কথাসাহিত্য : উপন্যাস ও ছোটগল্পে পরশুরাম (১৮৮০খ্রীঃ–১৯৬০খ্রীঃ)

উপন্যাস ও ছোটগল্পে পরশুরাম


“জীবনে আমি খুব কম লোকের সঙ্গে মিশেছি, তাই আমার অভিজ্ঞতাও খুব কম। কর্মক্ষেত্রে যাদের সঙ্গে মিশেছি, তাদের মধ্যে বেশির ভাগ হচ্ছে ব্যবসায়ী আর দোকানদার। লিখতে গেলে অনেক বেশি দেখতে হয়” – বিয়াল্লিশ বছর বয়সের পরিণত লেখনী নিয়ে বাংলা গল্পের দেশে যার আগমন (১৯২২ খ্রীঃ), আর সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের চিত্তভূমিতে বসতি স্থাপন, সেই পরশুরামের এই আবেগবিহীন সত্যকথা তার গল্পের মতোই চমক জাগায়। পুরাণে এই ‘পরশুরাম’ দশ অবতারের এক নাম। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাস্যরসিক গল্পকার রাজশেখর বসুর ছদ্মনাম। স্বনামে তিনি বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণামূলক রচনায়, পরিভাষা-প্রণয়নে, অভিধান রচনায় পুরাণ, অনুবাদে ও গুরু-গম্ভীর প্রবন্ধ রচনায় যুক্ত ছিলেন। অন্যদিকে ‘পরশুরাম’ ছদ্মনামে বাংলা সাহিত্যে কৌতুক ও ব্যঙ্গগল্প রচনার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন।


পরশুরামের জন্ম, শিক্ষা ও কর্মজীবন:

১৮৮০ খ্রীস্টাব্দের ১৬ই মার্চ বর্ধমান জেলার শক্তিগড়ের কাছে বামুনপাড়া গ্রামে মাতুলালয়ে রাজশেখর বসুর জন্ম হয়। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। তাঁর পূর্বে ছিলেন জ্যেষ্ঠ শশীশেখর। অন্যান্যজন হলেন যথাক্রমে কৃষ্ণশেখর এবং গিরীন্দ্রশেখর বসু। তার পৈত্রিক আবাস ছিল নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের কাছে উলা বীরনগর। বাবা চন্দ্রশেখর বসু ছিলেন সাহিত্য ও দর্শনের বিশেষ অনুরাগী। বাবার সঙ্গে বাংলাদেশের বাইরে ঘুরে রাজশেখরের বাল্য জীবন কাটে। প্রথম সাত বছর মুঙ্গেরে এবং – খড়গপুরে অতিবাহিত হয়। তারপর ১৮৮৫ থেকে ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত দ্বারভাঙ্গার রাজস্কুলে পড়াশুনো শেষে এন্ট্রাস পাশ করেন। ১৮৯৫-৯৭ সাল পর্যন্ত পাটনা কলেজে ফার্স্ট আর্টস পড়েন। এর পরে ১৮৯৭ সালে বি.এ. পড়ার জন্য পাটনা থেকে কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সী কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর কাছে কিছুদিন বি.এ.-তে পড়ার সুযোগ পান। এই সময় ১৮৯৯ সালে শ্যামাচরণ দে’র কন্যা মৃণালিনীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৮৯৯ সালে কেমিষ্ট্রি ও ফিজিক্সে দ্বিতীয় শ্রেণীর অনার্স সহ বি. এ. পাশ করেন। পরের বছর রসায়ন শাস্ত্রে প্রথম স্থান অধিকার করে এম. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর বি. এল. পরীক্ষায় কৃতিত্বের পরিচয় দেন।


১৯০৩ খ্রীস্টাব্দে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। আচার্য রায়ের ঐকান্তিক ইচ্ছায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠানে রাজশেখর রাসায়নিকের পদে যোগ দেন। অসাধারণ কর্মক্ষমতা দেখিয়ে এক বছরের মধ্যেই তিনি এই প্রতিষ্ঠানে কর্মাধ্যক্ষের পদে উন্নীত হন। ১৯৩২ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর পরিচালনার গুণে প্রতিষ্ঠানটির গৌরব বৃদ্ধি পায়।


