গোবিন্দদাসের কবিপ্রতিভার বিশ্লেষণ করো।

গোবিন্দদাসের কবিপ্রতিভা

মধ্যযুগের গোবিন্দদাস কবিরাজ বিদ্যাপতির রচনা-রীতির আদর্শ অনুসরণ ক’রে প্রায় বিদ্যাপতির মতোই জনপ্রিয়তা ও গৌরব লাভ করেছেন। ভাষা ভঙ্গিমার অপূর্বত্ব ও শব্দের মধুর ঝংকার তাঁর জনপ্রিয়তা এখনো অক্ষুণ্ণ রেখেছে। পাণ্ডিত্য, পরিশীলিত মন ও গভীর ভক্তিভাব গোবিন্দদাসকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গৌরবময় আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখনও কীর্তনীয়া সমাজে বা সঙ্গীতপিপাসু গোষ্ঠীতে তাঁর পদগুলি কীর্তনের আকারে গীত হয়। বাংলা কীর্তনের একটা বড় অংশ তাঁর পদগুলিকে অবলম্বন ক’রে গড়ে উঠেছে।


গোবিন্দদাসের জীবনকথা কোনও কোনও বৈষ্ণব গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে বলে তাঁর প্রকৃত জীবন সম্বন্ধে কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়। গোবিন্দদাসের মাতামহ দামোদর সেন বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। কাটোয়ার অন্তর্গত শ্রীখণ্ড গ্রামে তাঁদের বাস ছিল। এটি বৈদ্যপ্রধান গ্রাম। গোবিন্দদাসও বৈদ্য বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম চিরঞ্জীব সেন, তিনি চৈতন্যের পরম ভক্ত ছিলেন। তাঁর দুই পুত্র রামচন্দ্র ও গোবিন্দদাস। রামচন্দ্রও পরে বৈষ্ণব মতাদর্শ গ্রহণ করেছিলেন এবং বৈষ্ণব সমাজের নেতৃস্থানীয় হয়েছিলেন। নানা প্রাসঙ্গিক তথ্য থেকে মনে হচ্ছে গোবিন্দদাস যোড়শ শতাব্দীর তিন-চার দশকের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন এবং প্রথম জীবনের শাক্ত মতাবলম্বী হলেও বৈষ্ণব ভক্তিধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব আচার্য শ্রীনিবাসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।


১৫৭৬ খ্রীঃ অব্দে প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে এই দীক্ষা গ্রহণের পর তিনি বৈষ্ণবসমাজে কবি বলে সসম্মানে গৃহীত হন। মনে হয় তিনি সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তিনি পদাবলী ছাড়াও সঙ্গীতমাধব নামে একখানি সংস্কৃত নাটক লিখেছিলেন। দুঃখের বিষয় এটি পাওয়া যায় না। তাঁকে খুব সম্ভব বৃন্দাবনের গোস্বামী প্রভুরা কবিরাজ উপাধি দিয়েছিলেন। তারপর থেকে তিনি গোবিন্দদাস কবিরাজ নামে পরিচিত হয়েছিলেন। বৃন্দাবনের গোস্বামীরা তাঁকে বিশেষ স্নেহ করতেন। জীবন গোস্বামীর সঙ্গে তাঁর বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল। জীবন গোস্বামী বৃন্দাবন থেকে তাঁকে সংস্কৃতে চিঠি লিখতেন, গোবিন্দদাসও তাঁকে স্বরচিত পদ উপহার পাঠাতেন। সমগ্র বৈষ্ণবসমাজ তাঁর রচিত পদের কাব্যসৌন্দর্য ও ভক্তিভাবে বিমোহিত হয়েছিল। তিনি বিদ্যাপতির ভণিতায় প্রচলিত কয়েকটি অসম্পূর্ণ পদকে সম্পূর্ণ করেছিলেন। তাঁর ভাব ও ভাষার সঙ্গে বিদ্যাপতির পদের যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। বস্তুত তিনি কবিতার রূপনির্মিতিতে বিদ্যাপতিকে অনুসরণ করেছিলেন। তাই তাঁকে বলা হয় “দ্বিতীয় বিদ্যাপতি”। তিনি কোনও কোনও পদে নিজ ভণিতার সঙ্গে বিদ্যাপতির ভণিতা দিয়ে মৈথিল কবির নিকট ঋণ স্বীকার করেছেন।


