়ে নাচত। 'করম' পূজায় নাচ হত। নাত হত ‘পাইকা'-তেও এছাড়া মেয়েদের ফুল পরা, পুরুষদের মাথায় কাঁকই গোঁজা, কানে গহনা পরার লোকাচার তারা পালন করত। কিন্তু বীরসা দেবতা রূপে মুণ্ডারী সমাজে সম্মানিত হওয়ার পর মুণ্ডাদের এই সংস্কৃতি লোকাচার অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল। তবে উপন্যাসের মধ্যে মুণ্ডাদের নিজস্ব কৃষ্টি সংস্কৃতি নিখুঁতভাবে আলোচিত হওয়ায় এটি বিশেষ রূপে আঞ্চলিক অভিধায় ভূষিত।


ভৌগোলিক সীমা সংহতি হল আঞ্চলিক উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই উপন্যাসখানিও এই বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল, উপন্যাসের স্থান কাল পাত্রে পাওয়া যায়—ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে অরণ্য পার্বত্য অঞ্চলে ছোটোনাগপুরের আদিবাসী মুণ্ডাদের জীবন প্রণালী হুবহু উঠে এসেে এ উপন্যাসে। ছোটোনাগপুরের বিস্তৃত বনভূমি, পাহাড়, পর্বত, নদনদী, বিভিন্ন আদিবাসী গ্রাম যেমন মুন্‌টি, কদগাঁও, বোর্তেদি, সেনত্রা, সৈলরাকাব, ডুরান্ডা প্রভৃতি এ উপন্যাসে পটভূমি রচনা করেছে। এর বাইরের কোনো স্থান বা ঘটনা এ উপন্যাসে প্রবেশ করেনি। তাদের গ্রাম পরিবেশেই তারা তাদের ভাবধারা বিকশিত করেছিল। অর্থাৎ নির্দিষ্ট অঞ্চলের সীমা সংহতিতে নির্দিষ্ট জাতি মুণ্ডাদের জীবনের আচার-আচরণ কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি সমস্তই উপন্যাসের মধ্যে নিখুঁত রূপে প্রতিফলিত হওয়ায় ‘অরণ্যের অধিকার কে আঞ্চলিক রূপে গণ্য করা চলে।


তবে 'অরণ্যের অধিকার' যতই আঞ্চলিক ভাবধারায় পরিপুষ্টতা অর্জন করুক না কেন এটি নিখুঁত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ আঞ্চলিক উপন্যাস নয়। আমাদের ভুললে চলবেনা এ উপন্যাসের মূল লক্ষ্য কেন্দ্রীয় বিষয় হল বিদ্রোহ, স্বাধীকারের দাবিতে মুণ্ডারা ইংরাজ সরকারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ বিশেষত বীরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে যে উলগুলানের ডাক দিয়েছিল তার শুরু এবং শেষ পরিণতি পাঠককে আকৃষ্ট করে। কেউ ভুলেও মুণ্ডাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক সম্পর্কে বিষদ জানার আগ্রহ প্রকাশ করেনি। একটা নিপীড়িত জাতি ইংরাজ সরকারের রোষে কীভাবে নিঃশোষিত হতে বসেছিল, কীভাবে বিদ্রোহের ডাক দিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিল তার রক্তক্ষয়ী ইতিহাস জানতে পাঠক উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করে। উপন্যাস পড়তে পড়তে পাঠক ক্ষণিকের জন্য ভুলেই যায় এটি উপন্যাস না ইতিহাস। কাজেই যে আখ্যান মধ্যে ঐতিহাসিক রসস্ফুরণের জন্য মহিমময় স্থানে উন্নীত হয় তাতে আঞ্চলিকতার স্পর্শ অনুভব করা কল্পনা মাত্র। তা সত্ত্বেও আলোচ্য উপন্যাসখানি যে অনেকাংশেই আঞ্চলিক লক্ষণাক্রান্ত হয়ে পড়েছে তা অতি বড়ো বিজ্ঞ পাঠক সমালোচকও অস্বীকার করতে পারবে না।