রাজশেখর বসু পেশায় রসায়নবিদ। অন্যদিকে ছিলেন সুপণ্ডিত এবং সুসাহিত্যিক। তার সাহিত্যজীবনের সূচনা হয় কৌতুকধর্মী গল্পরচনার মাধ্যমে। ১৯২২ সালে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় 'শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ গল্প। তিনি এই গল্পে ‘পরশুরাম’ ছদ্মনামে আত্মপ্রকাশ করেন। এর পরে একের পর এক গল্প প্রবাসী এবং ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘গড্ডলিকা’ শিল্পী যতীন্দ্রকুমার সেনের ব্যঙ্গচিত্রসহ মুদ্রিত (১৯২৪) হয়। তৎক্ষণাৎ বাংলার রসিক ও বুদ্ধিজীবী পাঠকমহলে সাড়া পড়ে যায়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রশংসা করেন। এমনকি, বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠানের এই গুণী বিজ্ঞানীর সাহিত্যক্ষেত্রে স্থানান্তরিত হওয়ার আশঙ্কায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মধুর কলহ হয়।


রাজশেখর বসুর বাসস্থান ছিল প্রথমে বেচু চাটুজ্যে স্ট্রীটের এক ভাড়া বাড়িতে, পরে ১৪ নং পার্শীবাগানের পৈত্রিক গৃহে অবস্থান করেন। এই বাড়িটি ছিল পরশুরামের বহু গল্প রচনার কেন্দ্রভূমি। এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করে শ্রী শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ লাহা বলেছেন ঃ “১৪ নম্বর পার্শীবাগানে একটা বিরাট আড্ডা বসিত। পরশুরামের গল্পে ইহা ১৮ নম্বর হাবসীবাগান বলিয়া পরিচিত। ....প্রতিদিনই মজলিস বসিত, জমজমাট হইত রবিবার, বৈঠকখানা গমগম করিত, সেদিন সকলের ছুটি। সেই বৈঠকে কত ডাক্তার, কত অধ্যাপক, কত বৈজ্ঞানিক, কত সাহিত্যিক, কত শিল্পী, কত ঐতিহাসিক উপস্থিত থাকিতেন তার ইয়ত্তা নাই। তার নামকরণ করা হইয়াছিল ‘উৎকেন্দ্র সমিতি'। প্রথমে একটা ইংরেজী নামই ছিল, বাংলা নামটি দেন রাজশেখরবাবু। সেই মজলিসে চা, দাবা ও তাসের সঙ্গে চলিত মনস্তত্ত্ব, বিজ্ঞান, শিল্প, কাব্য, পুরাণ, ইতিহাস এবং সাহিত্যের আলোচনা” (তথ্যসূত্র : পরশুরাম গ্রন্থাবলী, প্রথম খণ্ড, পঞ্চম সংস্করণ, বৈশাখ ১৩৯৪, পৃষ্ঠা ১৩ ১৪)। এই আসরে আড্ডাধারী ছিলেন স্বয়ং রাজশেখর বসু (বা ‘মেজদা’) এবং তাঁর সঙ্গে প্রসিদ্ধ চিত্রকর যতীন্দ্রকুমার সেন, জলধর সেন, কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, ডাক্তার সত্য রায়, অধ্যাপক মন্মথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ বসু, ড. সুহৃৎচন্দ্র মিত্র, অধ্যাপক হরিপদ মাইতি, ড. দ্বিজেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, আচার্য যদুনাথ সরকার, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. বিরজাশঙ্কর গুহ, শিল্পী পূর্ণচন্দ্র ঘোষ, শিল্পী পুলিনচন্দ্র কুণ্ডু, পাটনার অধ্যাপক রঙীন হালদার প্রমুখ একাধিক ব্যক্তি। এমন কি, রাজশেখরের বড় দাদা সুলেখক শ্রী শশীশেখর বসু, সেজদা শ্রীকৃষ্ণশেখর বসু-রাও ছিলেন এই আড্ডার নিয়মিত বা অনিয়মিত সভ্য।


গল্পগ্রন্থ রচনার পাশাপাশি রাজশেখর বসু স্বনামে বহু চিন্তাশীল প্রবন্ধগ্রন্থ এবং বাংলা অভিধান প্রণয়ন করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি 'কৃষ্ণকলি' ও অন্যান্য গল্পের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক 'রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার' লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বানান সংস্কার কমিটি'র সভাপতি মনোনীত হন। 'পরিভাষা' কমিটির সভ্যরূপে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন।