বিরহিণী রাধার খেদপ্রকাশকে তিনি লিখেছেন-

প্রেমক অঙ্কুর   জাত আত ভেল

না ভেল যুগল পলাশা।

প্রতিপদ চাঁদ    উদয় যৈছে যামিনী

সুখলব ভৈ গেল নিরাশা।।

প্রেমের অঙ্কুর জন্মাতে না জন্মাতে প্রচন্ড রৌদ্র উঠল। ফলে তার কোমল পত্র দুটি বিকশিত হতে পারল না। যেন রাত্রিতে প্রতিপদের চাঁদ উদিত হয়েই অস্ত গেল। সুখলাভের কণামাত্র আশা নৈরাশ্যে পরিণত হল।


কৃষ্ণ মথুরায় চলে গেলে গোকুলের কি দশা হয়েছে তা নিম্নে চমৎকাররূপে বর্ণনা করা হয়েছে—

তোহে রহল মধুপুর।

ব্রজকুল আকুল   গোকুল কলরব

কানু ফানু করি ঝুর।।

যশোমতী নন্দ    অন্ধ সম বৈঠত

সঘনে উঠিতে নাহি পারে। 

সখাগণ ধেনু    বেণু নাহি পুরত

বিছুবল নগর বাজারে।।

কুসুম ত্যজি অলি    ভূমিতলে লুঠত

তরুগণ মলিন সমান।

সারী শুক পিক    ময়ূর ন নাচত

কোকিল না করতহি গান।


কৃষ্ণ বিরহে স্থাবর জঙ্গম কতটা ব্যাকুল হয়েছে, এখানে কবি গোবিন্দদাস আশ্চর্য কুশলতার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। বর্ষার রাত্রিতে বিরহিণী রাধার মর্মবেদনা প্রকাশে বিদ্যাপতির স্বল্প প্রভাব লক্ষিত হলেও, অদ্ভূত দক্ষতার সাথে তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে—

নৈরাশ বাসর    রজনী দশদিন

গগনে বারিদ ঝম্পিয়া।

ঝলকে দামিনী    পলকে কামিনী

হেরি মানস কম্পিয়া।

পাপ ডাহুকি    ডাহুকে ডাকই

মউর নাচত মাতিয়া।

একলি মন্দিরে    অনিদ লোচনে

জাগি সগরহি রাতিয়া ৷৷


এখানে নির্জন নিঃসঙ্গ রাত্রি, ঝড় ঝঞ্ঝা, বজ্রমিন্দ্রত আকাশ এবং অনিদ্র নয়নে রাধার একলা জেগে থাকার চিত্রটি সার্থক গীতিকবিতায় পরিণত হয়েছে এবং এই ছত্র ক'টি একালের রসিক পাঠককেও মাতিয়ে তুলেছে। ভাষার ঝংকারের দিক থেকে দুটি স্তবকের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়—

নন্দ নন্দন    চন্দ চন্দন

গন্ধ নিন্দিত অঙ্গ।

জলদ সুন্দর    কম্বু কম্পর

নিন্দি সিন্ধুর ভঙ্গ।।


এ পর্যন্ত গোবিন্দদাস ভণিতাযুক্ত সাতশরও বেশী পদ পাওয়া গেছে। তার মধ্যে অল্প কিছু বাংলা পদ আছে। বাকি সমস্তই ব্রজবুলিতে রচিত। দু-একটিতে আবার সংস্কৃত ধরনের বাগ্‌বিন্যাস আছে। একটি পদ তো বিশুদ্ধ সংস্কৃতে রচিত। বৈষ্ণব পদাবলীতে একাধিক চণ্ডীদাস ও বলরাম দাসের মতো একাধিক গোবিন্দদাসও আছে। এমন কি গোবিন্দদাস ঠাকুর নামে এক মৈথিলি কবি বিদ্যাপতির রীতিতে গান লিখেছিলেন বলে শোনা যায়।


ব্রজবুলিতে রচিত গোবিন্দদাসের পদগুলির শ্রুতিমাধুর্য, ধ্বনিঝংকার ও শব্দের নিপু এমনই চমৎকার যে একবার শুনলেই মন মুগ্ধ হয়ে যায়। কীর্তনের আসরে তাই গোবিন্দদাসের একচ্ছত্র অধিকার। সংস্কৃত সাহিত্য ও বৈষ্ণব শাস্ত্রাদিতে অতিশয় অভিজ্ঞ গোবিন্দদাসের কবি প্রতিভায় একই সঙ্গে পাণ্ডিত্য ও কবিত্ব শক্তির সমন্বয় ঘটেছিল। তাঁর পদে তাই সংস্কৃত কাব্যকবিতার ঘনিষ্ঠ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ভাবের গভীরতা, ভক্তির নিষ্ঠা এবং শিল্পের চমৎকারিত্ব তাঁকে কালজয়ী করেছে। গোবিন্দদাস একাধারে কবি ও সাধক। একালের রসিক ব্যক্তিও তাঁর পদ থেকে অতি চমৎকার লিরিক রস ও গীতিকবিতার স্বাদ পাবেন। ভক্তিভাব ছাড়াও তাঁর কবিতার মধ্যে অতিরিক্ত কাব্যসৌন্দর্য থাকায়, এগুলি কালের শাসন উপেক্ষা করতে পেরেছে।


গোবিন্দদাস বৈষ্ণব আচার্য শ্রীনিবাসের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তিনি গৌড়ীয় ভক্তিতত্ত্বের একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন। সুতরাং ধর্ম ও সাধনার অনেক নিগূঢ় ইঙ্গিতও তাঁর রচনা থেকে পাওয়া যেতে পারে। গোবিন্দদাস একাধারে ভক্ত ও কবি। বৈষ্ণব সাধনা ও শাস্ত্র বিষয়ক বহু গ্রন্থ পাঠ করেছিলেন বলে তাঁর পদে গৌড়ীয় আদর্শের একটি পূর্ণ পরিচয় আছে। বাংলার উত্তর চৈতন্যযুগের আদর্শ আলাচনা করতে গেলে তার রচিত পদাবলীকে উপাদান হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। উপরন্তু তাঁর হাতে ছিল শিল্পীর কলম। ফলে ভাষা, ছন্দ, ঝংকার, লালিত্য ও অলংকারে তাঁর প্রায় সমস্ত পদ অপূর্ব রসবস্তুতে পরিণত হয়েছে।


অন্যান্য পদকারদের মতো গোবিন্দদাসও রাধাকৃষ্ণলীলাকে নানাপর্যায়ে বিন্যস্ত করেছেন। এই বিন্যাসের মধ্যে রাধাকৃষ্ণের পূর্বরাগ, অভিসার, বাসকসজ্জা, বিপ্রলব্ধা, খণ্ডিতা, কলহস্তরিতা ও মাথুরের পদ সন্নিবেশ বিশেষ প্রশংসা দাবি করতে পারে। বলাই বাহুল। এই বিন্যাসে উজ্জ্বল নীলমণির প্রভাবই স্বীকৃত হয়েছে। অভিসারের পদগুলি শিল্পগুণের দিক থেকে সমগ্র বৈষ্ণব-সাহিত্যে তুলনারহিত। মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি বুঝি বিদ্যাপতিকেও ছাড়িয়ে গেছেন। অবশ্য এই সমস্ত অপার্থিব লাবণ্যে পূর্ণ পদগুলির মধ্যে বঙ্গভূমির কিছু কিছু প্রভাব আছে। কীর্তনীয়া সমাজ এখনও গোবিন্দদাসের পদ অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে গান করে থাকেন। সেইজন্য এখনও লোকসমাজে গোবিন্দদাসের বহু পদ প্রচলিত আছে। তাঁর কিছু কিছু পদ রূপনির্মিতির বিশেষত্বে ও ধ্বনি ঝংকারে একালের পাঠকেরও বিস্ময় আকর্ষণ করবে। রাধা কৃষ্ণের নিকট আত্মসমর্পণ করলে সখিগণ কুলধর্মের কথা স্মরণ করিয়ে রাধাকে ভর্ৎসনা করায় তিনি বলেন—

