“শাক্ত কবিরা ছিলেন মাতৃহৃদয়ের সুনিপুণ শিল্পী।”–তোমাদের পাঠ্যপদ অবলম্বনে দৃষ্টান্ত সহযোগে বিচার করো।

শৈশবে মানুষ মাতৃক্রোড়ে নির্ভয়ে বাস করে, অসহায় শিশুর তখন একমাত্র সম্বল মাতৃস্নেহের পিযুষধারা। অর্ধচেতন, অর্ধজড় অবস্থায় সে তখন মাকে আঁকড়ে ধরে। শিশু বয়ঃপ্রাপ্ত হলে জগৎ ও জীবনকে চিনতে শেখে। মাতৃবক্ষ থেকে সে তখন নেমে আসে মাটিতে। কিন্তু কোনো দিনও সে ভুলতে পারে না শৈশবের সেই সুখ স্মৃতি। অনুরূপভাবে মানবসভ্যতার শৈশবেও মানুষ ক্রুর প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে অনুভব করত যিনি রক্ষা করবেন তিনি পালনও করবেন। তাই সৃষ্টির প্রাচীনকাল থেকে একটি জননী তত্ত্ব মানবচিত্তকে অধিকার করেছিল। জীবন পিপাসার তাড়নায় মানুষ সমস্ত সৃষ্টির মূলে একটি মাতৃ দেবতার অস্তিত্ব উপলব্ধি করত। বাস্তব দুঃখবেদনা ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে গড়ে উঠত মা-সন্তানের মধুর সম্পর্ক। ধ্বনিত হত সস্তানের দুঃখে মাতৃহৃদয়ের কাতর ক্রন্দন।


শাক্ত পদাবলিতে আদ্যাশক্তি মহামায়াকে কন্যা ও জননীরূপে কল্পনা করে বাৎসল্য ও প্রতিবাৎসল্য রসে উদ্ভাসিত করা হয়েছে। শাক্তপদাবলির বাল্যলীলা আগমনী ও বিজয়ার গানগুলি জননী ও সস্তানের হৃদয়মন্থনে উদ্ভূত। এই মায়াময় জগৎ যার লীলায় হয়ে ওঠে আনন্দময় শাক্তপদাবলিতে সেই– "নৃত্য নিরঞ্জনী ভব ভয় ভঞ্জিনী” গৃহজননী ও কন্যারূপে কল্পিতা। বাল্যলীলা আগমনী বিজয়ার গানগুলিতে জগজ্জননীর অনস্ত লীলা মাধুরী বর্ণিত। দেবতার যত লীলা সেগুলির মধ্যে সর্বোত্তম নরলীলা। এ লীলায় দেবতা মানুষের দেহ ধারণ করেন। মানুষের মতো আচরণ করেন এবং মানুষের মতো স্নেহেপ্রেমে বন্দি হন। ভগবতীর অনস্তমাধুরীলীলা এখানে প্রকাশিত জননী ও কন্যারূপে। এতে আছে পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে গার্হস্থ্য জীবনের বাণীরূপ।


বাল্যলীলা আগমনী ও বিজয়ার গানগুলিতে বাংলাদেশের চিরায়ত পারিবারিক আলেখ্য চিত্রিত। এই চিত্র জীবনের হাসি-কান্নার স্পর্শে মানবগ্রাহী। দুটি পারিবারিক কাহিনি এখানে প্রকাশিত। একটি হিমালয় ও মেনকার সংসার অপরটি হর-পার্বতীর। এই দুই পরিবারের স্নেহপ্রেম মান-অভিমান অনুযোগ অভিযোগ এই পদাবলিতে রূপায়িত। মহাদেব ও উমা যেন আমাদের অতি চেনা সংসারে স্বামী-স্ত্রী। মহাদেব ভিক্ষা মেগে সংসার চালান। উমার জন্য মা মেনকার হৃদয় ব্যথিত। বালিকা কন্যাকে পতিগৃহে পাঠিয়ে জননীর যে দুশ্চিন্তা, তাকে কাছে পাওয়ার আকুলতা, বিদায়ক্ষণে যে মর্মস্পর্শী অশ্রুকাতরতা তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ঘটেছে শাক্তগানগুলিতে। বাল্যলীলাতে তাই দেখা যায় মাতৃহৃদয়ের সম্পূর্ণতা।-

“কাঁদিয়া ফুলালে আঁখি,

মলিন ও মুখ দেখি 

মায়ে ইহা সহিতে কী পারে ?”


