রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি গল্পটিকে লিরিকধর্মী গল্প হিসাবে গ্রহণ করা যায় কিনা আলোচনা করো।

রবীন্দ্রনাথ প্রথমত ও প্রধানত কবি। তাঁর ছোটোগল্পগুলির জন্ম কবিসত্তার অঙ্কুর থেকে। প্রকৃতির রূপমুগ্ধ কবি শিলাইদহ সংলগ্ন উদার প্রকৃতির মধ্যে পরম আনন্দে অবগাহন করেছিলেন। সেই পর্বে গ্রামীণ জীবনের হাসিকান্না উল্লাস বেদনায় ভরা জীবনের অনেক অসঙ্গতি ও বিরূপতা দেখেছিলেন আর তখনই তাঁর চির রোমান্টিক কবি মন এই সব বস্তুগত যন্ত্রণা থেকে বারবার মুক্তির পথ খুঁজেছে। প্রথম যুগের গল্পে পদ্মার স্রোত-প্রবাহ ও নীল আকাশের উদারতায় ঘেরা প্রকৃতিই ছিল রবীন্দ্রনাথের কাছে মুক্তিপথের ইশারা। তাই বস্তুধর্মী জীবন সংকটে ঘেরা মানুষের দুঃখ সুখের স্বপ্ন নিয়ে গল্প লিখতে লিখতে তার কবিমন এবং মেটাফিজিক্যাল স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে। দেশ কালের সীমানা অতিক্রম করে ছোটোগল্পের নির্দিষ্ট চরিত্র ও আখ্যান বিশ্বপ্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।


‘একরাত্রি’ গল্পটি সেই আত্মসমর্পণের এক অপরূপ ব্যঞ্জনামণ্ডিত নিদর্শন। গল্পটির পাঠ শেষে অনুরণিত হতে থাকে এক অপূর্ব মূৰ্চ্ছনা। নিটোল কাহিনি বৃত্ত রচনার পরিবর্তে একটি ভাব বা অনুভূতিকে কেন্দ্র করে এই আবহধর্মী গল্পটি গড়ে উঠেছে। নায়কের বিশেষ বেদনার অনুভূতিতেই গল্পের সূচনা ও সমাপ্তি। শেষ ১১টি অনুচ্ছেদেই প্রকৃতি ও জীবনের মেলবন্ধনে এক প্রলয় রাত্রির পরিবেশে অমৃত আস্বাদের আনন্দ উচ্চারিত হয়েছে। উপলব্ধির ব্যঞ্জনায় ক্ষণকাল রূপান্তরিত হয়েছে চিরকাল—এ। এ গল্পের প্রথমাংশে নায়কের স্বগতোক্তি স্মৃতিচারণায় উনিশ শতকের গ্রামীণ বাস্তব জীবনের টুকরো টুকরো ছবি, ব্যক্তিজীবনের অসহায়তা যথাযথভাবে ফুটে উঠলেও শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত আবেগের এক সুরলহরী সংগীতের মতো ধ্বনিত হয়েছে। প্রলয় রাত্রির ভয়ংকর সুন্দর মাধুর্যই সংক্ষিপ্ত সংহত বর্ণনায় গীতিকবিতার মতই ব্যঞ্জনাধর্মী হয়েছে। সব কিছুকে অতিক্রম করে কাব্যধর্মিতা গল্পটিকে লিরিক আবেদনে পরিপূর্ণ করেছে। এই গল্পের নায়ক অতিসাধারণ সেকেন্ড মাস্টার। জীবনের প্রথম অংশে স্বপ্ন ও আদর্শের বশবর্তী হয়ে সুরবালার প্রেমকে উপেক্ষা করেছিল। বহুকাল পরেই আবার হৃদয়ে প্রেমের জাগরণ ঘটলেও তা সমাজ নীতি ও ধর্মের দ্বন্দ্বে ক্ষত বিক্ষত। অন্তরাত্মা দুর্বার হয়ে ছুটে যেতে চায় প্রেমিকার উদ্দেশে। কিন্তু পার্থিব প্রেমের বাসনা রঙিন উচ্ছ্বাস সংহত শান্তিতে অমৃত আস্বাদ জাগিয়েছে। তখন সুরবালাকে আর হারানোর বেদনা নেই। কারণ তার চেয়ে মহত্তর উপলব্ধি তাকে পরিপূর্ণ করে তুলেছে। প্রকৃতিও লিরিক ধর্মিতার আধিপত্য গল্পটিকে কবিতার কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছে। মন যখন এমন পূর্ণতায় সমৃদ্ধ হয় তখন সমাজ সংসার জীবনের কলরব সবই মিথ্যা হয়ে যায়। সেকেন্ড মাস্টারের জীবনের দৃঢ়তা, ব্যর্থতা-বোধ সবকিছু ছাপিয়ে গল্পের পরিণামে এক নৈঃশব্দ অখণ্ড অনন্ত উপলব্ধি জাগিয়েছে। এ অংশে গদ্য পঙক্তি অন্তর্লীন গতিপ্রবাহে ছন্দ স্পন্দনে প্রায় কবিতা হয়ে উঠেছে–“রাত্রি প্রায় শেষ হইয়া আসিল, ঝড় থামিয়া গেল, জল নামিয়া গেল। সুরবালা কোনও কথা না বলিয়া বাড়ি চলিয়া গেল। আমিও কোনও কথা না বলিয়া আমার ঘরে গেলাম। জন্ম নিল দেহ রতিহীন এক বিশুদ্ধ নিটোল প্রেম। সুরবালা হয়ে উঠল মানসলোকের অবলম্বন অনন্ত রূপিণী। পার্থিব জীবনের নানাবিধ অচরিতার্থতা মাৎসনি গ্যারিবন্দ্বী হবার দুরাশায় ছুটে ব্যর্থ হতাশা পীড়িত নায়ক সুরবালাকে হঠাৎ আবিষ্কার করেছে। আর অন্তরে বেজেছে চুড়ির টুংটাং । শাড়ির খসখস শব্দ জাগিয়েছে এক অজানা শিহরণ। এই ধ্বনি ঝংকার যথার্থই লিরিক ব্যঞ্জনা যা গীতি-কবিতার অঙ্গীভূত। গল্পের পরিণাম প্রকৃতির ভয়ংকর সুন্দর প্রলয়কালের ঝড়ের উদ্দামতা ও মৃত্যুস্রোতের বিশেষ উপলব্ধি অনুভূত করিয়েছে। “আমার সমস্ত ইহজীবনে কেবল ক্ষণকালের জন্য অনন্ত রাত্রির উদয় হইয়াছিল। আর এই একরাত্রে মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়াইয়া অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পাইয়াছি।" নায়কের অপূর্ণ জীবন হয়ে উঠেছে অমৃত সুখে পূর্ণ মধুময়।


এ গল্পের সাথে অনেকে চেকভের লেখা গল্পের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় আলফ্রাস দোদের লেখা গল্পের মধ্যে ভার-ঐক্য দেখেছেন। উক্ত গল্পেই একরাত্রি গল্পের মতই প্রেম বিমূর্ত বা abstract হয়ে নায়কের মনে সৃষ্টি করেছে এক অনাস্বাদিত অপরূপ সৌন্দর্য মহিমা। আসলে রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তা রোমান্টিকতার মুক্তিসন্ধান রূপে একরাত্রি গল্পে মানুষ ও প্রকৃতিকে অপার্থিব করে তুলেছে। এই মৃন্ময় অনুভূতির আলোয় একজন সাধারণ স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার—যে বার বার জীবনযুদ্ধে পরাজিত, পরিণামে সেই ই চরিত্রই হয়ে উঠেছে লিরিক ভাব সম্পদে সমৃদ্ধ চিরকালের প্রেমিক। লিরিক ব্যঞ্জনার সাথে সাথে এই গল্পে ছোটোগল্পের সার্থক শিল্পশৈলীও লক্ষণীয় প্রতীকির সঙ্গে এক লক্ষ্যভিমুখী গতিতে অগ্রসর হয়েছে।


একরাত্রি গল্পরচনার কয়েকমাস পরে 'সোনার তরী' কাব্যের বিখ্যাত কবিতা মানসসুন্দরী রচিত। এই কবিতার পরতে পরতে একরাত্রি গল্পের ভাববীজ লুকিয়ে আছে।

দোঁহে মোরা রব চাহি

অপার তিমিরে; আর কোথা কিছু নাহি 

শুধু মোর করে তব করতল খানি,

শুধু অতি কাছাকাছি দুটি জনপ্রাণী

অসীম নির্জনে....

একখানি অশ্রুভার নম্র ভালোবাসা


বিচ্ছেদের অসীম স্রোতে ভাসতে ভাসতে দুজনের সঠিক মিলনের অনন্ত স্বাদ দুটি রচনাতেই আছে। গল্পের নায়ক-নায়িকা উভয়েই নির্বাক ছিল—“একটা কথাও বলা গেল না।" বেদনা যেমন গভীর ছিল বাসনাও তেমন সীমাহীন। কবিতাতে সেই ভাষাহীন বেদনার কথা প্রস্ফুটিত—

এই যে বেদনা,

এর কোনও ভাষা আছে ? এই যে বাসনা, 

এর কোনও তৃপ্তি আছে?


গল্পে সুরবালা রামলোচনের ঘরণী হয়ে স্বামীর প্রেমে বাঁধা পড়েছিল। সে ছিল সীমাবদ্ধ। তার প্রেম ছিল ক্ষুদ্র। প্রলয় এসে তাকে টেনে নিয়ে গেল ঘরের বাইরে। যেখানে বিচ্ছেদ আর বিরহের উদ্দাম স্রোত বয়ে যাচ্ছে সেখানেই সে দাঁড়িয়ে নিজেকে ব্যাপ্ত করল বিশ্বময়। কবিতায় এই ভাবটি আছে—

মিলনে আছিলে বাঁধা

শুধু একঠাঁই, বিরহে টুটিয়া বাধা

আজি বিশ্বময় ব্যাপ্ত হয়ে গেছ প্রিয়ে 

তোমারে দেখিতে পাই সর্বত্র চাহিয়ে।


সোনার তরী কাব্যের পরশপাথর ও একরাত্রি গল্প একই সময়ে রচিত। পরশপাথর কবিতার ক্ষ্যাপাটি সন্ন্যাসী সমুদ্রতীরে কেবল নুড়ি কুড়োয় আর পরশপাথর খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু তারই অজান্তে কবে কোন্ ক্ষণে হাতে পরশপাথর এসেছিল সে বুঝতেই পারেনি। গল্পে সুরবালা যেন সেই পরশপাথর। কিন্তু সুরবালা দূরে সরে গেল রামলোচনের ঘরণী হয়ে। পরে তার আকস্মিক আবির্ভাবে নায়ক চমকে উঠেছিল।


গল্পে প্রেমর সিম্বি ঘটেছে এক অসাধারণ সাঙ্গীতিক মূৰ্চ্ছনায়। সংগীতে সঙ্গত করেছে স্বয়ং প্রকৃতি। রামলোচনের ঘরে বাল্যসখী সুরবালাকে দেখে নায়কের কর্মজীবনের সমস্ত বিস্তার অকস্মাৎ থমকে দাঁড়াল। প্রেমের এক উন্মত্ত আবেগ তারে হৃদয়ের অর্কেস্ট্রায় ধ্বনিত হতে লাগল। শেষে তা তার কানে গিয়ে পৌঁছাল। গল্প-নায়ক আনন্দের স্বাদ পেল। আর পাঠকের মন আপ্লুত হয়ে থাকল সংগীতের এই রেশটুকু টেনে নিয়ে।