বাংলা কাব্যসাহিত্যে কবি রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১ খ্ৰীঃ-১৯৪১ খ্ৰীঃ)

বাংলা কাব্যে কবি রবীন্দ্রনাথ


সত্যোচ্চারণ করেছিলেন মনস্পতি রবীন্দ্রনাথ— “একটি মাত্র পরিচয় আমার আছে সে আর কিছুই নয়, আমি কবি মাত্র”। বাস্তবিক সাহিত্যের সর্বশাখায় তার নির্বাধ এবং বিস্ময়কর পদচারণা। তবু তাঁর একমাত্র পরিচয় তিনি কবি। এমনকি তিনি স্বয়ং একটি কাব্য। শৈশবকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানবজীবনের “কান্না হাসির দোলদোলানো পৌষ ফাগুনের পালা” রচনা করে তিনি বিশ্বসাহিত্যের সূচীপত্র এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বরূপে দেদীপ্যমান। সর্বভূমিতে তার বিচরণ, সর্বক্ষেত্রে তার ব্যাপ্তি, দেশে তাঁর অধিষ্ঠান; সর্বমানবের আস্বাদে ও আকুলতায় তার শিল্পীসত্তার বিকাশ, সর্বজনের অস্তরে এই “সার্বভৌম কবি”র অধিকার। চসার সম্বন্ধে ড্রাইডেনের অনশ্বর মন্তব্যটি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও প্রযোজ্য— 'tis sufficient to say, according to the proverb; that here is God's plenty' I


রবীন্দ্রনাথের কাব্যের পর্ব-বিভাগ:

(ক) কৈশোর পর্ব (১৮৭৮-১৮৮১ খ্ৰীঃ) : ‘দ্বাদশ বর্ষীয় বালক রচিত অভিলাষ’ (১২৮১ বঙ্গাব্দের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় মুদ্রিত), ‘পৃথ্বীরাজ পরাজয়' নামে বীররসাত্মক কাব্য, “হিন্দু মেলার উপহার' (১৮৭৫ খ্রীস্টাব্দে অনুষ্ঠিত হিন্দুমেলা উপলক্ষে রচিত)।


(খ) উন্মেষ পর্ব (১৮৮২-১৮৮৬ খ্রীঃ) : ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত' (১৮৮২), ‘প্রভাতসঙ্গীত’ (১৮৮৩), 'ছবি ও গান' (১৮৮৪), 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' (১৮৮৪), ‘কড়ি ও কোমল’ (১৮৮৬)।


(গ) ঐশ্বর্য পর্ব (১৮৯০-১৮৯৬ খ্রীঃ) : 'মানসী' (১৮৯০), 'সোনার তরী' (১৮৯৪) ‘চিত্রা’ (১৮৯৬), 'চৈতালী' (১৮৯৬)।


(ঘ) ভাবনা পর্ব (১৯০০-১৯১০ খ্রীঃ) : ‘কণিকা’ (১৯০০), ‘কথা ও কাহিনী' (১৯০০), ‘কল্পনা' (১৯০০), 'ক্ষণিকা' (১৯০০), 'নৈবেদ্য' (১৯০২), 'স্মরণ' (১৯০২-১৯০৩), 'শিশু' (১৯০৩), 'উৎসর্গ' (১৯০৩-১৯০৪), 'খেয়া' (১৯১০)।


(ঙ) অন্তর্মুখী পর্ব (১৯১১-১৯১৫ খ্রীঃ) : 'গীতাঞ্জলি' (১৯১১), ‘গীতিমাল্য’ (১৯১৪), 'গীতালী' (১৯১৫)।


(চ) বলাকা পর্ব (১৯১৬-১৯২৯ খ্রীঃ) : 'বলাকা' (১৯১৬), 'পলাতকা' (১৯১৮), ‘শিশু ভোলানাথ’ (১৯২২), 'পূরবী' (১৯২৫), 'লেখন' (১৯২৭), ‘মহুয়া’ (১৯২৯)।


(ছ) অস্তরাগ পর্ব (১৯৩০-১৯৪১ খ্রীঃ) : ‘বনবাণী' (১৯৩১), ‘পরিশেষ’ (১৯৩২), ‘পুনশ্চ' (১৯৩২), 'বিচিত্রা' (১৯৩৩), ‘শেষ সপ্তক' (১৯৩৫), ‘বীথিকা’ (১৯৩৫), ‘পত্রপূট’ (১৯৩৬), 'শ্যামলী’ (১৯৩৬)।


