‘গৌরচন্দ্রিকা’ কাকে বলে? গৌরচন্দ্রিকার সঙ্গে গৌরবিষয়ক পদের তুলনামূলক আলোচনা করো। সব গৌরবিষয়ক পদই কি গৌরচন্দ্রিকা?

সাধারণভাবে 'গৌরচন্দ্রিকা' কথাটির অর্থ গৌরাঙ্গদেব বিষয়ক যে কোন আলোচনা। কিন্তু এই সাধারণ অর্থে গৌরচন্দ্রিকাকে গ্রহণ করলে চলবে না। গৌরাঙ্গ বিষয়ক যে পদ রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ কীর্তনের প্রস্তাবনা (ভূমিকা বা মুখবন্ধ) হিসাবে গাওয়া হয়, বৈষ্ণেবেরা তাকেই ‘গৌরচন্দ্রিকা' বলেন।


শব্দটি পালাকীর্তন গায়কদের রীতি থেকে পদাবলী সাহিত্যে প্রবেশলাভ করেছে। পালাকারেরা রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক অপরূপ প্রেমলীলাকে আদ্যন্ত ধারাবাহিক বর্ণনার জন্য পালা রসপর্যায়ে ভাগ করে নিতেন। যেমন পূর্বরাগ, রূপোল্লাস, অভিসার, মান, বিরহ, আক্ষেপানুরাগ, মাথুর ইত্যাদি। কীর্তনীয়া রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা গাইবার আগে, লীলাপ্রবেশক গৌরাঙ্গ বিষয়ক এক বা একাধিক গান গেয়ে নিতেন। পালাকীর্তনের প্রারম্ভে লীলাপ্রবেশক ঐ গৌরাঙ্গবিষয়ক গীতকে গৌরচন্দ্রিকা বলে।


কিন্তু কেন তাঁরা এ কাজ করতেন। বৈষ্ণব পদ কীর্তন বা পালাগান চৈতন্যদেবের আগেও প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেখানে গৌরচন্দ্রিকার কোনও পর্ব ছিল না। সুকুমার সেনের মতে জয়দেবের সময় থেকে মিথিলায় ও বাংলায় যে কীর্তনরীতি চালু ছিল, নরোত্তম দাসই তার আধারে নতুন পালাকীর্তন ধারা রচনা করেন। ইতিমধ্যে চৈতন্যদেব তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনেই গোটা দেশের বৈষ্ণবচিত্তার আমূল বিবর্তন এনেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা এক চৈতন্যের মধ্যেই রাধাকৃষ্ণের সম্মিলিত রূপ দেখতেন। তাঁর ঐশী প্রেমে ভাবব্যাকুল রূপে তাঁরা রাধা ভাবেরই দ্যোতনা দেখবেন। চৈতন্যদেব তাঁদের কাছে রাধাকৃষ্ণ ভাবলীলার মূর্তিমান বিগ্রহ হয়ে দাঁড়ালেন। রাধাকৃষ্ণের প্রেম কাহিনি নতুন তাৎপর্যে মণ্ডিত হল। চৈতন্যের ভাবমূর্তি অনুসরণ করেই যেন তাঁরা সেই অলৌকিক ভাবরসে অবগাহন করতে পারলেন। আমরা বাসু ঘোষের পদে পাই-

রাধার মহিমা প্রেমরসসীমা জগতে জানিত কে।।

মধুরবৃন্দাবিপিনমাধুরী প্রবেশচাতুরী সার।

বরজযুবতী-ভাবের ভকতি শকতি হইত কার।।


শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত পাঠে জানা যায় চৈতন্যের শেষ জীবন কেটেছে নিত্য দিব্যোন্মাদনায়। তাঁর অন্তরঙ্গ পারিষদ সুধাকণ্ঠ কীর্তনগায়ক মুকুন্দ তখন সময়োচিত কীর্তন গান গাইতেন।


