দ্বিজমাধব এবং দ্বিজ রামদেবের মধ্যে তুলনা

দ্বিজ রামদেব


সপ্তদশ শতকের কবি দ্বিজ রামদেব। তার কাব্যের নাম ‘সারদাচরিত’। নোয়াখালি থেকে তাঁর কাব্যের দুটি পুঁথি আবিষ্কার করেন ড. আশুতোষ দাস। তা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘অভয়ামঙ্গল’ নামে প্রকাশ করেন। কবির আত্মপরিচয় রূপে জানা যায়, ব্রাহ্মণ বংশে কবির জন্ম খুব সম্ভবত চট্টগ্রামে, পিতার নাম গোবিন্দ—“দ্বিজ গোবিন্দসুত”। পিতা ‘কবিচন্দ্র’ উপাধি পেয়েছিলেন। গ্রন্থরচনার সমাপ্তি-সূচক পুষ্পিকা-শ্লোক থেকে জানা যায় ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে ১৬৫৩ খ্রীস্টাব্দে কাব্যটি লেখা শেষ হয়।


দ্বিজমাধব এবং দ্বিজ রামদেবের মধ্যে তুলনা :

চট্টগ্রামের আর এক কবি দ্বিজমাধবের সঙ্গে দ্বিজ রামদেবের বহুস্থলে যেমন ঐক্য আছে, তেমনি পার্থক্যও আছে


(১) দ্বিজ রামদেবের কাব্যে দ্বিজমাধবের মতোই মঙ্গলাসুর দৈত্য বধের কাহিনী আছে। তবে দ্বিজমাধবে মঙ্গলদৈত্যের উদ্ভব-কাহিনী নেই, যা দ্বিজ রামদেবে আছে।


(২) রামদেবের কাব্যে কালকেতুর জন্মের কল্পনা অংশ অভিনব। এখানে আছে নিদয়ার রাজপথে বা হাটে যাবার পথে কালকেতুর জন্ম হয়েছে।


(৩) মাধবের কাব্যে শঠ বণিকটির নাম সোমদত্ত, মুকুন্দরামের কাব্যে মুরারি শীল আর দ্বিজ রামদেবের কাব্যে বণিকের নাম সুশীল বণিক এবং চারিত্রিক সততায় সে সত্যই প্রশংসনীয়।


(৪) রামদেবের কাব্যে ফুল্লরাকে অপদস্থ করার প্রয়োজনে সপত্নী-বিদ্বেষ দেখানো হয়েছে।


(৫) মাধবের কাব্যে ধনপতির পুত্রের নাম শ্রীমত্ত, রামদেবের কাব্যে তার নাম শ্রীপতি। সে বন্ধুদের নিয়ে সোলার নৌকা ভাসাতে যায়। তার ভবিষ্যৎ বাণিজ্য যাত্রার সঙ্কেত এখানে তাৎপর্যপূর্ণ।


(৬) মাধবের কাব্যে সিংহল থেকে শ্রীমত্তের সঙ্গে সুশীলার স্বামীগৃহে যাবার আগে ‘বারোমাস্যা’র বর্ণনা আছে। রামদেবের কাব্যে সুশীলা তার মায়ের কাছে এই প্রসঙ্গ উপস্থাপিত করেছে, যা অধিকতর বাস্তবসম্মত।


(৭) এছাড়া তৎকালীন সমাজ-ইতিহাসের কিছু বিশেষ আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যেমন ধনপতি ও খুল্লনার বিবাহে পুষ্প-বিবাহের প্রথা (বা দ্বিতীয় বিবাহ) অনুসরণ চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যরূপে দেখা দিয়েছে। আবার বিদেশযাত্রার পূর্বে স্বামীর স্ত্রীর কাছে নিদর্শনপত্র দানের উল্লেখ আছে ঐ কাব্যে। আছে লহনার সখীর মাধ্যমে জাদুর কৌশল, জ্যোতির্বিদ্যায় বিশ্বাস ইত্যাদি প্রসঙ্গ।


চরিত্রচিত্রণে রামদেবের কৃতিত্ব দেখা যায় যেমন— ব্যাধ কালকেতুর বন্য স্বভাব সম্পর্কে ফুল্লরার ভীতি

“দিনান্তে আসিবে পতি ক্ষুধার্ত্ত হইয়া।

শীঘ্র না পাইলে ভক্ষ মারিবে ধরিয়া ।।”


রাজা কালকেতুর ভাড়ু দত্তকে ধরে প্রহারের প্রবৃত্তিও বন্যতাময়। সে সরল। কলিঙ্গ রাজের কারাগারে সে দেবীকে উদ্দেশ্য করে বলে

“পশুর বিপদ হেতু    ছলে বলে কালকেতু

রিপু করি কলিঙ্গ রাজন। 

ধনের নাহিক দায়ে,   গণ্ডীশর দেও মায়ে

পশুসৃষ্টি নাশিনী তখন ৷৷”


ফুল্লরাকেও দেখা যায়, স্বামীর মুক্তির জন্য কোটালকে সর্বস্ব দিতে পণ করেছে। অনুরূপভাবে, রামদেবের ভাঁড়ু দত্ত স্বভাবে বহুরূপী। সে চতুর শিরোমণি। সে শঠ, প্রবঞ্চক এবং প্রত্যুৎপন্নমতি। তার পরিণাম বর্ণনা করে কবি বলেছেন

“নগরে মাগিয়া খাএ কহে এহি কথা।

তীর্থরাজে গিয়া আহ্মি মুড়াইল মাথা ॥ ”


করুণরস-সৃষ্টিতে রামদেবের যেমন নৈপুণ্য দেখা যায়, তেমনি কৌতুকরস নিষ্কাশনেও তাঁর কৃতিত্ব লক্ষিত হয়। ফুল্লরা, খুলনা এবং সুশীলার তিনটি বারমাস্যা বর্ণনা রামদেবের কাব্যে করুণরসের পরিচয় দেয়। অন্যদিকে মুকুন্দরামের কাব্যে যেমন ‘হিউমার’ দেখা যায়, তেমনি রামদেবের কাব্যে ‘ফান’-এর ব্যবহারই বেশি। শ্রীপতির সিংহলের পথে বাণিজ্যযাত্রায় কোটালের পান খেয়ে ভয় পাওয়ার মধ্যে কৌতুক সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্ত কারণে মনে হয়, দ্বিজ রামদেব মুকুন্দরামের সমধর্মা প্রতিভা হয়ত নয়। তবে মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসে তার ভূমিকা অন্যান্য কবিদের সঙ্গে যুক্ত করে ‘ইত্যাদি’র দলে ফেলা যায় না।