গদাধর চরিত্রটি পর্যালোচনা করো।

মূলত 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' প্রহসনে গদাধর চরিত্রটি রূপায়িত হয়েছে হাস্যরস সৃষ্টির কারণে। সে ভক্তপ্রসাদের দুষ্কর্মের সহযোগী, সে কারণে সে তাঁর সঙ্গে জোটবদ্ধ চরিত্র। তবে তার মধ্যে কয়েকটি গুণাবলি লক্ষিত হয় যাতে তাকে গ্রিক কমেডির চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করা চলে। তাকে পাশ্চাত্ত্য মিলনান্ত ও হাস্যরসাত্মক নাটকের চরিত্রের বিপরীত মেরুতে বসানো যেতে পারে। প্রভুর আহ্বানের উত্তরে সে সর্বদাই সতর্কভাবে উত্তর দেয়—'আজ্ঞে এ এ-এ। তার এই অভ্যাস এক ধরনের হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে, যদিও তা নিতান্তই সাধারণ মুদ্রাদোষজনিত।


ভূতের ভয়ে কম্পিত কলেবেরে গদাধর যখন প্রভুকে বলে—'আগে বাঁচি তবে'— তখন তার বিশ্বাসঘাতকতা ও কাপুরুষতা একই সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। অবশ্য প্রভুকে অস্বীকার করবার প্রবণতা নাট্যকার আগে ভাগেই তার মধ্যে প্রদর্শন করেছেন।


নাট্যমধ্যে রাম এবং গদার ক্ষণকালীন একটি বিলাসের দৃশ্য আছে। ভক্তপ্রসাদ তাঁর নিজের গৃহেই ভৃত্যবর্গ দ্বারা পরিবৃত থেকে 'তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে স্বগত' উক্তি করেন—'এই বাবু বেটারাই মজা করে নিলে'। এ দৃশ্যটি কমিক পরিবেশে গ্রথিত। তবে এর নাট্যগত ব্যঞ্জনাও আছে।


হানিফ যেমন ভক্তবাবুর প্রজা গদাও তেমনি তাঁর বেতনভুক ভৃত্য। রামকে গদা বলে—“আজ ভাই ভারি মজা করলেম" হানিফও তেমনি মজা করেছে। গদা তার প্রভুর অনুগত ভৃত্য বটে, কিন্তু সেই প্রভুর প্রতি মাঝে মাঝে সে যে মন্তব্য করেছে, তাঁর চরিত্রের ওপর আলোক সম্পাত করেছে, তাতে আর তখন তাকে নিছক ভৃত্য বলা যায় না। সে তখন প্রভুর সমমর্যাদায় উন্নীত হয়ে প্রায় বন্ধুবৎ হয়ে উঠেছে।


অন্যদিকে গদাধরই ভক্তপ্রসাদের কাছে ফতেমার রূপের কথা বলে এ বিষয় প্রভুকে উৎসাহিত করেছে। ভক্তপ্রসাদ দ্বিধা করলে সে বলে—“আপনি আমাকে কতবার বলেছেন যে, শ্রীকৃষ্ণ ব্রজে গোয়ালাদের মেয়েদের নিয়ে কেলি কত্যেন” এইভাবে সে তাঁর যৌনপ্রবৃত্তিকে উদ্দীপিত করেছে। নিজের পিসি পুঁটিকে এ কর্মে নিয়োজিত করেছে। অর্থাৎ ভক্তপ্রসাদের চেয়ে যে-কোনো অংশেই কম অপরাধী নয়। একদিকে ভক্তপ্রসাদের মনে যৌনবৃত্তির উদ্দীপনা, অপরদিকে সেটিকেই নিজের আর্থিক স্বার্থে সে ব্যবহার করেছে। কাজেই সে নাট্যমধ্যে প্রায় ভিলেনে রূপান্তরিত হয়েছে। এই কারণেই হানিফের দ্বারা সে প্রহৃত হয়। তখন পাঠক-দর্শকের ন্যায়বোধও তাতে পরিতৃপ্ত হয়।


অবশ্য গদার স্পষ্টবাদিতা চোখে পড়ার মতো। পঞ্চীর প্রতি ভক্তপ্রসাদ আকৃষ্ট হলে সে সরাসরি জানিয়ে দেয়— “আজ্ঞে ও বড়ো সহজ কথা নয়।" ভক্তপ্রসাদের ক্রিয়াকলাপের জন্য তার উক্তিগুলি থেকে তাকে একজন সচেতন ও সপ্রতিভ মানুষ বলে মনে হয়। তার সপ্রতিভতা এ নাটকের হাস্যরসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গদা বাহ্যত ভক্তপ্রসাদের দুষ্কর্মের সহযোগী। হয়তো সেটা তার আর্থিক দিকেরও পরিপোষক। তথাপি, ভক্তপ্রসাদের প্রতি তার একপ্রকার বিরূপতাও ছিল। এই বিরূপতা একধরনের প্রতিশোধ প্রবণতা হয়ে, রামের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে ক্ষণকালীন বিলাসিতায় রূপ নেয়। সেই বিরূপতাই হানিফের প্রহারে রূপ নিয়েছে। এইভাবে গদার বিরূপতা হানিফের প্রহারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে।