“যা শ্রেষ্ঠ কাব্য তার প্রকৃতিই হচ্ছে বাচ্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া। শব্দার্থমাত্র যেটুকু প্রকাশ হয়, সেই কথাবস্তু কাব্যের প্রধান কথা নয়”—আলোচনা করো।

"শ্রেষ্ঠকাব্য নিজের বাচ্যার্থে পরিসমাপ্তি না হয়ে বিষয়ান্তরে ব্যঞ্জনা করে। আলংকারিকেরা কাব্যের এই বাচ্যাতিরিক্ত ধর্মান্তরের অভিব্যঞ্ছনার নাম দিয়েছেন ধ্বনি।"—আলোচনা করো।


শব্দার্থের উপর কোনো কবিতারই তার কাব্যত্ব নির্ভর করে না। জীবনানন্দের 'বনলতা সেন' কবিতার কথাই স্মরণ করা যাক; কবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকের শেষাংশে রয়েছে—


তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন? 

পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।


শব্দের অভিধাগত অর্থ গ্রহণ করলে ‘পাখির নীড়ের মতো চোখে’-র অর্থ কাব্যত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। কবি এখানে যা বলতে চেয়েছেন—তা এই শব্দগুলির বাচ্যার্থকে ছাড়িয়ে গেছে। কাব্যের যা সার অর্থ কবি এখানে বোঝাতে চাইছেন—তা শব্দার্থের জ্ঞানের দ্বারা লভ্য নয়। কবি বলেছেন—যে ক্লান্ত পুরুষ—যার জীবনের চারিদিকে সফেন সমুদ্র, সেই পুরুষের জীবনের আশ্রয়স্বরূপ বনলতা সেন। পাখি যেমন সমস্ত দিনের পর ক্লান্ত সঞ্চরণ শেষে নীড়ে ফিরে আসে, আশ্রয় পায়, বিশ্রাম পায়, শান্তি পায়, তেমনি বনলতার চোখে সেই আশ্রয়, বিশ্রাম ও শান্তি বিকীর্ণ হতে দেখা গেল। তাই এই উপমার প্রতীয়মান অর্থ, শব্দার্থের যা বাচ্যার্থের গণ্ডি পার হয়ে বাচ্যাতিরিক্ত ব্যঞ্জনার মধ্যেই নিহিত।


মহাকবিদের বাণীতেই এই বাচ্যার্থ ছাড়িয়ে যাবার ব্যাপারটা থাকে। রমণীদেহের লালিত্য যেমন তাঁর নিখুঁত দেহাবয়ব—সংস্থানের অতীত কোনো বস্তু, কাব্যের প্রতীয়মান অর্থও তাই শ্রেষ্ঠ কাব্য নিজের বাচ্যার্থে পরিসমাপ্ত না হয়ে বিষয়াত্তরের ব্যঞ্জনা করে। কাব্যের অর্থ বা শব্দ তখন অপ্রধান হয়, প্রতীয়মান অর্থ প্রধান রূপে ব্যঞ্জিত হয়। ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ' প্রসঙ্গে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।


এই প্রসঙ্গে ডক্টর সুধীরকুমার দাশগুপ্ত কর্তৃক প্রদত্ত একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে—

সুদূর গগনে কাহারে সে চায়?

ঘাট ছেড়ে ঘট কোথা ভেসে যায়? 

নব মালতীর কচিদলগুলি

আনমনে কাটে দশনে।


'ক্ষণিকা' কাব্যের নববর্ষা কবিতার অন্তর্গত। বাচ্যার্থ এখানে স্পষ্ট, তাতে কিছুমাত্র মহোহারিত্ব নেই। কিন্তু নব বর্ষার বর্ণনা প্রসঙ্গে পঙ্ক্তিটি পড়লেই মনে আসে বিরহিণী বধূর চিত্র, ঘট নিয়ে ঘাটে গেছে সে জল আনতে, বধূ আনমনা; সে ভাবছে প্রবাসী প্রিয়তমার কথা, এদিকে বাতাসের হিল্লোলে ঘট কোথায় ভেসে গেল। বাচ্যার্থকে ছাড়িয়ে চমৎকার ব্যঙ্গার্থ কবি সৃষ্টি করলেন।


তাই বলা হয় যে শ্রেষ্ঠ কাব্য নিজের বাচ্যার্থে পরিসমাপ্ত না হয়ে বিষয়াত্তরের ব্যঞ্জনা করে। আলংকারিকেরা কাব্যের এই বাচ্যাতিরিক্ত ব্যঞ্জনার নাম দিয়েছেন ধ্বনি।