গদ্যের সূচনা ও বিকাশপর্ব : রামরাম বসু (১৭৫৭ খ্ৰীঃ-১৮১৩ খ্রীঃ)

গদ্যের সূচনা ও বিকাশপর্ব : রামরাম বসু


রামরাম বসু ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে মাসিক চল্লিশ টাকা বেতনে সহকারী পণ্ডিত হিসাবে নিযুক্ত হন। কেরীর নির্দেশে তিনি ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র' রচনা করেন। কেরীর উক্তি: "I got Ram Bosu to compose a history of one of their kings, the first prose book ever written in the Bengali language; which we are also printing."


এই গ্রন্থ রচনার জন্য কেরী কলেজ কাউন্সিলে লেখককে ৬০০ টাকা দেবার জন্য‌ সুপারিশ করেন। এই গ্রন্থের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন (১) প্রথম বাংলা গদ্য গ্রন্থ ("The first prose work ever written in the language" এবং গ্রন্থটি (২) একটি প্রামাণ্য ইতিহাস ("an authentic history of the government of Bengal from the beginning of the reign of Ackbar to the end of that of Johangeer), কেরীকে অনুসরণ করে বুখানন (Buchanan), তার ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ইতিহাস গ্রন্থে বলেন "composed from authentic documents"


রামরামের ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্রে’র আদি পূর্বপুরুষের পরিচয় দিয়ে কাহিনীর সূচনা : বঙ্গজ কায়স্থ রামচন্দ্র জীবিকার সন্ধানে গৌড়ে এসেছিলেন। সেইসময়ে বাংলা ও বিহারে পাঠান নবাব সুলেমানের রাজত্বকাল। গ্রন্থটির ভাষায় আছে আরবী ও ফার্সী শব্দের প্রাচুর্য; যেমন“যে কালে দিল্লির তক্তে হোমাড়ু বাদসাহ তখন ছোলেমান ছিলেন বঙ্গ ও বেহারের নবাব পরে হোমাড়ু বাদসার ওফাত হইলে হেন্দোস্তানে বাদসাহ হইতে ব্যাজ হইল এ কারণ হোমাঙু ছিলেন বৃহৎ গোষ্ঠি তাহার অনেক গুলিন সন্তান তাহারদের আপনারদের মধ্যে আত্মকলহ লইয়া বিস্তর২ ঝকড়া লড়াই কাজিয়া উপস্থিত ছিল ইহাতে সুবাজাতের তহশিল তাগাদা কিছুই হইয়াছিল না।"


এই গ্রন্থের ভাষা সম্পর্কে ১৮৫০ খ্রীস্টাব্দে ক্যালকাটা রিভিউতে মন্তব্য করা হয়েছিল "Kind of mosaic, half Persian, half Bengali", রেভারেন্ড জেমস লঙ বলেছিলেন : "A work the style of which is a kind of mosaic showed how much the unjust ascendency of the Persian language had in the day corrupted the Bengali", (উদ্ধৃত, 'আধুনিক বাংলা সাহিত্য’, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ৩০)। অবশ্য সমকালের ঐতিহাসিকেরা এই গ্রন্থের ভাষা সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন।


লঙ সাহেব তার "Descriptive Catalogue"-এ বলেছিলেন "The first Prose work and the first Historical one that appeared" প্রকৃতপক্ষে, “রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র যিনি বাস করিলেন যশহরের ধূমঘাটে একব্বর বাদশাহের আমলে” তার উপাদান সন্ধানের জন্য লেখক ফার্সী ভাষায় রক্ষিত তথ্য এবং লোকশ্রুতির উপর নির্ভরশীল। তবু ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার এই বইয়ের প্রথমাংশকে ঐতিহাসিকভাবে যথার্থ বলেই রায় দিয়েছেন। গ্রন্থটি বিশেষভাবে স্মরণীয় এই কারণে যে এক, বাঙালীর‌ ইতিহাস রচনার সূত্রপাত এইখানে। দুই, অসংবদ্ধ প্লট বা ঘটনা-বিবরণের ত্রুটি সত্ত্বেও‌ পরবর্তীকালে প্রতাপচন্দ্র ঘোষের 'বঙ্গাধিপ পরাজয়', রবীন্দ্রনাথের 'বউঠাকুরানীর হাট' ইত্যাদি পরবর্তী ঐতিহাসিক উপন্যাসের উৎস হয়তো এখানেই নিহিত ছিল। গ্রন্থটির আরেকটি খ্যাতি বা কুখ্যাতি আছে তার ভাষার জন্য। তবে মনে হয় ফারসিনবীশ মুনশী রামরাম মুঘল যুগের রাজার কথা বলার জন্যই মুসলমান শাসনকর্তা বা মুসলমান রাজদরবারের প্রসঙ্গে অসঙ্কোচে ফারসি ব্যবহার করেছেন।


মৃত্যুঞ্জয়ের ‘রাজাবলি’ আধুনিক ধরনের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থটির মৌলিকত্ব সন্দেহাতীত নয়। রমেশচন্দ্র মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথিশালাস্থ 'রাজাবলী' নামক সংস্কৃত গ্রন্থ এর আদর্শ বলে নির্দেশ করেছেন। মৃত্যুঞ্জয় স্বয়ং গ্রন্থটিকে ‘রাজতরঙ্গ’ বলে উল্লেখ করেছেন। ইতিহাস হলেও পৌরাণিক গল্প এখানেও অনুসৃত হয়েছে। তবু গ্রন্থটি বৈশিষ্ট্যময় এই কারণে যে, (ক) কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ থেকে কোম্পানীর শাসন পর্যন্ত কালানুক্রমিকভাবে লেখার প্রচেষ্টা আছে। (খ) ঐতিহাসিকের নিরাসক্তি নিয়ে সিরাজের পরাজয় বর্ণনায় স্বতন্ত্র মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। (গ) 'রাজাবলী’ গ্রন্থটি লেখার পরোক্ষ উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবতঃ ইংরেজ লেখক মার্শম্যানের ‘History of Bengali’-এর পাশ্চাত্যপ্রবণতার বিপরীত ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করা, খ্রীস্টান ধর্মের বিপরীতে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও অতীত হিন্দু ঐতিহ্যকে তুলে ধরা। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক স্যার বৈদ্যনাথ ব্যানার্জীর অভিমতটি প্রণিধানযোগ্য) : "One object of the book is to oppose the views given in Marshman's India which the author thinks are too much against the Brahmans and in favour of Christianity.....To those wishing to gain a summary of Hindu History, as given by an "Orthdox Hindu", from the Ramayan, Mahabharat and, Purans, this book is very useful."


পুরস্কারের দিকে লক্ষ্য রেখেই হোক অথবা ইংরেজ কৃষ্ণচন্দ্রের চরিত্রচিত্রণের জন্যই হোক, তোষণনীতির চিহ্ন রাজীবলোচনের গ্রন্থটিতে সুস্পষ্ট— “মিরজাফরালি খাঁ মুর্শিদাবাদের গড়েতে গমন করিয়া ইংরাজী পতাকা উঠিয়া দিলে সকলে বুঝিল ইংরাজ মহাশয়দিগের জয় হইল তখন সমস্ত লোকে জয় জয় ধ্বনি করিতে প্রবৃত্ত হইল এবং নানা বাদ্য বাজিতে লাগল।” কাহিনী সমকালীন হওয়া সত্ত্বেও কাল্পনিক গল্প এখানে উপেক্ষিত হয় নি।