সজনি অব কি করবি উপদেশ।

কানু অনুরাগে    তনু মন মাতল

না শুনে ধরম ভয় লেশ৷৷


সজনি আর উপদেশ দিয়ে কি হবে। কানু অনুরাগে আমার তনু মন এমন মত্ত যে আমার ধর্মভয় লোপ পেয়েছে।


প্রেম আকুল    গোপ গোকুল

কুলজ কামিনী কস্ত।

কুসুম রঞ্জন    মঞ্জু বঞ্জুল

কুঞ্জ মঞ্জির সত্ত।।

কঙ্কণ ঝঙ্কণ    কিঙ্কিণী শঙ্খিনী

কুন্ডণ কুণ্ডলি ভান।

যাবক পাবক    কাজর জাগর

মৃগমদ মদ করি মান।।

এখানে শ্রুতিসুখকর অনুপ্রাসের সাহায্যে কবি চমৎকার ধ্বনিঝংকার ও চিত্ররূপ ফুটিয়ে তুলেছেন।


বর্ষাভিসারের এই বর্ণনাটি বিদ্যাপতির সমকক্ষতা দাবি করতে পারে—

মন্দির বাহির কঠিন কপাট।

চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।

তাঁহি অতি দূরতর বাদর দোল।।

বারি কি বারই নীল নীচোল।। 

সুন্দরি কৈছে করবি অভিসার।

হরি রহ মানস সুরধুনী পার।।

কিংবা,

ঘন ঘন ঝন ঝন বজর নিপাত। 

শুনইতে শ্রবণ মরম মরি জাত।।


সখীরা রাধাকে বলছেন, এই দুর্যোগের রাত্রিতে কৃষ্ণের অভিসারে বের হয়ে তুমি কি প্রাণত্যাগ করবে? রাধা বলেন—

প্রেম দহদহ   জাক হৃদয় সহ

তাহে কি বজরক আগি।


যার হৃদয়ে প্রেমের দহন জ্বালা, বজ্রাগ্নি তার কি করবে? বর্ষার ঘনঘটা তুচ্ছ ক'রে রাধা অভিসারে যাবার জন্য দুশ্চর তপস্যা ও সাধনা শুরু করলেন—

কণ্টক গাড়ি   কমল সম পদতল।

মঞ্জির চীরহি ঝাঁপি।

গাগরি বারি   ঢারি করি পিছল

চলতহি অঙ্গুলি চাপি।।

………...

গুরুজন বচন    বধির সম মানই

আন শুনই কহ আন।

পরিজন বচন    মুগধি সম হাসই

গোবিন্দদাস পরমাণ।।

পরিশেষে সব দুঃখের অবসান হল। শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলন হ’ল—

একে পদ পঙ্কজ    পঙ্কে বিভূষিত

কণ্টকে জরজর ভেলা।

তুয়া মুখ দরশনে    সব সুখ পায়লহুঁ 

চিরদুখ সব দূরে গেলা।। 

তোহরি মুরলী যব     শ্রবণে প্রবেশল

ছোড়লু গৃহসুখ আশ

পন্থক দুখ    তৃণহুঁ করি গণলু

কহতহি গোবিন্দদাস।।


রাধা বলেছেন : পদপঙ্কজ কর্দমাক্ত, কত কাটা ফুটেছে। কিন্তু হে কৃষ্ণ তোমার মুখ দেখে আমার সমস্ত দুঃখ দূর হ’ল। তোমার বংশীধ্বনি আমার কানে প্রবেশ করা মাত্রই ঘরের সুখ সব ছাড়লাম, পথের দুঃখ তৃণবৎ তুচ্ছ করলাম।


