'পুতুল নাচের ইতিকথা' নামক উপন্যাসের নামকরণ আলোচনা করো।

গ্রন্থনাম দর্পণের মতো। এখানে যেমন বিষয়বস্তু প্রতিবিম্বিত হয় তেমনি লেখকের ব্যক্তি সত্তাটিও প্রতিফলিত হয়। শিল্প সাহিত্যের নামকরণ বিন্দুতে সিন্দু দর্শনের ন্যায় অসাধারণ একটি ক্রিয়াকর্ম। তাই শিল্পী নামকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ সচেতন মানসিকতার প্রকাশ করেন। কারণ নামকরণের সার্থকতা ও ব্যর্থতা বহুল অংশ বিষয়ের নির্ভর করে নামে কী আসে যায়, শেকসপিয়রের একথা বাস্তব জীবনের ক্ষেত্রে সত্য হলেও শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে তা ঠিক নয়। শিল্প সাহিত্যে সৃষ্টির সম্পূর্ণতা দানের পর নামকরণ করা হয় বলে এখানে শিল্পীকে সচেতন মানসিকতা ও কলানৈপুণ্য নিদর্শন রাখতেই হয়। কিন্তু সাহিত্য নামকরণ এর ক্ষেত্রে নানা সূত্র নির্দেশিত হয়—

  • (ক) ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণ।

  • (খ) বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক নামকরণ।

  • (গ) চরিত্রকেন্দ্রিক নামকরণ। 

  • (ঘ) পরিবেশ ও পরিস্থিতি কেন্দ্রিক নামকরণ।


প্রভৃতি নানা ধারায় নামকরণ দেখা যায়, শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে। শিল্প সাহিত্যে নামকরণের এই প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি স্মরণ রেখে আমরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘পুতুল নাচের ইতিকথা' নামক উপন্যাসের নামকরণ আলোচনা করবো।


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাসটির নামকরণ করেছেন ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'। এই পুতুল নাচ আমাদের দেশে খুবই প্রচলিত। একজন সূত্রধর আড়াল থেকে পুতুল সাজিয়ে নাচান, এখানে পুতুলের কোনও অস্থিত্ব থাকে না। সবকিছুই থাকে পূর্ব নির্দিষ্ট। এখানে পুতুল নাচের উৎপত্তি বা বিকাশের কোনো কথাই নেই, তবে উপন্যাসের বিভিন্ন জায়গায় পুতুল নাচ সম্পর্কে নানান কথা আছে।

  • এক ॥ ‘পথের মোড়ে বকুল গাছটির গোড়া পাকা বাঁধানো। বিকালের দিকে এখানে সরকারি আড্ডা বসে। ওখানে জল ও কাঁচা পাকা পাতার সঙ্গে পাতার উপরে ন্যাকড়া জড়ানো একটা পুতুল পড়িয়া আছে।”

  • দুই ৷৷ “বোন একটা আছে..........আমার খাটের তলায় হল ওর খেলা ঘর! তাকিয়ে ! দ্যাখ পুতুলেরা সার সার ঘুমাচ্ছে।” 

  • তিন। “গ্রামের পূজার উৎসব উপলক্ষ্যে “জমিদার শীতলবাবুর বাড়ি তিনদিন যাত্রা পুতুল নাছ........।”

  • চার ৷৷ “সন্ধ্যাবেলা শ্রীনাথ মুদির মেয়ে বকুল তলে পুতুল ফেলিয়া গেলে ভোরবেলা সে পুতুল কুড়াইয়া কতকাল কাটিয়েছে সেনদিদির।”


উপন্যাসের মধ্যে এভাবে নানা প্রসঙ্গে পুতুল বা পুতুল নাচের প্রসঙ্গ এসেছে। এর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী পুতুল খেলার প্রসঙ্গই বেশি। শ্রীনাথ মুদির মেয়ে এবং শশীর বোন সিন্দুর বালিকা বয়সের পুতুল খেলা আছে। সেনদিদি তার নিঃসন্তান জীবনে পুতুলকে দেবতা জ্ঞানে ভক্তি করার কথা আছে। কিন্তু এর মধ্যে কুসুমের পিতা অনন্তের কথার মধ্যে আছে অদৃষ্টবাদ তথা নিয়তিবাদের কথা।


নিয়তি, অদৃষ্ট, ভাগ্যবাদী ইত্যাদি শব্দে লেখকের ক্ষোভ। বিজ্ঞানের ছাত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অদৃষ্ট নিয়তিকে নীরবে মেনে নিতে পারেন নি। তাই তিনি শসীর মধ্য দিয়ে। বাস্তবতার সন্ধান দিতে চেয়েছেন। উপন্যাসের একটি চরিত্র অনন্ত যখন বলেছে–“পুতুল বৈ তো নয় আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।" তখন শশী তার বিজ্ঞান মনস্ক মানসিকতা দিয়ে গ্রামের গেঁয়ো পুকুরের ঢেউয়ে আবদ্ধ মানুষগুলোকে সচেতনতার আলোয় দেখাতে চেয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিয়তির ফেরে শশীও পুতুলে পরিণত হয়ে বাবা গোপালের কথা উচ্চারণ করে বলে—“অদৃষ্টের লেখা কে খণ্ডাবে। পুতুলের সংসারে জ্ঞানবুদ্ধি যুক্তি দিয়ে পুতুল হতে না চাইলেও চিরন্তন ও মধ্যাকর্ষণের অপরিবর্তনীয়তায় শশী শেষ পর্যন্ত নিঃসঙ্গ হয়ে যায়।


তাই উপন্যাসটি পর্যালোচনার সূত্রে দেখা যায় এই উপন্যাসে মানুষের হাতে পুতুল হওয়ার বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদকেই লেখক ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে ভারতীয় অদৃষ্টবাদ এবং নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে উপন্যাসিক পাঠককে সচেতন করে তুলতে চেয়েছেন। মানুষ পুতুলের মতো আচরণ করবে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এক ডাক্তার শেষ পর্যন্ত পুতুলে পরিণত হোক লেখক এটা চান নি। তাই যামিনী কবিরাজ, গোপালদাস, যাদব পণ্ডিতের মতো মানুষেরা গ্রাম্য জীবনের সংকীর্ণ পরিসরে খালের ধারে বাজপড়া গাছটার মতো, শশীর সমস্ত বড়ো বড়ো স্বপ্ন তার কল্পনাকে ঝলসে দিতে চেয়েও সফল হয়নি। বরং শশী ডাক্তার তাদের গতানুগতিক নিস্তরঙ্গ জীবনে এক একটা আলোড়ন তুলেছে আর এর মাধ্যমে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছেন যা উপন্যাসটির দ্বিতীয় সংস্করণে প্রকাশকের বক্তব্যে উল্লেখিত হয়েছে—“পৃথিবীর এই বিরাট রঙ্গমঞ্চে মানুষ যেন শুধু পুতুল। কোনো অদৃশ্য হাতের সুতোর টানা পোড়েনে মানুষ নাচে–কথা বলে।”


পরিশেষে বলা যায় পুতুল বা পুতুল নাচে শব্দগুলি ঔপন্যাসিকের জীবন ভাবনার প্রেক্ষাপটে উপন্যাসে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই শব্দগুলি ব্যবহার করে গ্রামজীবনের সংস্কার অসহায়তা ও অক্ষমতারই সংকেত দিয়েছেন। আর এদিক থেকে আলোচ্য উপন্যাসটির ‘পুতুল নাচের ইতিকথা' নামকরণ ব্যঞ্জনাধর্মী এবং একইভাবে সার্থক।