প্রভুর অন্তর মুকুন্দ ভালমতে।

ভাবের সদৃশ পদ লাগিল গায়িতে।।

‘ভাবের সদৃশ’ বলতে অবশ্য চৈতন্য ভাবের অনুরূপ রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ। এটা অবশ্য গৌরচন্দ্রিক নয় বরং তার বিপরীত রীতি। কারণ মকুন্দ গৌরচন্দ্রের ভাব সাদৃশ রাধাভাবের পদ গাইতেন আর গৌরচন্দ্রিকায় রাধাভাব সাদৃশ গৌরভাবের পদ গাওয়া হয়। শ্যামাপদ চক্রবর্তীর অনুমান চৈতন্যজীবনের এই ঘটনার মধ্যেই গৌরচন্দ্রিকা ভাবনার বীজ লুকানো আছে। এ থেকেই গৌরচন্দ্রিকার উদ্ভব হয়েছে।


গৌরচন্দ্রিকা গাওয়ার নেপথ্যে ইতিহাস যাইহোক, পালা গায়কেরা একে লীলা প্রবেশক সঙ্গীত হিসাবেই গাইতেন। চৈতন্য ভাবনা মনের স্বাভাবিক আবিলতামুক্ত অলোচ্য ভাবরসাত্মক মানস পরিবেশে গড়ে দিত। তাতে রাধাভাব গ্রহণ করা সহজ হত বলে বিশ্বাস করতেন পালা গায়কেরা।


বিষয়টাকে অনেকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, দেবপূজারম্ভের আগে অধিবাসের আয়োজন থাকে। অধিবাসে দেবতার প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য মন্ত্রোচ্চারণ করতে হয়। এমনিভাবে মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা না করে কেউ পূজা করেন না—তাতে পূজা সফল হয় না। খেতুরী মহোৎসবে নরোত্তম দাস ঠাকুরও তেমনি প্রথম গৌরপদ গেয়ে পালাকীর্তন শুরু করেন। সেই থেকে ক্রমে পালাকীর্তনের সূচনায় সমভাবের গৌরপদ বা ‘গৌরচন্দ্রিকা' গাওয়ার প্রথা প্রবর্তিত হয়। শ্রোতা, গৌরচন্দ্রিকা শ্রবণমাত্রেই বুঝতে পারেন বৃন্দাবনলীলার কোনও পর্যায়টি আসরের আলোচ্য বিষয়। দু'একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। পালাকার যখন গান ধরেন,—

আজু হাম কি পেখলু নবদ্বীপচন্দ। 

করতলে বদন করই অবলম্ব।।

খনে খনে গতাগতি করু ঘরপস্থ।

খনে খনে ফুলবনে চলই একস্ত।। 

—রাধামোহন।


তখন এই গৌরচন্দ্রিকা শ্রোতার মানসনয়নে ফুটিয়ে তোলে পূর্বরাগে রাধার চিত্তের ঔৎসুক্য-উদ্বেগের চিত্র। রাধার পূর্বরাগের ব্যঞ্জনাময়ী এই গৌরচন্দ্রিকার আখর দিয়ে কীর্তনীয়া অনায়াসে বৃন্দাবনলীলায় প্রবেশ করেন,—

ঘরের বাহিরে    দণ্ডে শতবার

তিলে তিলে আইসে যায়।

মন উচাটন    নিশাস সঘন

কদম্ব কাননে চায়।


গৌরাঙ্গদেবের পবিত্র জীবন কথা এইভাবে ভূমিকারূপে উপস্থিত করে কীর্তনীয়া শ্রোতাদের মনে ইন্দ্রিয়স্পশার্তীত এক পরিমণ্ডল গঠনের প্রত্যাশা রাখেন। এখানেই গৌরচন্দ্রিকার সার্থকতা।