পরশুরামের রচনাসমূহ:

(ক) রাজশেখর বসুর স্বনামে রচিত গ্রন্থগুলি হল, যথাক্রমে— চিলন্তিকা” (১৯৩৭) নামক অভিধান, 'রামায়ণ' (১৯৪৬), 'মহাভারত' (১৯৪৯) এবং 'মেঘদূত' (১৯৪৩) গ্রন্থের অনুবাদ; ‘লঘুগুরু’ (১৯৩৯), ‘বিচিন্তা’ (১৯৫৫), 'চলচ্চিত্তা’ (১৯৬০), এবং মৃত্যুর পর প্রকাশিত রবীন্দ্রকাব্যবিচার (১৯৬০, ২৬শে এপ্রিল) প্রবন্ধ সংকলন।


(খ) পরশুরাম ছদ্মনামে রচিত গ্রন্থগুলি হাস্য ও কৌতুকধর্মী গল্প সংকলন । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : 'গড্ডলিকা’ (১৯২৪) 'কজ্জলী' (১৯২৭), ‘হনুমানের স্বপ্ন’ (১৯৩৭)। ‘গল্পকল্প’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৭), 'ধুসুরী মায়া ইত্যাদি গল্প’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৯), ‘জামাইষষ্ঠী' (অসমাপ্ত, সাল নেই), 'চমৎকুমারী ইত্যাদি গল্প' (১৮৬১), ‘আনন্দবাঈ ইত্যাদি গল্প’ (১৮৭৯), ‘কৃষ্ণকলি ইত্যাদি গল্প’ (বঙ্গাব্দ, ১৩৬০), ‘নীল তারা ইত্যাদি গল্প’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬২)।


কালগত দিক থেকে দেখা যায়, পরশুরামের প্রথম দুটি গল্পগ্রন্থ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে লেখা। এইগুলি মোটামুটি বিশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকের বাঙালি মানসের মানচিত্র। বিষয়গত দিক থেকে লক্ষ্য করা যায় বাঙালীর অবস্থাপন্ন গৃহের অলস অকর্মণ্য পরিবেশ, মোসাহেবি, জীবন সম্পর্কে মন্থর ঔদাসীন্য, সাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীল-ঘটিত বিতর্ক, দাম্পত্য-কলহ, প্রেম ও বিবাহ সমস্যা, বাঙালীর ব্যবসায়ী বুদ্ধি, গুরুভক্তি, স্বাধীনতা আন্দোলন ইত্যাদি বিবিধ প্রসঙ্গ। এর পাশাপাশি আছে সাহিত্যে ও জীবনে প্রতিফলিত সুলভ রোমান্টিকতা, ভাবপ্রবণতা, অহংবোধ, ধর্মের মিথ্যাচার, লোভ ও স্বার্থপরতা, ভণ্ড মানবপ্রেম ও ছদ্ম দেশপ্রেমের স্বরূপ উদ্‌ঘাটন। বিদ্বেষহীন কৌতুক এবং পরিশীলিত পরিহাস তাঁর গল্পের স্বভাবধর্ম।


পরশুরামের গল্পগুলির বৈশিষ্ট্যসমূহ:

পরশুরামের গল্পগুলি বিশেষত্ব মণ্ডিত। তাঁর গল্পগুলির উপস্থাপনায় কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে; যেমন—


(১) বৈঠকী রীতি : তাঁর গল্পকথন রীতির মধ্যে বৈঠকী চালে উপস্থাপনা দেখা যায়। এই জাতীয় উপস্থাপনায় বক্তা ও শ্রোতার এক বিশেষ ভূমিকা থাকে। তবে পরশুরাম তাঁর গল্পে কথক নন, লেখক। আসলে বৈঠকী রীতির গল্পের আড়ালে তার মধ্যে দেখা গেছে মজলিসী ভাব। তাঁর প্রথম পর্যায়ের গল্পগুলি জনৈক বন্ধু ও মোসাহেব বৎসল বংশলোচনবাবুর বাড়ির আড্ডায় রচিত। এই আড্ডার প্রধান কথক অভিজ্ঞ প্রৌঢ় ‘কেদার চাটুজ্যে’। তার লেখা এই কেদার চাটুজ্যে পর্যায়ের গল্পগুলি হল–‘লম্বকর্ণ’, ‘গুরুবিদায়’, ‘রাতারাতি’, ‘স্বয়ংবরা’, ‘দক্ষিণরায়’, ‘মহেশের রথযাত্রা'। আরও পরিণত বয়সে লেখা বৈঠকী গল্পের কথক হয়েছেন জটাধর বকশি। এই ধরনের গল্পগুলি হল ‘জটাধর বকশি’, ‘মাঙ্গলিক’, ‘গামানুষ জাতির কথা'। এছাড়াও দেখা যায়, তার একাধিক গল্পে বিষয়বস্তু ও আখ্যান কোন না কোন চরিত্রের উক্তিতে ব্যক্ত হয়েছে; যেমন 'অক্রুর সংবাদ' গল্পে প্রধান চরিত্র অক্রূর তার বিচিত্র নারী-বিষয়ক অভিজ্ঞতার কথা বলেছে। এই বৈঠকী রীতির অনুসরণে পরশুরাম হয়ে উঠেছেন ত্রৈলোক্যনাথের সার্থক উত্তরাধিকারী।


(২) চরিত্র-চিত্রশালা : পরশুরামের গল্পের চমৎকারিত্ব ধরা পড়ে চরিত্রচিত্রণে। ‘গড্ডলিকা’ পড়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের বিস্ময় বিমুগ্ধ মস্তব্য: “বইখানি চরিত্র চিত্রশালা। তিনি মূর্তির পর মূর্তি গড়িয়া তুলিয়াছেন। এমন করিয়া গড়িয়াছেন যে, মনে হইল ইহাদিগকে চিরকাল জানি।” এই চরিত্রসৃষ্টির নৈপুণ্য তার ‘গড্ডলিকা’ এবং ‘কজ্জলী'র মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।


(৩) উদ্ভট ঘটনা এবং উদ্ভাবনী শক্তির প্রকাশ : হাস্যরস সৃষ্টির জন্য তাঁর একাধিক গল্পের কাহিনী বিন্যাসে অজস্র উদ্ভট ঘটনা এবং কল্পনার উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। অপ্রত্যাশিত ঘটনার সমাবেশ, অদ্ভুত আশ্চর্যজনক পরিস্থিতি রচনা, উদ্ভট পরিবেশ সৃষ্টি, বুদ্ধি ও বিশ্বাসের পক্ষে সংশয়জনক অবিশ্বাস্য কাহিনী সংস্থান পরশুরামের গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য; যেমন--বিরিঞ্চিবাবার অসাধারণ শক্তির ইঙ্গিত দিতে গিয়ে বলেছেন, তিনি ইচ্ছে করলে কোন ভক্তকে “আকবরের টাইমে আগ্রাতে অথবা ফোর্থ সেঞ্চুরি বি.সি.-তে পাটলিপুত্র নগরে এনে ফেলতে পারেন।” অথবা অবিশ্বাসী এক ভক্তের প্রতি নিবারণের টিপ্পনী— “গৌতম বুদ্ধ কোন্ ছার। প্রভু মনু পরাশরের সঙ্গে এক ছিলিমে গাঁজা খেতেন। সব্বার সঙ্গে ওঁর আলাপ ছিল।” ভগীরথ, টুটেন খামেন, নেবুচাডনাজার, হাম্বুরাব্বি, নিওলিথিক ম্যান, পিথেকানথ্রোপস্ ইরেক্টস, মায় মিসিং লিংক”।


(৪) বর্ণনায় বিশেষ পদ্ধতির ভাষা-সংলাপ ও শব্দ ব্যবহার : পরশুরামের গল্পে হাস্যরস প্রায়শই বুদ্ধিদীপ্ত। এই হাস্যরস সৃষ্টির প্রয়োজনে দেখা যায় বিচিত্র ভাষা-সংলাপ ও শব্দ ব্যবহার; যেমন— 'বিরিঞ্চিবাবা' গল্পে বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপ; কখনও বাংলা-হিন্দী মেশানো ক্রুদ্ধ গোবর্ধন মল্লিকের উক্তি : “ব্যাটা আমার সঙ্গে চালাকি?...মারো শালেকো দুই থাবড়া”। হোকিম নরুল্লা গজন ফরুল্লা নন্দকে বলেছেঃ “হাড্ডি পিলপিলায় গিয়া” (“চিকিৎসা সংকট')। জাবালি পত্নীর হিন্দ্রালিনীর অপ্সরা ঘৃতচীর প্রতি তিরস্কার“হল্লা দগ্ধাননে নিল্লজ্জে ঘেঁচী” (“জাবালি’), আবার কখনও বা অলৌকিক দেবচরিত্রকে লৌকিক করে দেখানোর সহজ জীবন্ত রূপ - “স্ত্রীকৃষ্ণ তার খাটিয়ায় শুয়ে আছেন, দুজন বামন সংবাহক তার হাত পা টিপে দিচ্ছে এমন সময় ভীমসেন এসে বললেন, বাসুদেব ঘুমলে নাকি ?’’ (‘ভীমগীতা’)। এখানে দৃশ্যটির নাট্যসংলাপে মণ্ডিত। পরশুরামের ভাষারীতি বহু রসিক পাঠক ও সমালোচককে আকৃষ্ট করেছে। অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন বাগর্থ সম্পৃক্তির নিরুপম নিদর্শন তাঁর ভাষা। তাঁর রচনা এখনো সূর্যালোকিত স্রোতধারার মত বহমান, তাতে বস্তুতন্ত্রযুগের বীরবলী বক্রতার সঙ্গে রাবীন্দ্রিক মাধুর্যের মিলন, অপরূপ যুক্তবেণী রচনা করেছে” (“বাংলা গল্প বিচিত্রা')। এছাড়াও দেখা যায়, শব্দের ধ্বন্যাত্মক প্রয়োগ : “শিবুর যদিও রক্ত মাংসের শরীর নাই কিন্তু...... মনটা খাঁ খাঁ করিতে লাগিল।” (৫) “যেখানে হৃৎপিণ্ড ছিল সেখানটা ভরাট হইয়া ধড়াক ধড়াক করিতে লাগিল” (ভূশুণ্ডীর মাঠে’)। আবার অনেক সময় রবীন্দ্র-কবিতা, কবীরের বচন, সংগীতের গৎ ব্যবহার করে পরশুরাম হাস্যরস সৃষ্টির ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যেমন ধূর্ত ব্যবসায়ী গণ্ডোরিরামের ধর্মশালা বানানোর সপক্ষে যুক্তি : “হামার জাত রূপয়া ভি কামায় হিসাবসে পুনভি করে হিসাবসে। আপনেদেরে রবীন্দরনাথ কি লিখছেন বৈরাগ সাধন “মুক্তি সো হমার নহি” (শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’)। আবার ভূত নাদু মল্লিক ব্রহ্ম দৈত্য রূপী শিবুকে চৌতালের বোল বোঝাতে দাম্পত্যকলহের দৃষ্টান্ত দিয়েছে :

‘ধা ধা ধিন তা কৎ তা গে 

গিন্নী ঘা দেন কর্তাকে’ ইত্যাদি।


ত্রৈলোক্যনাথ এবং পরশুরাম:

রঙ্গ-ব্যঙ্গ কৌতুক পরিহাসের একই ধারায় ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৭-১৯১৯ খ্রীঃ)-এর পর পরশুরামের আবির্ভাব হয়। উনিশ শতকের শেষ দশকে 'কঙ্কাবতী' উপন্যাস রচনার সূত্রে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। তার উপন্যাসসহ অন্যান্য গল্পগুলি হল 'ভূত ও মানুষ’, ‘মুক্তামালা’, ‘মজার গল্প', ‘ডমরুচরিত’ ইত্যাদি। তাঁর গল্পরচনার সঙ্গে পরশুরামের সাহিত্যসৃষ্টির কিছু সাদৃশ্য দেখা যায়। যেমন


(ক) গল্পকথনে বৈঠকী রীতির অনুসরণ : ত্রৈলোক্যনাথের উপন্যাস ‘কঙ্কাবতী’ থেকে শুরু করে সব গল্পই কথকতার ঢঙে লেখা, বৈঠকী গল্পের আমেজে পূর্ণ; যেমন ‘ভূত ও মানুষ' গল্প-সংকলনের অন্তর্ভুক্ত 'নয়নচাদের ব্যবসা' গল্পের সমাপ্তি ঘটেছে বৈঠকী রীতিতে : “রাত্রি হইয়াছে আজ আর নয়”। এখানে ত্রৈলোক্যনাথের কণ্ঠস্বর যেন অনুভব করা যায়। অনুরূপভাবে মহাদেববাবুর বাড়ির মজলিশে কথক ঘনশ্যামবাবু, গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপের গল্পের আসরে বৃদ্ধ ডমরুধর প্রভৃতি চরিত্রগুলিও মুখ্যত কথকের ভূমিকায় তাঁর গল্পে উপস্থিত।


পরশুরামের প্রথম দিকের একাধিক গল্পে, জনৈক বন্ধু ও মোসাহেবপরিবৃত বংশলোচনবাবুর আড্ডার কথা আছে যা মহাদেববাবু বা ডমরুধরের আড্ডারই রূপান্তর মাত্র। সেক্ষেত্রে ডমরুধর কেদার চাটুজ্যেতে এবং গ্রাম্য চণ্ডীমণ্ডপ যেন অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের সাজানো বৈঠকখানায় পরিণত হয়েছে। তাঁর লেখা কেদার চাটুজ্যের কথকতায় গল্পগুলি হল : ‘লম্বকর্ণ’, ‘গুরুবিদায়’, ‘রাতারাতি’, ‘স্বয়ংবরা’, ‘দক্ষিণরায়’, ‘মহেশের রথযাত্রা’ প্রভৃতি। তার গল্পের আর এক কথক জটাধর বকশির মাধ্যমে উপস্থাপিত গল্পগুলি হল‘মাঙ্গলিক’, ‘গামানুষ জাতির কথা’। এছাড়াও আছে অক্রূরবাবুর মুখ থেকে বলা বিচিত্র নারী বিষয়ক অভিজ্ঞতার কাহিনী, ‘অক্রূর সংবাদ গল্প’। এই সাদৃশ্য সত্ত্বেও বলা যায়। পরশুরাম ঠিক ত্রৈলোক্যনাথের মত কথক নন, লেখক। তাই তার গল্পে বুদ্ধিদীপ্ত পরিহাসমার্জিত শ্লেষ, ব্যঙ্গ, চতুর উক্তি-প্রত্যুক্তি বৈঠকী গল্পের অতিরিক্ত আবেদন সৃষ্টি করে।


(খ) ভৌতিক সত্তায় মানুষী-ভাব ও উদ্ভট-কৌতুক রস সৃষ্টি : ত্রৈলোক্যনাথ এবং পরশুরাম দুজনেই অনবদ্য ভৌতিক গল্পের স্রষ্টা। ত্রৈলোক্যনাথের কঙ্কাবতীতে শ্রীমান ঘ্যাঘো ভূতের সঙ্গে শ্রীমতী নাকেশ্বরী প্রেতিনীর শুভ বিবাহ, ‘ভূত ও মানুষ’ গল্পে বীরবালা ও লুল্লু চরিত্রের বর্ণনা আছে। 'লুল্লু' গল্পে ভৌতিক চরিত্র-ব্যবহারে তাঁর স্বাতন্ত্র্য চোখে পড়ে। তার গল্পে ভূত সম্পাদক-রূপে দেখা দেয়, গলায় দড়ি ভূতকে কলুর ঘানিতে ফেলে তার তেল নিষ্কাশন করা হয়। আবার মজার গল্পে আছে পূজার ভূত, পিঠে পার্বণে চীনে ভূত, মেঘের কোলে ঝিকিমিকি, একঠেঙো ছকু ভূতের কথা। তবে কোথাও নেই ভৌতিক শিহরণ, আছে উদ্ভট ও অদ্ভুত রসের সঙ্গে হাস্যরসের অপরূপ মিশ্রণ। তার ‘মুক্তমালায়’ আছে শ্রীমতী লাউমুখী, শ্রীমতী নারিকেলমুখী, শ্রীমতী শঙ্খমুখী প্রভৃতি সম্ভ্রাম্ভবংশীয়া ভূতিনীদের কথা। তাঁর ভূতের বাড়িতে ভূত বিলিতি, দেশী নয়। ‘বেতাল ষড়বিংশতি’তে ভূত বাংলা রঙ্গমঞ্চে অভিনেতার বেশে দেখা দিয়েছে। ভূতের দ্বারা তিনি বাংলা থিয়েটারী ঢঙকে বিদ্রূপও করেছেন। শুধু তাই নয়, নানা অদ্ভুত ও উদ্ভট ঘটনাসমূহ ত্রৈলোক্যনাথের গল্পে যথেষ্ট পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়; যেমনঃ ‘বীরবালা’ গল্পে বৃক্ষতলে আসীন দেবী সিংহের স্বপ্নে অদ্ভুত দর্শন, ‘ডমরুচরিতে’ সন্ন্যাসীর দেওয়া ওষুধের গুণে ডমরুর শরীর থেকে ‘আমি’র অন্তর্ধান, ‘ভূমিকম্প’কে চরিত্ররূপে বর্ণনা করা, আংটি থেকে খড়াধারী বীরপুরুষের আবির্ভাব, নিজের মুণ্ডতে ভৌতিক মুণ্ডের স্থাপন, যমের সামনে ডমরুর বিচার, সন্ন্যাসীদের শূন্যপথে টাকাকড়ি-ভর্তি সিন্ধুক চালনা, জ্যাস্ত অবস্থায় কুমিরের পেটে গিয়ে বেগুন বিক্রয় ইত্যাদি একাধিক অদ্ভুত ও উদ্ভট ঘটনার দৃষ্টান্তে ত্রৈলোক্যনাথের গল্পজগৎ পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।


