বেলগাছিয়া নাট্যশালা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

বেলগাছিয়া নাট্যশালা

সৌখিন নাট্যশালাগুলির মধ্যে ‘বেলেগাছিয়া নাট্যশালাটি' শ্রেষ্ঠ। এমন রমণীয় মঞ্চসজ্জা, গীতবাদ্য এবং উচ্চাঙ্গের অভিনয় পূর্বে কোনো নাট্যশালায় দেখা যায়নি। পাইকপাড়ার ধনাঢ্য রাজাদের বাগানবাড়িতে বিপুল অর্থব্যয়ে বেলগাছিয়া নাট্যশালাটি নির্মিত হয়েছিল। রাজা প্রতাপচন্দ্র ও রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের পরামর্শে ও উপদেশে এর প্রতিষ্ঠা। বহু নব্য শিক্ষিত বাঙালি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। শ্রীহর্ষের রত্নাবলীর রামনারায়াণকৃত বাংলা অনুবাদের অভিনয় দিয়ে ১৮৫৮ র ৩১ জুলাই-এর দ্বারোদ্ঘাটন হয়। অভিনেতারা ছিলেন সকলেই ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি। মধুসূদনের সহপাঠী গৌরদাস বসাকের স্মৃতিকথা থেকে এখানকার নাট্যশালা এবং তার অভিনয় সম্পর্কে অনেক কথা জানতে পারা যায়।


বেলগাছিয়া রঙ্গালয়েই প্রথম ঐকতানবাদন প্রবর্তিত হয়। ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী ও যদুনাথ পাল ঐকতান দল গঠন করেন। এর দৃশ্য পট অঙ্কন করেছিলেন ইংরেজি শিল্পীরা এবং ইংরাজ তত্ত্বাবধায়কদের মঞ্চ ব্যবস্থাপনার ভার ছিল। গ্যাসের আলোয় পাদপ্রদীপ আলোকিত হয়েছিল। এবং লাইমলাইট প্রক্ষেপণে একটি মোহময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। অতি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন শিল্পী কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় বিদূষকের ভূমিকায় বাচিক ও আঙ্গিক অভিনয়ে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দেন। অভিনয়ে প্রায় দশ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। দর্শকদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত ইংরাজরা থাকায় তাঁদের বোঝাবার জন্য নাটকটির সারাংশ ইংরেজিতে অনুবাদের প্রয়োজন হয়। এই প্রয়োজনেই মধুসূদন দত্তের বেলগাছিয়া নাট্যশালা মঞ্চে সংযোগ। সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা থেকে জানা যায়—সম্ভ্রাপ্ত বহু ইংরাজ রাজকর্মচারী ছাড়াও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামগোপাল ঘোষ, রামনারায়ণ তর্করত্ন, প্রভৃতি বহু ব্যক্তি এই অভিনয়ে উপস্থিত ছিলেন। ৬ থেকে ৭ বার এই নাট্যশালায় 'রত্নাবলীর' অভিনয় হয়েছিল।


মধুসূদন রত্নাবলীর অনুবাদ করতে গিয়ে বাংলা নাটকের অভাব অনুভব করেন। এবং নিজে নাটক লিখে সেই অভাব পূরণের প্রতিশ্রুতি দেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তাঁর রচিত প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা' বাংলা নাটকে যুগান্তর সৃষ্টি করল। সংস্কৃত নাট্যাদর্শের চিহ্ন থাকা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য নাট্যদর্শকে প্রাধান্য দিয়ে এমন সংহত প্লট রচনা, স্বাভাবিক চরিত্র সৃষ্টি ও অনেকখানি প্রাণময় সংলাপ রচনা পূর্ববর্তী কোনো নাটকে দেখা যায়নি। ১৮৫৯-এর ৩ সেপ্টেম্বরে বেলগাছিয়া নাট্যশালায় শর্মিষ্ঠার অভিনয় হল মহাসমারোহে। ২৭ সেপ্টেম্বর হয় এর যষ্ঠ অভিনয়। সংস্কৃত নাট্যাদর্শকে সম্পূর্ণ বর্জন করা মধুসূদনের পক্ষে যে সম্ভব হয়নি, তার কারণ সেকালের দর্শকদের কথা ও বেলগাছিয়। মঞ্চের অভিনেতাদের কথা তাঁকে মনে রাখতে হয়েছিল। তাছাড়া 'রত্নাবলী'র ইংরাজি অনুবাদ করতে গিয়ে ভারতীয় নাটকের আদর্শও তাঁকে অজ্ঞাতে অনেকখানি আকৃষ্ট করেছিল। ইংরেজ দর্শকদের জন্যে নাটকের একটি ইংরেজি অনুবাদও তিনি করেছিলেন।


‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের পর এ নাট্যশালায় আর কোনো নাটকের অভিনয় হয়নি। ১৮৬১-র ১৯ মার্চ রাজা ঈশ্বরচন্দ্রের অকাল প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে বেলগাছিয়া নাট্যশালার উজ্জ্বলদীপ চিরতরে নির্বাপিত হয়ে গেল। নাট্যরসিকের চিত্তে এ রঙ্গমঞের স্মৃতিটি অম্লান হয়ে থাকবে। মধুসূদন এখানকার দুই রাজার কথা স্মরণে রেখে বলেছিলেন— “ইহারাই আমাদের উদীয়মান জাতীয় বেলগাছিয়া নাট্যশালার প্রথম উৎসাহদাতা”। গৌরদাস বসাকও এই নাট্যশালার মূল্যায়নের কথায় বলেছিলেন— "It achieved a Success unparalleled in the annals of Amateur Theatricals in this Country."