শ্রীরাধিকার এই উক্তিতে বোঝা যাচ্ছে, বৈষ্ণবরা সেই দুশ্চর তপস্যার কথা বলেছেন, যা শ্রেষ্ঠ প্রেমের লক্ষণ এবং সেই ভাবটি গোবিন্দদাস আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন।


শুধু রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ নয়, শ্রীগৌরাঙ্গ বিষয়ক পদেও তাঁর ভক্তির গভীরতা ও রচনার বৈচিত্র্য ধরা পড়েছে। ভাবমুগ্ধ শ্রীগৌরাঙ্গের দিব্য ভাবটি ভক্ত কবি কি চমৎকারভাবেই না ফুটিয়ে তুলেছেন—

জয় শচীনন্দন রে।

ত্রিভুবন মন্ডন    কলিযুগ কাল

ভুজগ ভয় মন্ডন রে।।

বিপূল-পুলক কুল    আকুল কলেবর

গরগর অন্তর প্রেমভরে।

লহু লহু হাসনি    গদ গদ ভাষণি।

কত মন্দাকিনী নয়নে ঝরে।।


এই প্রসঙ্গে বিদ্যাপতির সঙ্গে গোবিন্দদাসের তুলনার কথা মনে আসে। জ্ঞানদাস যেমন ভাষা ও কাব্যের দিক থেকে বাংলা পদে চণ্ডীদাসের আদর্শ অনুসরণ করেছেন, তেমনি গোবিন্দদাস তাঁর ব্রজবুলি পদের ভাষা, ছন্দ, অলংকারের দিক থেকে বিদ্যাপতির কাছে বিশেষভাবে ঋণী। এমন কি তিনি বিদ্যাপতির কোনও কোনও অসমাপ্ত পদ সম্পূর্ণ ক'রে ভণিতায় বিদ্যাপতির সঙ্গে নিজ নামও ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ভক্তির গাঢ়তা ও অনুভূতির গভীরতা বিচার করলে শিষ্য গুরুকেও মাঝে মাঝে ছাড়িয়ে গেছেন তা স্বীকার করতে হবে।


সর্বোপরি চৈতন্য প্রভাবে পূর্ব ভারতে যে ধরনের সাধনতত্ত্ব প্রচারিত হয়েছিল, গোবিন্দদাস তাতে দীক্ষিত হয়েছিলেন। সুতরাং তাঁর ভক্তিনম্র আবেগ যে ভাবগভীরতা সৃষ্টি করেছে, তাঁর প্রায় দুশ বছর পূর্বে আবির্ভূত বিদ্যাপতির পদে তা আশা করা যায় না। অবশ্য ভাষা ভঙ্গিমার প্রতি অত্যাধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে গোবিন্দদাস কোনও কোনও পদে কিছুটা কৃত্রিমতার সৃষ্টি করেছেন। উত্তর চৈতন্যযুগের বৈষ্ণব পদের এটি সাধারণ লক্ষণ। তাঁর কোনও কোনও পদে ভক্তি ও সাধনার গতানুগতিক পথ নির্দিষ্ট হয়েছে। যে সকল পদে গভীর আবেগ অনুপস্থিত। সে যাই হোক, মধ্যযুগের গোবিন্দদাস যে এখনও বাংলাদেশের রসিক সমাজে বেঁচে আছেন তার কারণ ভাবে, ভাষায় ও অনুরাগে এখনও তিনি একালের মানুষের মনে আনন্দ সঞ্চারে সমর্থ।


অতএব চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য যেমন জ্ঞানদাস, তেমনি বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য গোবিন্দদাস। তথাপি চণ্ডীদাসে ও জ্ঞানদাসে যেমন পার্থক্যও আছে, তেমনি বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাসের মধ্যেও পার্থক্য বিদ্যমান।