‘পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে শশী চরিত্রের দ্বন্দ্ব জটিলতা ব্যাখ্যা করো।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা' আসলে মানুষ অন্বেষণের উপন্যাস, সেই মানুষ খুঁজে বেড়িয়েছে শশী তার সারাজীবনব্যাপী। গাওদিয়া গ্রামের ডাক্তার শশী বাড়ি ফেরার পথে বজ্রাঘাতে মৃত হারুর দেহটি তুলে নেয় তার নৌকায়। গ্রামের লোকজনদের সাহায্য সহযোগিতায় তার সংস্কারের ব্যবস্থা করে, এই বিশেষ মানসিকতার প্রকাশ মেলে শশী ডাক্তারের চরিত্রের মধ্যে উপন্যাসের প্রারম্ভে। তাই শুরুতেই তিনি সমাজ সংস্কারক রূপে প্রতিভাত। শশীর মধ্যে প্রকট হয়ে ওঠে সমাজ সংস্কারধর্মী প্রবণতার দিকটি। ঘরে বাইরে প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে তাকেও লড়তে হয়েছে। সে বহুবার ভেবেছে গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে শহরে। শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। শাসন শোষণ অবক্ষয়ে গ্রামীণ কদর্য কুৎসিত চেহারা কাটিয়ে ওঠার সাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন ‘পল্লিসমাজের’, রমেশ। আর শশী ডাক্তার অবশ্য আধুনিক ব্যক্তি মানুষের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গ্রামীণ হাসপাতালে থেকে যায় এবং মানুষ অন্বেষণে জীবন জুড়ে সাধনা করতে থাকে। তার মনে হয়েছে বজ্রাঘাতে ঝলসে যাওয়া হারু ঘোষের মতোই সমাজের অবস্থাটা। হারু ঘোষের মৃত্যু সংবাদ, তার মৃত্যুর বিষাদময়তার মধ্যে যে দীর্ঘ পথপরিক্রমা এর মধ্যে শশীর চোখ মানুষের অনুসন্ধানে ব্রতী। শশীর চোখ খুঁজিয়া বেড়ায় মানুষ। শশীর মনুষ্যত্ব বোধ ও প্রকৃত মানুষ অন্বেষণের কাহিনি হল ‘পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাস।


রক্তমাংসে গড়া শশী সজীব মানুষ চরিত্র। মানুষের মধ্যে কল্পনা, ভাবাবেগ, যেমন থাকে তেমনি থাকে বাস্তববাদী বিষয়ী বুদ্ধিবোধ। শশীর মধ্যে এই দ্বিবিধ দিকের উপস্থিতি স্পষ্ট রূপে লক্ষ্য করা গেছে বলে সে এই ধূলি ধূসর বাস্তব পৃথিবীর যথার্থ একটি মানবিক আবেদনে ভরপুর চরিত্র হয়ে পরিবেশিত হয়েছে। ঔপন্যাসিক লিখেছেন : “শশীর চরিত্রে দুটি সুস্পষ্ট ভাগ আছে। একদিকে তাহার মধ্যে যেমন কল্পনা, ভাবাবেগ ও রসবোধের অভাব নাই, অন্যদিকে তেমনি সাধারণ সাংসারিক বুদ্ধি ও ধনসম্পত্তির প্রতি মমতাও তাহার যথেষ্ট।” এই শশী চরিত্রের মধ্যে ঔপন্যাসিক স্বাতন্ত্র্যের সাক্ষ্য রেখেছেন। এমনকি বাংলা কথাসাহিত্যের তিন খ্যাতনামা শিল্পী বঙ্কিম, রবীন্দ্র-শরৎ সাহিত্যের নায়কদের সঙ্গে শশীকে এক করা চলে না। সমালোচক নিতাই বসু বলেছেন : “ এ উপন্যাসের মূল নায়ক শশী ... সে গ্রামের তরুণ চিকিৎসক, গ্রাম্যজীবন, তার চরিত্রগুলি, পারিপার্শ্বিকতা, সংস্কার ও স্বার্থপরতা, স্নেহ ও কুটিলতা, প্রেম ও প্রতারণা—সবকিছুরই প্রাণকেন্দ্রে শশীর অবস্থান। সে লেখকের অন্যান্য মধ্যবিত্ত নায়কদের মধ্যে যথার্থই কালোচিত অন্তর্দ্বন্দ্বের ভারে পীড়িত।” শশী চরিত্র সমীক্ষার এ জাতীয় মন্তব্যের দ্বারা যথার্থ সত্যের স্বীকৃতি মেলে। বাস্তবিক পক্ষে শশী চরিত্র হল সুগণচেতনা মানসিকতার যথার্থ সৃষ্টি সম্পদ।


উপন্যাসের কাহিনিধারা নিয়ন্ত্রণে শশী চরিত্রের ভূমিকা অসাধারণ। অন্যান্য চরিত্রগুলির সঙ্গে শশীর চরিত্রের নানাবিধ সম্পর্কের বন্ধন লক্ষ্য করা যায়। সে অন্যান্য চরিত্রের দ্বারা মূলত প্রভাবিত। একজন সজীব চরিত্রের বোধ হয় এটাই সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য। শশী ডাক্তারের প্রাথমিক পরিচিতি সে গোপাল দাসের একমাত্র পুত্র। গ্রামের ছেলে সে। গ্রাম্য নরনারীর মধ্যে গ্রাম্য জলবায়ুর সান্নিধ্যে গ্রামের ধুলো মাটি গায়ে মেখে সে মানুষ। এই শশী যখন কলকাতায় মেডিকেল কলেজে পড়তে গেল তখন তার মধ্যে গ্রাম্যতা পুরোপুরি লক্ষ্য‌ করা গেল। কুমুদের প্রভাব শশী অকপটে স্বীকার করেছে। ঔপন্যাসিকের ভাষায় সান্নিধ্যে এল সে। বন্ধু কুমুদ শশীকে নূতন করে গড়ে তুলতে চাইল। তার একটিমাত্র বন্ধুর প্রভাবে শশী একেবারে বদলে গেল। বাবা গোপাল তার মনে অন্ধকারত্ব এনেছিল, বন্ধুর প্রভাবে তা দূরীভূত হয়ে গেল। “যে দুর্গের মধ্যে গোপাল তাহার মনকে পুরিয়া সিল করিয়া দিয়াছিল, কুমুদ তাহা একেবারে ভাঙিয়া ফেলিতে পারিল না বটে কিন্তু অনেকগুলি জানালা-দরজা‌ কাটিয়া আলো বাতাস আনিয়া দিল।”


শশী ডাক্তার হলেও মিশুক চরিত্র। গ্রামের সবার সঙ্গেই সে সুসম্পর্কের বন্ধন গড়ে তুলতে চায়। প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার মধুর সম্পর্কের নানা চিত্র পাওয়া যায়। বিশেষ করে পরকল্যাণকামী প্রবণতার জন্য সে গ্রামের সাধারণ জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছে। হারু ঘোষের বাড়ির সঙ্গে তার নিবিড় পরিচয়ের দিকটি উপন্যাসে স্পষ্ট। হারু ঘোষের মেয়ে মতির কাছে শশী দেবতুল্য। হারুর ছেলের বউ কুসুম ডাক্তার তথা ছোটোবাবু শশীকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখে। শশী ও কুসুমের মধ্যে প্রেমের একটা দুর্বোধ্য রহস্যময় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। রহস্যময়ী কুসুম ও শশীর দুর্বোধ্য জটিল সম্পর্কের মধ্যে শশী চরিত্রের বিশেষ দিকটি পরিস্ফুট। প্রথম দিকে শশীর জীবনে কুসুম উপেক্ষিত ও অবহেলিত। কুসুম উপবাসী হৃদয় মন নিয়ে বার বার শশীর দ্বারস্থ হলেও শশী দুঃসাহসের সঙ্গে কুসুমকে ডাক দিতে পারেনি। যখন শশী ডাক দিয়েছে তখন কুসুমের মনন যৌবনে ভাটার টান। বিপর্যয়ের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে শশী বেপরোয়া হয়। এটা আসে তার প্রেমের দুঃসাহসিক প্রবণতা থেকে। কুসুমকে নিয়ে সে গাওদিয়া গ্রাম ছেড়ে বহু দূরে চলে যেতে চায়। কিন্তু কুসুম তখন অসম্মতি জ্ঞাপন করে দৃঢ় কণ্ঠে। শশী চরিত্রের পর্যালোচনায় তার প্রেমমনস্কতার দিকটি সবিশেষ তাৎপর্যবাহী।


শশী মনস্তত্ত্ব নির্ভর চরিত্র। অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত সে। আর এটা কেন্দ্রীভূত হয়েছে গ্রামে থাকা ও গ্রাম ত্যাগ করে যাওয়া সম্পর্কে এবং কুসুমের সঙ্গে তার প্রেম সম্পর্কের বিষয়েও শশী বৈজ্ঞানিক, ডাক্তার, গ্রামের মানুষের সাহায্যে অকৃপণ উদারতার সঙ্গে এগিয়ে যায়। তাদের দুঃখ দৈন্যে ভরা ক্লেদময় জীবন তার গভীর অনুভূতির উদ্রেক করে। শশী এদের সকলের জন্য দুঃখ বোধ করে, তাই সে মানসিক চরিত্র। সমাজের প্রতি সে দায়বদ্ধতার কথা অন্তর থেকে অস্বীকার করতে পারে না। বিবাহিত না হলেও চরিত্রটি পরিবারিক জীবনের নানা বন্ধনে আবদ্ধ। বাবার সঙ্গে তার সংঘাতের সম্পর্ক। বোনের জন্য তার চিন্তার অন্ত নেই। বিন্দুকে সে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে তৎপর হয়ে উঠেছে। বন্ধুর প্রতি তার আচরণের মধ্যেও সামাজিক কর্তব্য নিহিত। যাদব পাগলাদিদি চরিত্র দুটির প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ অনুভূত হয়। সেন দিদির সঙ্গেও সে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে অন্বিষ্ট, কুসুমের সঙ্গে তার প্রেম সম্পর্কের বন্ধন সব মিলিয়ে শশী চরিত্রে একটি উদারধর্মী সামাজিক মানুষ সত্তার পরিচয় বিবৃত।


সংগ্রামের মধ্য দিয়েই শশীর জীবনের সার্থকতা, পিতা গোপাল দাসের সঙ্গে লড়তে হয়েছে তাকে নিরন্তর। সবচেয়ে বেশি লড়তে হয়েছে তার মনের দোলাচল চিত্ততার সঙ্গে। প্রগতিপন্থী হয়েও সে অদৃষ্টের ক্রুর পরিহাসকে অস্বীকার করতে অপারগ। শশীর ভাবান্তর : “নদীর মতো নিজের খুশিতে গড়া পথে কি মানুষের জীবনের স্রোত বহিতে পারে ? মানুষের হাতে কাটা খালে তার গতি, এক অজানা শক্তির অনিবার্য ইঙ্গিতে। মাধ্যাকর্ষণের মতো যা চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়।” তাই কুসুমের অনুপস্থিতে শশী যখন অনুভব করল গাওদিয়া গ্রাম যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, অথচ কুসুমকে ফেরাতে সে কত না প্রচেষ্টা চালিয়েছে কিন্তু‌ সার্থক হয়নি। একরাশ ব্যথা বুকে চেপে নিয়ে বিচরণ করেছে; কিন্তু “তালবনে শশী কখনো যায় না। মাটির টিলাটির উপর উঠিয়া সূর্যাস্ত দেখিবার সখ এজীবনে আর একবারও শশীর আসিবে না।”


তাই তো বলতে হয়, যুগসচেতন শিল্পী মানিক তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে যেসব চরিত্র অঙ্কন করেছেন তাদের মধ্যে যুগধর্মের যথার্থ প্রতিফলন লক্ষিত হয়। পুতুল নাচের ইতিকথায় শশীই তার প্রতিভূ। শশী চরিত্রের নানাবিধ বৈশিষ্ট্য লেখক উপন্যাসের আধারে অনিন্দ্যসুন্দর রূপে পরিবেশন করেছেন। কেবলমাত্র এ উপন্যাসে নয় সমগ্র মানিক সাহিত্যে এমনকি সমগ্র বাংলা কথাসাহিত্যে শশী চরিত্র তার বিশেষত্বের দাবিকে প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছে। সমাজমনস্কতা, পরকল্যাণকামীতা, অন্তর্দ্বন্দ্বের ক্ষতবিক্ষত রূপ, মানুষ অন্বেষক প্রবণতা, কল্পনা প্রবণ ভাবনার সঙ্গে বিষয়ী ভাবনার নিবিড় সমন্বয়, প্রেমমনস্কতা ইত্যাদি বহুবিধ বৈশিষ্ট্যে শশী চরিত্র প্রোজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।