উদ্ধৃত উদাহরণে রাধাভাবে ভাবিত চৈতন্যের রূপ কল্পিত হয়েছে। কৃষ্ণভাবে ভাবিত গৌরপদও বহুসংখ্যায় রচিত হয়েছে। তবে সেগুলি প্রধানতঃ কৃষ্ণের বাল্যলীলাদি সংক্রান্ত। বাৎসল্য, সখ্য ইত্যাদিতেই গৌরচন্দ্রিকায় কৃষ্ণভাব। প্রেমলীলার ক্ষেত্রেও গৌরচন্দ্রিকায় কৃষ্ণভাবের পদ আছে তবে তা প্রধানতঃ দানলীলা, নৌকাবিলাস ইত্যাদি বিষয়ে। চৈতন্যদেব প্রধানতঃ বিপ্রলম্ভের—মাথুর বিরহের রাধাভাবান্বিত। তা হলেও ক্ষেত্রবিশেষে মাথুরেও কৃষ্ণভাব আরোপিত। যেমন, গোবিন্দ ঘোষ যখন লেখেন,—

হেদে রে নদীয়াবাসী কার মুখ চাও। 

বহু পসারিয়া গোরাচান্দেরে ফিরাও।


তখন পদখানিতে শ্রীগৌরাঙ্গের নদীয়া ত্যাগে নদীয়াবাসীর বেদনা বর্ণিত হলেও কৃষ্ণের বৃন্দাবন ত্যাগে ব্রজবাসীদের বেদনার যোগ্য গৌরচন্দ্রিকা । যোগ্যপদ নির্বাচিত হলে গৌরচন্দ্রিকা সত্যিই বৃন্দাবনলীলা প্রবেশক।


যদিও গৌরাঙ্গকে নিয়ে রচিত সবপদই গৌরচন্দ্রিকা নয়। কিন্তু গৌরচন্দ্রিকাগুলিও গৌরপদ অর্থাৎ গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ। বহু মহাজন চৈতন্যদেবের বিষয়ে বহু পদ রচনা করেছেন। এগুলি খাঁটি গৌরপদ। কিন্তু যেগুলি গৌরপদ হয়েও রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার ব্যঞ্জনা বহন করে সেগুলিই গৌরচন্দ্রিকার পদ। ব্যাপক অর্থে সবপদই গৌরপদ—বিশেষ অর্থে তাদের মধ্যে কোন কোনটি গৌরচন্দ্রিকা। যেমন,—

পরশমণির সাথে   কি দিব তুলনা রে

পরশ ছোঁয়াইলে হয় সোনা।

আমার গৌরাঙ্গ গুণে    নাচিয়া গাহিয়া রে

রতন হইল কত জনা।।

বা—

পতিত হেরিয়া কাঁদে স্থির নাহি বাঁধে

করুণ নয়নে চায়।

নিরুপম হেম জিনি    উজোর গোরাতনু 

অবনী ঘন পড়ি যায়

বা—

পাগলিনী বিষ্ণুপ্রিয়া ভিজা বস্ত্রচূলে 

ত্বরা করি বাড়ী আসি শাশুড়ীর বলে। 

বলিতে না পারে কিছু কাঁদিয়া ফাঁফর 

শচী বলে মাগো এত কি লাগি কাতর।


এই তিনটি উদ্ধৃত পদের কোনটিতেই রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার কোনও ব্যঞ্জনা নেই। এ পদগুলি একান্তই চৈতন্যজীবন চিত্র। এগুলিকে কৃষ্ণ-রাধার প্রেমলীলার রস প্রবেশক হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। এগুলিতে পালাকীর্তনের কোনও রস পর্যায়েরও ইঙ্গিত নেই। এ জন্য এগুলি খাঁটি গৌরপদ—গৌরচন্দ্রিকা নয়। কিন্তু পূর্বে উল্লেখিত রাধামোহন বা গোবিন্দ ঘোষের পদ গৌর বিষয়ক পদ বা গৌরপদ হয়েও রাধাকৃষ্ণ লীলাসূত্রে ধরিয়ে দেওয়ায় গৌরচন্দ্রিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে।