শাক্তপদাবলী : সমাজভাবনা : আগমনী ও বিজয়া

‘মা’, এই শব্দটি একাক্ষর, কিন্তু এর ব্যঞ্জনা বিশ্বপ্লাবী এবং অনস্ত মহিমাব্যঞ্জক। বাঙালী মাতৃপাগল জাতি। “মা বলিতে প্রাণ করে আনচান চোখে আসে জল ভরে”–এ অনুভূতি একান্তভাবেই বাঙালীর মমতামথিত অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞান। এদেশে মাতৃ-আরাধনার প্রথা অনাদি কালের—“From time immorial India is the home of the Prakiti or later Sakti ('Hist of Ancient India'– R. S. Tripathi)” আর্যেতর জাতিই মাতৃপূজার প্রথম প্রবর্তক। সৃষ্টির মূলে পালনীশক্তিরূপে জননী বা মাতৃদেবতাই ছিলেন প্রথমা ও প্রধানা। একই আঁধারে তিনি বিশ্বাত্মক ও বিশ্বোত্তীর্ণা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও শক্তি পুরাণের প্রধান প্রতিমা, কিন্তু সর্বত্রই শক্তির একচ্ছত্র প্রভাব। ব্রহ্মার শক্তিরূপে তিনি ব্রহ্মাণী, বিষ্ণুর শক্তিরূপে বৈষ্ণবী আর শিবশক্তি রূপে তিনি শিবানী। মাতৃতান্ত্রিক জাতির বসবাস বলে বাংলাদেশের ধর্মে-কর্মে, আচার-অনুষ্ঠানে ও সাহিত্যে মাতৃভাবের নির্বাধ প্রাধান্য দেখা যায় : “দেবতারে মোরা আত্মীয় জানি।” তাই আমাদের ধর্ম শুধু জ্ঞানমাত্র নয়, তা ভাব-রসের অফুরন্ত উৎস। (প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে, শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন : “আমাকে রসে বশে রাখিস মা, শুখনো সন্ন্যাসী করিস নে।”) সচ্চিদানন্দ পরম কারণ, এখানে মাতৃরূপে কল্পিত। ‘রসো বৈ সঃ’— তিনিই রসস্বরূপ। লৌকিকভাবের উপরেই এই রসের প্রতিষ্ঠা। অখিল রসামৃত সিন্ধু’ এখানে রসবিন্দুরূপে উদ্ভাসিতা।


আমাদের মজ্জাগত মাতৃভাবাসক্তি পরাশক্তিকে কন্যা ও জননী রূপে কল্পনা করে বাৎসল্য ও প্রতিবাৎসল্যের রসে উদ্বেলিত হয়েছে। মৌখিক সম্পর্কের মধুর নিগড়ে বাঁধা পড়ে অব্যক্ত অচিন্ত্যতত্ত্ব জননী বা কন্যারূপে প্রতিভাত। শাক্তপদাবলীর বাল্যলীলা, আগমনী ও বিজয়ার গানগুলি জননী ও সন্তানের হৃদয়-মন্থন-উদ্ভূত অমৃত। এই পদাবলীর শক্তিতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব বিষয়ক গানগুলিও কেবল তত্ত্ব নয়, মা ও ছেলের অনুরাগ-অভিযোগের প্রাবল্যে সাধন-বিষয়ক গানও হয়ে উঠছে রসায়িত।