(জ) গোধূলি-পর্যায়ের কাব্য : ‘প্রাস্তিক’ (১৯৩৮), ‘সেঁজুতি' (১৯৩৮), ‘প্রহাসিনী’ (১৯৩৮), ‘আকাশপ্রদীপ’ (১৯৩৯), ‘নবজাতক' (১৯৪০), ‘সানাই' (১৯৪০), ‘রোগশয্যায়’ (১৯৪০), ‘আরোগ্য’ (১৯৪১), 'জন্মদিনে' (১৯৪১), ‘শেষলেখা’ (১৯৪১)।


(ঝ) লঘু হাস্য-পরিহাসমূলক কাব্য : ‘খাপছাড়া’ (১৯৩৭), 'ছড়ার ছবি’ (১৯৩৭), এবং অনেকগুলি গান এই পর্বে রচিত হয়।


বহুধা কীর্তির দীপ্তিতে রবীন্দ্র-কাব্যের জগৎ পরিপূর্ণ। অনুভূতির সর্ববিধ প্রকাশে এবং বিশ্ববীক্ষার শক্তিতে তার বিচিত্র সৃষ্টি সমুজ্জ্বল। তাই ১৯৫৭ সালে “রবীন্দ্রনাথের কোন লেখা অভিভূত করেছিল” প্রশ্নের উত্তরে বিষ্ণু দের বিস্ময় প্রকাশ সম্ভবত সমস্ত রবীন্দ্রানুরাগী পাঠকচিত্তেরও অনুক্ত জিজ্ঞাসা

“এ যেন বা জিজ্ঞাসা সূর্যের

কোন্‌ ক্ষণ ভালো লাগে সারাদিন প্রহরে প্রহরে।

কিম্বা কবে কোন্ দিন ঋতুতে বৎসরে

সূর্যের কি গান ভালো লেগেছিল প্রকাশ্য-ঊহ্যের

মধ্যাহ্নে ঊষার স্বচ্ছ বৈকালীতে সন্ধ্যায় করুণ।”


উন্মেষ পর্বের ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’, ‘প্রভাতসঙ্গীত’, ‘ছবি ও গান’, ‘কড়ি ও কোমল', থেকে শেষ পর্বের ‘রোগশয্যায়-আরোগ্য-জন্মদিনে' পর্যন্ত রূপ থেকে অরূপে সীমা থেকে অসীমে প্রবেশের কি বিচিত্রসুন্দর ঋতুবদলের ইতিহাস! ‘প্রভাতসঙ্গীতে’ কবির নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হওয়ায় সূচনা—“হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি / জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি।” ‘কড়ি ও কোমল' কাব্যে তিনি কবি-যশঃ প্রার্থিত্ব থেকে যশস্বিতার ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার কথা ভেবেছেন। তার কণ্ঠে তাই শোনা যায় : “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে / মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।” জীবন-রঙ্গভূমিতে প্রিয়জনের মৃত্যুব্যথার চকিত আবির্ভাবে কবির আনন্দানুভবের ‘কড়ি'র মধ্যে বেদনার ‘কোমল’ ভাব প্রকাশিত।


পরবর্তী পর্বে রবীন্দ্র-কাব্যের স্বর্ণযুগ সৃজিত—'মানসী', 'সোনার তরী’, ‘চিত্রা’, ‘চৈতালী’। এখানে কবি সৌন্দর্য, নিসর্গ ও মানবপ্রেম সাগরে অভিস্নাত। প্রকৃতি-সম্ভোগ, পার্থিব জীবনের ভোগ-প্রাচুর্যের মধ্যে এক অজ্ঞাত অভাববোধ ও মানবীয় প্রেমের বিবিধ ব্যঞ্জনায় 'মানসী'-র ‘মেঘদূত’, ‘অহল্যার প্রতি’, ‘বধূ’, প্রভৃতি কবিতা বিশুদ্ধ সৌন্দর্য রস-সম্ভোগের পরিচয় দেয়।


মানবপ্রেমের কল্যাণ-স্নিগ্ধ ভাবনা কবিকণ্ঠে উচ্চারিত হয় : “ভালবাস, প্রেমে হও বলী/চেও না তাহারে।” মানুষের প্রতি ভালোবাসা এই পর্বের সম্পদ। 'দুই বিঘা জমি' কবিতায় একদিকে আছে বঞ্চিত উপেনের প্রতি সহানুভূতি, অপরদিকে অত্যাচারী জমিদারের প্রতি ক্রোধাক্ত ঘৃণা। ‘সোনার তরী’ অভিহিত বহুখ্যাত কবিতাটিতে তত্ত্বের দিক অবশ্য স্বীকার্য, কিন্তু ছন্দের মধুরিমা আর ‘ভরা নদী ক্ষুরধারা খর পরশা’র চিত্ররসকেই পর্যাপ্ত ব’লে মনে হয়। তাঁর কাব্যজীবনের অচঞ্চল উপাদানরূপে জগতের প্রতি আসক্তি এখানে বিদ্যমান। বাংলাদেশের আলো-হাওয়ার বিশিষ্ট মাধুর্য ও সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির মধ্যেই যেন প্রচ্ছন্ন বিপুল অনাসক্তির সুর সম্বন্ধে আগ্রহ, তার শিল্পসিদ্ধ উদাহরণে ‘সোনার তরী’ ভরপুর।


'চিত্রা' কাব্যের ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় আছে বাস্তব মানবপ্রীতি। এখানে দুঃখ-দুর্যোগপূর্ণ অবস্থার মধ্য দিয়ে বিশেষ পরিণামের পথে যাত্রার বাসনা অভিব্যক্ত। এ কাব্যের ‘জীবন দেবতা' কবি-জীবনের কর্ণধার রূপে বন্দিত। সৌন্দর্যের ভাবমূর্তি ‘ঊর্বশী’ কবিতাটি“সুরসভাতলে যবে নৃত্য কর পুলকে উল্লসি / বিলোল হিল্লোল ঊর্বশী / ছন্দে ছন্দে নাচি উঠি সিন্ধুমাঝে তরঙ্গের দল,/শস্যশীর্ষে কাপি উঠে ধরার অঞ্চল/তব স্তনহার হতে নভতলে খসি পড়ে তারা”।


‘চৈতালী’-র প্রথম কবিতা “আজি মোর দ্রাক্ষাকুঞ্জ বনে ধরিয়াছে ফল” স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে জানা যায় যে পূর্ববর্তী কাব্যের ভাবোচ্ছ্বাস এখানে নেই, পরিবর্তে আছে স্তব্ধ স্থাপত্যের দীপ্তি। এখানে রবি-কবি কালিদাসের জগতে ফিরে গেলেও বঙ্গমাতার প্রতি তার অনুযোগ : “সাত কোটি সস্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী / রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করনি।” নিবিড় প্রকৃতিপ্রেম ও সৌন্দর্যের ধ্যানে মগ্ন থাকলেও মানুষের সংসার-তীরের প্রতি তাঁর অনুরাগ অসীম। ভাবের নভোচারিতা, ভাষার উদ্বেলতা এখানে যেন শাস্ত সংহতির পরিচ্ছদে আচ্ছাদিত। কবি-কল্পনা এর পরে জীবলোকের মধ্যস্থলে প্রবেশ রত। ‘কল্পনা’য় ভাষার কারুকার্য আর ভাবের প্রসাধন কলার মধ্য দিয়ে মহাকবির স্বাক্ষর যেন স্পষ্ট। “দূরে বহুদূরে স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে” তিনি চলেছেন “পূর্বজনমের প্রথম প্রিয়ারে” খুঁজতে। “ঈশানের পুঞ্জ মেঘ অন্ধবেগে ধেয়ে চলে আসে, বাধাবন্ধহারা”— এই উদাত্ত শব্দৈশ্বর্যে সমৃদ্ধ বহুখ্যাত ‘বর্ষশেষ' কবিতা Shelley-র 'Odd to the West Wind'-এর মতই কালজয়ী। আমাদের এই সহস্রমনা কবি যে ভারতবর্ষের প্রাচীন বিশাল পটভূমির সংখ্যাহীন আহ্বানে মুগ্ধবিবশ, ১৩০৪ থেকে ১৩০৬ সনে লেখা 'কথা ও কাহিনী’র পাতায় পাই তারই পরিচয়। ছন্দের ছটায়, সুরের সিদ্ধিতে, ভাবের বৈভবে এই পর্বে যেন কবিমনের গহনে কাব্যশতদল উন্মিলিত।


‘ক্ষণিকা-নৈবেদ্য-উৎসর্গ-শিশু-স্মরণ’ নিয়ে ভাবনা-পর্ব রচিত। 'ক্ষণিকা’য় নৃত্যময়, গীতিকাব্যের চূড়ান্ত প্রকাশ। “নদীজলে-পড়া আলোর মতন ছুটে যা ঝলকে ঝলকে”, তাকে কবি কথার চিকন জালে বাঁধতে উৎসুক। “জীবনদেবতা”-কে নিয়ে ভাবনা প্রায় কোথাও নেই, কল্পলোকের সন্ধানেও কবি ব্যস্ত নন, “যেমন আছে তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ” ব’লে লোকালয়ে ঢুকে, একেবারে বাংলার মাটি ছোঁওয়া আর সংস্কৃতের বাঁধন ছিঁড়ে পালিয়ে যাওয়া ভাষায় এই কাব্য লেখা। দেশের ঐতিহ্যের ধ্যানগম্ভীর ধারায় অবগাহন করে 'নৈবেদ্য'র ডালা সাজানো। পতিত ভারতবর্ষের জন্য “পুনর্বার সেই প্রজ্ঞালোকিত, নির্মল নির্ভয় জ্যোতির্ময় দিন” তার আকাঙ্ক্ষিত। “তোমার নিখিলপ্লাবী আনন্দ আলোক / হয়তো লুকায়ে আছে পূর্ব সিন্ধু তীরে।” তিনি বললেন সেই ‘স্বর্গের’ কথা : “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত”। অখণ্ড সত্যের জন্য কবির আকুলতা প্রকাশ পেল পরিপূর্ণ সাধনায় : “বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়। অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ।” জন-গণেশের “বেদনার ডোরে, বাসনার টানে” কবি বন্দনায় ব্যাপৃত, আবার সাম্রাজ্যবাদের বিকার তাঁর কাছে লাঞ্ছিত। ‘উৎসর্গে’ আছে কবির আনন্দ, শুদ্ধ রসোপলব্ধির প্রতি আগ্রহ। সীমার মধ্যে অসীমের সুর শুনে যিনি আত্মস্থ তিনি কিন্তু ‘শিশু' লিখতে বসে Wordsworth-এর মত 'intimations of imortality' না গুণে খোকার গায়ের কচি কোমলতা খুঁজে পেলেন “মা যবে ছিল কিশোরী মেয়ে / করুণ তার পরাণ চেয়ে / মাধুরী যবে মূরছি ছিল....।”


বঙ্গভারতীর চিরস্মরণীয় সম্পদ ‘খেয়া-গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতালি’। ‘খেয়া’তে ব্যক্তিগত জীবনের বেদনা আর ক্লান্তি লক্ষণীয়। বিশ্ববিজয়ী ‘গীতাঞ্জলি’-তে বিষাদ থাকলেও আনন্দসঙ্গীতই এর ধ্রুবপদ : “জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ / ধন্য হোল ধন্য হোল মানবজীবন”। তিনি দেখিয়েছেন দেবতা মন্দিরে নেই—“তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙ্গে / করছে চাষা চাষ / পাথর ভেঙ্গে কাটছে যেথায় পথ / খাটছে বারোমাস।” ‘গীতালি’তে কবি “দুঃখ-সুখের ঢেউখেলানো এই সাগরের তীরে” ফিরতে উৎসুক, “বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় ভূমি”-ই তার কাছে হয়ে উঠেছে স্বর্গভূমি।


চিরচঞ্চল কবি পঞ্চাশোর্ধে ‘বনং ব্রজেৎ’ উপদেশ উপেক্ষা করে 'বলাকা' কাব্যে নূতন জয়যাত্রার বন্দনায় মুখর হলেন। ‘বলাকা’য় আছে গতিবেগের অবিস্মরণীয় জয়গান । যার আরম্ভ ও অবসান দুই-ই বৈশাখের নবারম্ভের জ্বলন্ত গতিতে। কবি ‘মৃত্যুর গুপ্তপ্রেমে’ ঘরের কোণে আবদ্ধ থাকতে নারাজ। জরাসন্ধের জরাবন্ধন দুর্গ ভেঙ্গে চূর্ণ করে তিনি চিরযৌবনকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। মৃত্যু সুনিশ্চিত জেনেও সত্যসন্ধ মানুষটির স্বীকারোক্তিঃ “ভালবাসিয়াছি এই জগতের আলো জীবনেরে তাই বাসি ভালো।” প্রশ্ন করেছেন : “বীরের এ রক্তস্রোত। মাতার এ অশ্রুধারা / এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা /....রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন?” গতি ও বিরতি, মুখরতা ও মৌনতা, সংগ্রাম ও শাস্তি, যেন ‘বলাকার’ মায়াজালে বদ্ধ। মহাকবিত্বের যদি কোন পরীক্ষা থাকে তাহলে ‘বলাকা’র সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তা উত্তীর্ণ করে বহুদূরে চলে গেছেন।