অবশ্য পরশুরামের গল্পসংকলনে ভৌতিক গল্পের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে তাঁর সঙ্গে ত্রৈলোক্যনাথের কিছু তফাৎ আছে। ত্রৈলোক্যনাথের উদ্দেশ্য ছিল ভয় দেখানো নয়, হাস্যরস সৃষ্টি। সেইসঙ্গে ভূতপ্রেতের উপর মানবিক দুর্বলতা আরোপ করা। অন্যদিকে ভূতের আচরণে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে পরশুরামের উদ্দেশ্য ছিল ভূতের মধ্যে মানবিক ভাবের দু-একটি লক্ষণ দেখিয়ে কৌতুক ও অদ্ভুতরস সৃষ্টি। বুদ্ধিদীপ্ত হিউমার প্রকাশ করার জন্য কল্পনার ক্রিয়াকলাপে শব্দময় ভাষারীতি বা স্টাইলের প্রয়োগকৌশল। ত্রৈলোক্যনাথ অপেক্ষা তাঁর বর্ণনা অনেক পরিমাণে চতুর। উদ্ভট উপাদানগুলি গল্পের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যভাবে পরিবেশিত। আপাতদৃষ্টিতে যা অসম্ভব অবাস্তব ত্রৈলোক্যনাথের গল্পে তার উপস্থিতি দেখা যায়। সেই তুলনায় পরশুরামের কল্পনা আরও আধুনিক, বুদ্ধিমার্জিত, বিদগ্ধ, সূক্ষ্ম উদ্দেশ্যমূলক এবং নাগরিক। যেমন 'ভূশুণ্ডীর মাঠে’ গল্পে আছে শিবুর তিন জন্মের স্ত্রী ও নৃত্যকালীর তিন জন্মের স্বামীর ডবল ত্র্যহস্পর্শযোগ। ‘প্রেমচক্রে’ আছে রাহুর মাখন মেখে পূর্ণচন্দ্রকে টমেটোর মতন কামড়ে কামড়ে খাওয়া, অথবা ডালপুরীর মতন গরম সূর্যকে মুখে পোরা। এইরকম হরিদ্বারের হোটেলে দুর্বাসামুনির সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তার দাড়ি থেকে মেনকার দেওয়া ঝুমঝুমি পাওয়া, পঞ্চী ও জটিরামের মুণ্ডুবদল, গামানুষ জাতির কথা, সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন কর্বুরঙ্গ রেড্ডি ইত্যাদি প্রসঙ্গগুলি উদ্ভট হলেও বুদ্ধির চাতুর্যে উপভোগ্য।