যার আনন্দলীলায় প্রপঞ্চ জগৎ আনন্দময়, শাক্তপদাবলীতে সেই ‘নিত্য নিরঞ্জিনী ভবভয়ভঞ্জিনী’ গৃহজননীও কন্যারূপে কল্পিতা। বাল্যলীলা, আগমনী ও বিজয়ার গানগুলোতেও জগৎজননীর অনন্ত লীলা-মাধুরী বর্ণিত। দেবতার যত লীলা সেগুলির মধ্যে সর্বোত্তম নরলীলা। মানুষী লীলায় তিনি মানুষের মত দেহধারণ করেন, মানুষের ভাব ও আচরণ প্রকাশ করে হন মানুষের মতই স্নেহ-প্রেমে বন্দী। কেননা বন্ধনের ক্রন্দনেই আনন্দের স্পন্দন অনুভূত হয়। ভগবতীর অনন্ত মাধুরী লীলা জননী ও কন্যা সম্পর্কের মধ্যে এখানে প্রকাশিত। এই লীলা পর্ব পৌরাণিক কাহিনীর গার্হস্থ্য বাণীরূপ।


বাল্যলীলা, আগমনী ও বিজয়ার গানগুলিতে বাংলাদেশের চির চেনা পারিবারিক আলেখ্য চিত্রিত। এই চিত্র জীবনের কান্না হাসির স্পর্শে মনোগ্রাহী। দুটি পরিবারের কাহিনী এখানে লভ্য; একটি, হিমরাজ ও মেনকার সংসার, অপরটি হর-পার্বতীর। এই দুই পরিবারের স্নেহ, প্রেম, অভিমান, অনুযোগ এই পদাবলীতে রূপায়িত। পিতার সংযত স্থৈর্য ও গভীর স্নেহ, প্রতিবেশীর সমালোচনা ও কলকোলাহল সবই বিচিত্র রাগিণীতে এখানে ঝঙ্কৃত। মহাদেব ও উমা অলৌকিক মহিমা-বিনির্ভর আমাদের অতি চেনা সংসারের স্বামী স্ত্রী। মহাদেব দারিদ্র্য গৃহী—ভিক্ষা নিয়েই তাঁর সংসার চলে। তিনি নেশাখোর অথচ উমা-অস্ত প্রাণ। উমা একদিকে পতিব্রতা স্ত্রী, অন্যদিকে মাতৃবৎসল অভিমানী কন্যা। পিতৃগৃহে যেতেও তিনি শিবের অনুমতি প্রার্থনা করেন : “কর অনুমতি হর যাইতে জনক ভবনে”, “গিয়ে তিনদিন জন্যে রব পিত্রালয়ে”। কন্যারূপিণী উমার চিত্রটি অসাধারণ বাস্তব। কৈক্লাসে থেকেও তাঁর মনে পড়ে : “মায়ের ছলছল দুটি আঁখি।” কৈলাস থেকে মায়ের কাছে এসেই মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে তার উচ্ছ্বসিত অভিমান

“কৈ মেয়ে বলে আনতে গিয়েছিলে 

তোমার পাষাণ প্রাণ আমার পিতাও পাষাণ

জেনে, এলাম আপনা হতে।”


স্বামী গৃহে তিনি যে সুখে আছেন তা বলে তিনি মাকে আশ্বস্ত করেন। মা যখন প্রশ্ন করেন

“আমার শিব তো আছেন ভালো”,

উমা তখন—

“চোখে দেয় অঞ্চল

বলে, চোখে কি হল, আমার চোখে কি হল?”

এই চিত্র সম্ভবতঃ বিশ্বসাহিত্যেও বিরলদৃষ্ট। এ চিত্র একান্তভাবে বাঙালী পরিবারের পরিবেশ-শাসিত রুচি-নিষ্ঠার স্মারক।


পরিবারের কর্তারূপে গিরিরাজ হিমালয় সংযত, ধৈর্যশীল ও যুক্তিবাদী। প্রতিবেশীর সমালোচনাতেও তিনি প্রশান্ত-অচল। উমাকে আনতে গিয়ে চিরকালের পিতার ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ-

“চল মা, চল মা গৌরী, গিরিপুরী শূন্যাগার 

মা হলে জানিতে উমা, মমতা পিতা মাতার।”


কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে মা মেনকার স্নেহ-বাৎসল্য। কবি কুমুদরঞ্জনের ভাষায় যেন “মা মেনকার অশ্রুধারায় বিশাল গিরীশ পড়ল ঢাকা”।


তার বাৎসল্যে স্নেহের অমর-মহিমা বিঘোষিত। কন্যার জন্য জননীর অশ্রু ধারায় ও মাতৃস্নেহের সুধারসে আগমনী ও বিজয়ার গানগুলি অভিষিক্ত।

“কাদিয়ে ফুললে আঁখি মলিন ও সুখ দেখি 

মায়ে ইহা সহিতে কি পারে?”—


শিশু উমার প্রতি এই হল মেনকার স্নেহ। পতিগৃহগত কন্যার জন্য মায়ের চিত্ত অধীর। স্বপ্নে উমা এসে মায়ের কাছে বলে : “আধো আধো মা বলে বচনে সুধাধার”।


নারদ এসে জানান কৈলাসে বড় দুঃখে উমার দিন কাটে। জননীর অন্তর মথিত করা মর্মন্তুদ প্রশ্নে বেদনার বাণী উচ্চারিত হয়

“ওহে গিরি, কেমন কেমন করে প্রাণ 

এমন মেয়ে কারে দিয়ে হয়েছ পাষাণ।”


কখনও অস্থির অশান্ত মন বলে ওঠে “শুনছি তারাকে নাকি পাঠাবে না তারা” কিংবা “শিবের নাহিক পিতামাতা কে জানিবে মায়ের ব্যথা।” প্রতিবেশী অনুযোগ করে— “মেয়েকে ফেলিলে জলে”। মায়ের মন এসব কথায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এ মা যেন আমাদের সংসারেরই মা।

মেনকা ও উমার মিলনদৃশ্য সাহিত্যে দ্বিতীয়রহিত। এই মিলন অশ্রু পরিশুদ্ধ। বাঙালীর ঘরোয়া চিত্রের অনুকরণে পরিকল্পিত। এই চিত্রের আবেদন সর্বজনীন ও সর্বকালীন। মাত্র তিনদিনের জন্যে উমার পিতৃগৃহে আগমন—

“তিনদিন স্বর্ণদীপ জ্বালিতেছে ঘরে”, 


কিন্তু মিলন মুহূর্তে বেজে ওঠে সাহানার করুণ রাগিণী

“ভোলানাথ আসবে নিতে দশমীতে 

এখনই ভাবিতেছি তাই মনে।”


নবমীর রাতে মায়ের সকরুণ প্রার্থনা বিশ্বসাহিত্যেও দুর্লভ

“যেয়ো না রজনী, আজি লয়ে তারাদলে, 

গেলে তুমি দয়াময়ী এ পরাণ যাবে।”


মানুষের চিরকালের অন্তর ভাষ্য—“I will not let thee go” – “যেতে নাহি দিব”। এটাই অপরাজেয় প্রেমের বাণী। কিন্তু হায়, “তবু যেতে দিতে হয়” দশমীতে। গৃহস্থের হৃদয়-বিমথিত বাৎসল্য এখানে পরিস্ফুট।


‘ভক্তের আকুতি’ অংশে মায়ের প্রতি পোয়ের আবদার, অভিমান, অনুযোগ, তিরস্কার ও সরল আত্মসমর্পণ অধ্যাত্মলোকের ভক্তি এবং মর্ত্যপ্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। তাই মায়ের দামাল ছেলে সরল কণ্ঠে প্রশ্ন করে“কি অপরাধ করেছি মা, কেন এত শাস্তি কড়া”, “কোন্ অবিচারে আমার 'পরে করলে দুঃখের ডিক্রী জারি”? অনুযোগ কখনও হয় তীব্র : “যে হয় পাষাণের মেয়ে তার হৃদে কি দয়া থাকে?” কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাতৃচরণ ছাড়া গতি নেই। একান্ত নির্ভরতায় ছেলে এসে শুধোয়

“সারা দিন করেছি মাগো সঙ্গী হয়ে ধুলাখেলা।

ধুলা ঝেড়ে নে মা কোলে এসেছি গো সন্ধ্যাবেলা।”


আশ্বাসের শাখায় এখানে বিশ্বাসের রক্তজবা প্রস্ফুটিত। “দ্বন্দ্ব হবে মায়ের সনে তবু রব মায়ের চরণে”, এই হল সন্তানের একমাত্র বাসনা। লৌকিক জীবনে সজীব ভাবরাজির স্পর্শে অলৌকিক ভক্তি-রসাত্মক শাক্তগীতি মানবজীবনরসে উচ্ছল হয়ে উঠছে। তত্ত্ব তথ্যের খনি হয়ে এই অংশটি তাই রসের ধারায় পাঠক-মনে জলতরঙ্গ বাজিয়ে চলে।


ভক্তের আকুতি : সমাজভাবনা : শাক্ত পদাবলীর অনন্ত মহিমা জ্ঞাপক মাতৃ আরাধনার কাব্যভাষ্য। সামাজিক জীবনের ও লৌকিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ এর অব্যক্ত আচন্ত্যতত্ত্ব শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে জীবনরসঘন কাব্য। সংসার সুধামুখীকে কেন্দ্র করেই শাক্ত কাব্যের কথা ও কাহিনীর বিকাশ। সংসারের বচনে অমৃত, ভোগে বিষ। আপাত রম্য কিন্তু পর্যন্ত পরিতাপী। যাকে বলে দেখ সিঁন্দুরে, রূপসুন্দর কিন্তু অসার। তবু শাক্ত কবি-যাত্রীর দৃষ্টি Wordsworth এর মত মাটির পৃথিবীর দিকেই নিবদ্ধ। বৈষ্ণব কবির কল্পনার ডানায় Shelley-র Skylark-এর মত নীল আকাশের স্বপ্ন। কিন্তু মানুষের প্রতি সহানুভুতির স্নেহ-ডোরে আবদ্ধ বলে শাক্তকবি-সাধকের কল্পনা-পাখি উড়ে উড়ে মাটির পৃথিবীর বন্ধন কাটাতে পারে না। অষ্টাদশ শতাব্দীর সামাজিক জীবনালেখ্য, ক্রীড়া কৌতুক, মামলা-মোকদ্দমা সবই এই পদাবলী অন্তরের সরলতার স্পর্শে স্পন্দিত। কখনো আঘাতে, কখনো আনন্দে, কখনো কড়িতে, কখনো কোমলে মানবমনের হাসি-কান্নার বেদনা এখানে শোনা যায়।


গুহায়িত ধর্ম নয়—যে ধর্ম জীবনের হাসি-কান্নার হীরা-পান্নায় জড়ানো, তাই শাক্তগীতের আশ্রয়। মাতৃকৃপা লাভ করা তাঁদের ধ্রুবলক্ষ্য। তবু সমাজের নির্যাতিত মানুষের প্রতি তাদের মমতা অসীম। সংসার জীবনই তাদের ধর্মসাহিত্যের অবলম্বন। কেননা তারা জানেন, এই সংসার ‘ধোঁকার টাটি’, কিন্তু জ্ঞানলাভ হবার পর, ঈশ্বর দর্শনের পর এই সংসারই আবার ‘মজার কুটি'। তাই শাক্তপদাবলীতে পারিবারিক জীবনের তুচ্ছতিতুচ্ছ বিষয়ের বিবরণ, লোক-লৌকিকতার অভিজ্ঞতা, সমাজচেতনা সবই নিখুঁতভাবে প্রতিফলিত। এদিক দিয়ে শাক্তপদাবলী বিচিত্র বর্ণিল সমাজ জীবনের খুঁতহীন প্রতিবিম্ব।


অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা ও অত্যাচার অবিচারের বেসাতি। যুগটি “মসিল দিয়ে তসিল" করার যুগ। সর্বত্রই জুলুম, কয়েদ ও হিড়িকের যুগ। দিগ্বিজয়ী ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথের তীক্ষ্ণধী মন্তব্য— “Everybody and everything was on sale.” এ চিত্র শাক্তকাব্যে রূপাঙ্কিত। মানুষের ভূমিকায় জগজ্জননীর উদ্দেশে রামপ্রসাদের তাই ব্যথিত জিজ্ঞাসা, কাকে ধরে শোকে-দুঃখে নির্বিচল থাকি, বাধা-বিপত্তি উলঙ্ঘন করি, কোথায় সংগ্রহ করি নবতর সংগ্রামের তেজ। কোথায় হতাশের আলো, নিঃস্বের সম্বল, চিরোৎকণ্ঠিত্বের শান্তি! কে সমস্ত বিবাদের মীমাংসা সমস্ত অন্যায়ের সংশোধন— “কোন্ অবিচারে আমার 'পরে করলে দুঃখের ডিক্রী জারি?” কিংবা—

“প্যাদার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার নামেতে নিলাম জারি,

ঐ যে পান বেচে খায় কৃষ্ণপাত্তি, তারে দিলে জমিদারী,

হুজুরে দরখাস্ত দিতে, কোথা পাব টাকাকড়ি।”


আয়ের ঘরে শস্যহীন মাঠ, ব্যয়ের ঘরে লবণাক্ত বন্যা। তাই সাধক নীলাম্বরের আক্ষেপ—“প্রাতঃকালে উঠি, কতই যে মা খাটি, ছুটাছুটি করি ভূমণ্ডল” কিন্তু সর্বত্রই প্রত্যাখ্যান। মধ্যাহ্নের রৌদ্রে কেউ আনে না এতটুকু ছায়া-স্নেহ। রাশি রাশি নৈরাশ্যের বালুকণায় শুধু বৈফল্যের অনাবৃষ্টি। চারিদিকে শুধু একটানা নিসৃণ মরুবিস্তার। অগাধ বিশ্বাসের স্বচ্ছ সরোবরে সমপর্ণের তর্পণ করে রামপ্রসাদের তাই প্রার্থনা“আমায় দে মা তবিলদারী, আমি নিমক্‌হারাম নই শঙ্করী।” অষ্টাদশ শতকের কালাপাহাড়ী অত্যাচারের প্রেক্ষাপটে দেশের সম্মূঢ়, উৎপীড়িত জনগণের যে চিত্রাঙ্কন শাক্ত পদে সহজলভ্য, তা কোন দেশ-কাল বর্ণিত জীবনের ছবি নয়, চিরকালের অপাংক্তেয় গণজীবনের রক্তাক্ত আলেখ্য। নির্মম ব্যাধের শরাহত ক্রৌঞ্চমিথুনের শোকে আদিকবি বাল্মীকির হৃদয়বেদনা যেমন অনুষ্টুভ ছন্দে অনশ্বর শ্লোক-মূর্তিতে বাঙ্ময়, জনদরদী মাতৃসাধকের বেদনাবিহুল অন্তরের বাণীও তেমনি শাক্তগীতে ছন্দোময়। সাশ্ৰু সহানুভূতিই এর উৎস কেন্দ্র।


সামাজিক যন্ত্রণার উৎকণ্ঠার কণ্টকে হেঁটে হেঁটে শাক্ত-সাধকে। মায়ের চরণ-তীর্থের আশ্রয় লাভের জন্য উন্মুখ। অরণ্যে নয়, বৃক্ষ কোটর নয়, শিহরণময় শৈলশিখরের গহন গুহায় নয়, হাসি-কান্নায় বিচলিত সংসারে বাস করেও মনের মধ্যে জ্বেলেছেন অনাকাঙক্ষার ঘৃতপ্রদীপ। তবু সমাজের মূঢ়, ম্লান, মূক মানুষের চালচিত্রে সাধক কবিরা প্রতিষ্ঠা করেছেন তাদের সৌম্য-সুন্দরী-আর্তহারিণী, সহস্র নয়নোজ্জ্বলা মাতৃমূর্তি। আশ্চর্যের বিষয়, কণ্ঠপীঠে মঙ্গলময়ী মাতৃনাম প্রতিষ্ঠা করে তাঁদের কাব্য তৎকালীন সমাজব্যবস্থার এক নিখুঁত album। জমিদারের খাজনা দিতে অক্ষম দারিদ্র্যদগ্ধ মানুষ শোষণ আর তোষণে জর্জরিত। পেয়াদার শাসন-তর্জনে মানুষ ত্রাসবিকম্পিত। মানুষের বেনামদার হয়ে তাই সাধক-প্রবর রামপ্রসাদের আক্ষেপ

“মলেম ভূতের বেগার খেটে, আমার কিছু সম্বল নাই কো গেঁটে 

নিজে হই সরকারী মুটে, মিছে মরি বেগার খেটে 

আমি দিন-মজুরী নিত্য করি পঞ্চভূতে খায় গো বেঁটে।”


খাজনার দায়ে সম্পত্তি নিলামে ওঠে, আসামীর কাঠগড়ায় অভিনয় হয় বিচারের প্রহসন। কিন্তু তাদের পক্ষে কেউই নেই। “বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাদে।” ফলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়, প্রবঞ্চনার দায়ে আসামীকে ভোগ করতে হয় দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড “তারা, কোন অপরাধে, এ দীর্ঘ মেয়াদে সংসার গারদে থাকি বল”? বন্দীর অবস্থাও অবর্ণনীয়—হাতে শৃঙ্খল, পায়ে বেড়ি, প্রহরীর বেত্রাঘাতে ক্ষতবিক্ষত অঙ্গ,—

“মসিল হয় দূত, তসিল করে কত, দারা-সূত পায়ের শৃঙ্খল

দিয়ে মায়া বেড়ি পদে, ফেলেছ বিপদে, সম্পদে হারালেম মোক্ষফল”।


কিন্তু তবু অদ্ভরের বিষ বেদনার রক্তবিন্দু এ পদাবলীতে রসবিন্দু হয়ে ওঠেনি। শাক্ত সাধকেরা শরণাগতির শান্তিজলে বেদনার ক্ষতে সম্মোহিনী প্রলেপ দান করতে প্রয়াসী

“কুপুত্র অনেক হয় মা, কুমাতা নয় কখনতো 

রামপ্রসাদের এই আশা মা, অস্তে থাকি পদানত।”

কিম্বা—

“ও পদের মত পদ পাইতো, সে পদ লয়ে বিপদ সারি” ইত্যাদি।


শাক্ত কবিদের কাছে মাটির বন্ধন যেন মা-টির বন্ধন। জীবনের গ্লানি মালিন্যের মধ্যে মাটির সম্পর্ক তাঁদের কণ্ঠে অনুরণিত, সামাজিক নাভিস্থান থেকে উত্থিত শোক তাদের কণ্ঠে শ্লোক হয় উচ্চারিত।


ভগবতী ইচ্ছার ব্যাকুলতা প্রকাশই ‘ভক্তের আকুতি'। শ্রদ্ধাবিমিশ্র অভিযোগ ও আক্ষেপই এর ধ্রুবপদ। প্রকৃত শ্রদ্ধা আকুতি প্রকাশের প্রথম সোপান। শ্রদ্ধা থেকে ভক্তি, ভক্তি থেকে প্রেম, প্রেম থেকে আকুতি উত্থিত : “কবে সমাধি হবে শ্যাম-চরণে” কিংবা “প্রাণ মাতিবে প্রেমরসে। মন চলিবে ভক্তিবশে।” মাতৃভাব বা সন্তানভাব—সাধনার শেষ কথা বা সহজকথা। শাক্ত কাব্যে তারই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। শাক্ত কাব্যে ‘বৈধী’ ও ‘রাগানুগা’ দুপ্রকারের ভক্তির গঙ্গা-যমুনা প্রবাহিত। তবু এর মধ্যে পার্থক্য পরিস্ফুট। যোগক্ষেম রামকৃষ্ণদেবের ভাষায়— “সাধারণ লোক সাধন করে, ঈশ্বরে ভক্তিও করে। আবার সংসারেও আসক্ত হয়, কামিনী-কাঞ্চনেও মুগ্ধ হয়। মাছি যেমন ফুলে বসে, সন্দেশে বসে, আবার বিষ্ঠাতেও বসে। নিত্যসিদ্ধ যেমন মৌমাছি, কেবল ফুলের উপর বসে মধুপান করে।” প্রেমের রূপময় পূজাই জগজ্জননীর পূজা। তিনি নিরাকার হয়েও সাকার। তাই ভক্তের আকুতিতে নিরাকার নয়, মহাশক্তির নরলীলা বা সাকারের রূপই মূর্ত। নৈরাশ্য নিয়ে যাত্রা করলেও শাক্ত সাধক Eternal Conscious বা মহত্তর তাৎপর্যের সন্ধিৎসু, পূর্ণতর সৌন্দর্যের পিপাসু, গভীরতর ব্যঞ্জনার রসিক, দিনযাপনের গ্লানির বাইরে মহামায়ার চরণ-দর্শনের অভিযাত্রী। ১৫৭ নং পদে “কেবল আশার আশা, ভবে আসা, আসা মাত্র হলো” অর্থ সকাম খেলা ব্যর্থ হওয়ার নিষ্কামের পথে উল্টা সাধন (ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে চল’) চর্যাপদেও শুনি—“সোণে ভরিতী করুণা নাবী”— সোনা অর্থাৎ শূন্যতায় হৃদয় ভরে গেছে, ইন্দ্রিয়-নির্মুক্ত মন নির্বিকল্পের পথে যাত্রারত। পূর্ণ করা সোজা, শূন্য করাই তপস্যা। কবির ভাষায়, “শূন্য করিয়া রাখ তোর বাঁশি, বাজাবার যিনি বাজাবেন আসি।” ১৭৪ নং পদে “ভালোয় ভালোয় বিদায় দে মা, আলোয় আলোয় চলে যাই” শক্তির মধ্যে দিয়ে ইহজীবনের অস্তিত্ব থাকতে থাকতে অন্ধকারের জরায়ু থেকে আনন্দের সূর্যালোকে যাত্রার সকরুণ বেদনা প্রকট। ১৮৭ নং পদে “চাই না আমি বড় হতে। আমি আর পারিনে থাকতে বাঁধা অহং-শৃঙ্খলেতে” মধ্য দিয়ে 'আ' উপসর্গরূপ আ-শৃঙ্খলকে ভেঙ্গে আমার’, বোধকে ‘মার’ করে তোলার আপ্রাণ প্রায়াস। কেননা ‘আমি গেলে ঘুচিবে জঞ্জাল। অহঙ্কারের হুঙ্কার হবে নিৰ্জীব'। ১৯৮ নং পদে রামপ্রসাদের জিজ্ঞাসা

“আমায় কি ধন দিবি তোর কি ধন আছে?

তোমার কৃপাদৃষ্টি পাদপদ্ম, বাঁধা আছে হরের কাছে”।


উক্তির মধ্যে দিয়ে লয়মুক্তির জন্য সাধকচিত্ত উন্মুখ-মুখর। তিনি সিদ্ধ সেবায় বদ্ধ’, তাই এই বলিষ্ঠ সত্যোচ্চারণ তার পক্ষেই সম্ভব। ২২৪ নং পদে “শ্মশান ভালবাসিস্ বলে, করেছি হৃদি” পদটি সাধকের অসাধারণ বৈরাগ্যের দীপবর্তিকা। বিশ্বাসের বন্দর ছাড়িয়ে পরমা নিবৃত্তির যাত্রাপথের চিহ্ন এখানে লক্ষিত হয়।