মেয়ের মলিন মুখ দেখে মা চিন্তিত। দিনের চিত্তা রাত্রির স্বপ্নে প্রতিফলিত হয়। মেনকা দেখে উমা যেন মায়ের শিয়রে বসে—

“আধ আধ মা বলে বচনে সুধা ধরি।”


ব্যাকুলচিত্তে মেনকা উমাকে আনার জন্য স্বামীকে মিনতি করতে থাকে। উমার সাংসারিক অবস্থার কথা ভেবে স্বামীকে বলেন –

“ওহে গিরি কেমন কেমন করে প্রাণ। 

এমন মেয়ে কারে দিয়ে হয়েছ পাষাণ ৷৷”


মেনকার মতো অভিমান অভিযোগ সব নারীরাই স্বামীর কাছে করে থাকে। তিনি স্পষ্ট বলেন তাঁর স্বামীর দয়া-মায়া নেই। ভিখারীর হাতে রাজনন্দিনীকে সমর্পণ করে নিশ্চিন্তে আছেন – "কত দয়া আর থাকিবে পাথরে।" মেনকার এ অভিযোগ বাঙালি মাতার মতোই।


বিবাহের পর কন্যাকে কাছে আনা এবং সংবাদ নেওয়া যে উচিৎ সে বিষয়ে স্বামীকে বলেছেন—

“আছে কন্যা সন্তান যার দেখতে হয়, আনতে হয়।

সদাই দয়ামায়া ভাবতে হয় হে অন্তরে।”


মাত্র তিনদিনের জন্য উমার পিতৃগৃহে আগমন ঘটে। মেনকা উমাকে থেকে যেতে বলায় উমা রাজি হয় না তখন মেনকা সস্তান বিরহে মায়ের ব্যথা বোঝানোর জন্য উমাকে বলেন –

“বোঝাব মায়ের ব্যথা গণেশকে তোর আটকে রেখে।

মায়ের প্রাণে বাজে কেমন জানবি তখন আপনি থেকে।”


‘আগমনী’ অংশে মাতা ও কন্যার মিলন দৃশ্য যেমন মধুর, ‘বিজয়া’র বিদায় দৃশ্য তেমনই মর্মস্পর্শী মায়ের আকুল ক্রন্দন নবমী নিশির কাছে –

“ওরে নবমী নিশি না হইওরে অবসান।”


এতে আসন্ন বিচ্ছেদ কল্পনায় মেনকার বেদনার অভিপ্রকাশ। নবমী রাত্রিকে প্রাণদাত্রী রূপে কল্পনা করে তাকে চলে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। মেনকার আকুল আবেদন—

“যেও না রজনী আজি লয়ে তারাদলে

গেলে তুমি দয়াময়ী এ পরাণ যাবে।”


নবমী নিশি অবসিত হলে দশমীর প্রভাত আরও করুণ হয়ে দেখা দেবে। শিবের ঘন ঘন ডমরু ধ্বনিতে মাতৃহৃদয় বিদির্ণ। মেনকা উমাকে কিছুই ছাড়তে পারে না। তাই বিজয়ার করুণ রাগিনীতে ফুটে উঠেছে মাতৃহৃদয়ের বেদনা।


অতএব আগমনী বিজয়া পৌরাণিক পটভূমিতে রচিত হলেও সেখানে মা ও মেয়ের চিরন্তন সম্পর্ক। তাই সমালোচক বলেছেন – “আমাদের বাংলাদেশে এক কঠিন অন্তরবেদনা আছে—মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো, অপ্রাপ্তবয়স্ক অনভিজ্ঞ মূঢ় কন্যাকে পার করে যাইতে হয়, সেজন্য বাঙালি কন্যার মুখে বঙ্গদেশের একটি ব্যাকুল করুণ দৃষ্টি নিপতিত রহিয়াছে, সেই করুণ কাতর স্নেহ, বাংলার শারদ উৎসবে স্বর্গীয়তা লাভ করিয়াছে। আমাদের এই ঘরের স্নেহ, ঘরের দুঃখ বাঙালির চিরন্তন বেদনা হইতে অশ্রুজল আকর্ষণ করিয়া লইয়া বাঙালির হৃদয়ের মাঝখানে শারদ উৎসব পল্লবের ছায়া প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহা বাঙালির অম্বিকা পূজা এবং বাঙালির কন্যা পূজাও বটে।” তাই ‘আগমনী ও বিজয়া’ মাতৃহৃদয়ের গান।