পরবর্তী পর্যায়ের কাব্যগুচ্ছ ‘পূরবী-মহুয়া-বনবানী পরিশেষ'। 'পূরবী'তে আছে আসন্ন বিদায়ের সুর মূৰ্চ্ছনা “বাজে পুরবীর ছন্দে রবির শেষ রাগিণীর বীণ”। ‘মহুয়ায়’ আবার নরনারীর দেহভাবনা বিনির্ভর বীর্যদীপ্ত প্রেমকল্পনা হয়েছে সুস্পষ্ট। 'বনবানী'তে নিসর্গের অনন্যসাধারণ আলপনা পরিস্ফুট। 'পরিশেষ' কাব্য যেন অনেকটা পূর্বধারারই অনুবৃত্তি।

‘পুনশ্চ-শেষসপ্তক-পত্রপুট-শ্যামলী' কাব্যের জগতে যেন বিপ্লবের বহ্নিপাত। নূতন গদ্যছন্দে সহজ অথচ সুগভীর কবিতামালা এখানে বিধৃত। 'সর্বব্যাপী সামান্যর স্পর্শ' শুধু নয়, অধ্যাত্ম-জিজ্ঞাসা ও আত্মবিশ্লেষণে এই পর্ব দ্বিতীয়রহিত মহিমায় বাঙ্ময়।


জীবনের শেষ পর্বেও রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিকার্যে অক্লাস্ত। 'প্রান্তিক সেঁজুতি-আকাশপ্রদীপ নবজাতক-রোগশয্যায়-আরোগ্য এবং জন্মদিনে' কাব্যে একদিকে ফুটে উঠেছে রোগ যন্ত্রণার বেদনা, অপরদিকে অপূর্ব মহিমায় উদ্ভাসিত কবির নিবিড় মানবপ্রীতি। বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে কবির অনিশেষ ঘৃণা। জীবনসায়াহ্নেও কবি তাদের চিন্তায় বেদনাবিবশ, যারা “চিরকাল টানে দাঁড় ধরে থাকে হাল”, যারা “মাঠে মাঠে বীজ বোনে পাকা ধান কাটে”, যারা “কাজ করে নগরে ও প্রান্তরে”। নবযুগের প্রলেতারিয় কবি, যারা “কৃষাণের জীবনের শরিক” তাদের তিনি আহ্বানে আগ্রহী। শেষ বিদায়ের আগে শোনা যায় ঋষির মতোই বিশ্বন্ধর মহাকবির উচ্চারণ

“এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি

অন্তরে নিয়েছি আমি তুলি

এই মহামন্ত্রখানি চরিতার্থ জীবনের বাণী।”


ব্যাপ্তির উত্তরণ পর্বে এমন মহীরূহ ঐশ্বর্য বিশ্বসাহিত্যেও দুর্লভ, গ্যেটে বা হুগোতেও বিরলদৃষ্ট। রবীন্দ্র-ব্যক্তিত্ব অতুলনীয়। নিঃসঙ্গ কবির অবিরাম অভিযান ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। অসামান্য লিখনশক্তি, চারিত্র্যের অপূর্ব সাধনা আর দীর্ঘ আয়ুর একত্র সন্নিবেশে তিনি দোসরহীন। তাঁর কথা চিন্তা করে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সত্যোচ্চারণ

“যে ভাবই ওঠে প্রাণের মাঝে, 

তোমার গানে সকলই আছে”


কনিষ্ঠ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেন

“এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে, 

তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে।”


তার সুদীর্ঘ জীবন স্মরণ করে একালের শ্রেষ্ঠ কবি বিষ্ণু দে প্রার্থনা জানান

আমাদের ক্ষীয়মান মানসে ছড়াও

সূর্যোদয় সূর্যাস্তে আশি বছরের আলো,

বহুধা কীর্তিতে শত শিল্পকর্মে উন্মুক্ত উধাও

তোমার কীর্তিতে আর তোমাতে যা দিকে দিকে একাগ্র মহৎ।”

বাস্তবিক, রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যকালের প্রেরণা।