(গ) রূপকধর্মী ব্যঙ্গ এবং বুদ্ধিদীপ্ত বিদ্রূপ : রূপক-রূপকথার আড়ালে ব্যঙ্গ কৌতুক সৃষ্টি ত্রৈলোক্যনাথের গল্পে দেখা যায় গল্পরচনার রীতির দিক থেকে তিনি কিছুটা যেন প্রাচীনপন্থী। অবশ্য মনের দিক থেকে তাঁর মধ্যে আধুনিকতা, বুদ্ধিবৃত্তি। সমাজসচেতনতার পূর্ণজ্ঞান যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার অংশীদার। মানব সংসারের ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা, ভণ্ডামি, মানুষের কপট বৈরাগ্য, শয়তানি, লোভ, জালিয়াতি, লোলুপ ব্যবসায়ী বুদ্ধি ইত্যাদি অন্ধকার প্রবৃত্তিগুলি সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। তাই গল্পে উদ্ভট ও রূপকের অন্তরালে তিনি ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ করেছেন। কখনও কখনও জীবনের বিষণ্ণ করুণ অভিজ্ঞতাকে হাসির অট্টহাস্যে পূর্ণ করেছেন। বিপরীতভাবে, পরশুরামের গল্পে বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্রের আচরণে নিত্যপরিচিত সত্যের আলোকে বুদ্ধির সাহায্যে অসংগতির দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। এই অসংগতিজনিত হাস্যরসের মধ্যে কোন বেদনাবোধ নেই। তার কারণ, পরশুরামের হাসি ‘কুঠারে’র মতোই সংক্ষিপ্ত, নিরেট বুদ্ধির দীপ্তিতে ধারাল। এই হাসি প্রচ্ছন্ন তিরস্কারময়, একে বলা যায় বের্গসর ভাষায় 'intellectual laughter'। হার্বার্ট স্পেন্সার একে বলেছিলেন, 'discending incongruity' বা নিম্নগ অসংগতি অর্থাৎ কোন বস্তু তার বিরাটত্ব নিয়ে অকস্মাৎ তুচ্ছতায় পর্যবসিত হয়। মানবসভ্যতার বাহ্য আড়ম্বর, তার সংস্কৃতির উচ্চ আদর্শ যে ভিতরে ভিতরে কত ঘুণধরা ফাগা তার একাধিক ছোটগল্পে তার ইঙ্গিত আছে। কুঠারের আঁচড়ে উইট, হিউমার, ফান, স্যাটায়ারের দ্যুতিতে, বহু ঠিকরানো কথার ঝলকে তিনি মুহূর্তের মধ্যে বিদগ্ধ রসিকমনকে ভরিয়ে তোলার ক্ষমতা রাখেন। তিনি আক্রমণপ্রিয় নন, তবে তাঁর লেখার পিছনে একটি সাহিত্যিক প্রবণতা, সুনির্দিষ্ট সমাজসচেতনতা নিশ্চয়ই ছিল। তার প্রথম পর্যায়ে লেখা গল্পগুলির মধ্যে শুধু ব্যঙ্গ নয়, এক সকৌতুক মনোভংগি লক্ষ্য করা যায়। তিনি যতটা রসিকতাপ্রিয় ততটা আক্রমণপ্রিয় নন। এ সম্পর্কে লেখকের নিজস্ব স্বীকারোক্তি : “পরিহাস ছাড়া আর কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে লিখি নি। কখনও কোন লোককে আক্রমণের জন্য কিছু লিখি নি।” তার গল্প আদ্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইঙ্গিতময়। পরশুরাম ও ত্রৈলোক্যনাথের গল্পে হাসির প্রকারভেদ নির্ণয়ে অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশীর মনে হয়েছে, পরশুরাম ঠিক ত্রৈলোক্যনাথের মতো হাসি-অশ্রুর মিশ্ররীতির লেখক নন। তাঁর মতে, “দুজনেই হাসির গল্পের লেখক বলে পরিচিত, কিন্তু হাসির বর্ণালীর মধ্যে তাঁদের স্থান একত্র নয়। ত্রৈলোক্যনাথ আছেন প্রচ্ছন্ন অশ্রুর দিক ঘেঁষে আর পরশুরাম আছেন প্রচ্ছন্ন তিরস্কারের দিকে ঘেঁষে। ত্রৈলোক্যনাথের হাসি প্রধানত প্রচ্ছন্ন অশ্রু ঘেঁষা হলেও তাতে অন্য উপাদান আছে, পরশুরামে মিশ্রণ নেই এমন বলি না, তবে অপেক্ষাকৃত কম।.... একজনের আবেদন পাঠকের হৃদয়ে, আর একজনের আবেদন পাঠকের বুদ্ধিতে”।


পরশুরামের গল্পের বিষয় ও প্রকারভেদ:

পরশুরামের গল্পের স্বরগ্রাম তীব্র নয়, তবু বিষয়পরিধি বিস্তৃত এবং বৈচিত্র্যময়। বেঙ্গল কেমিক্যাল, স্বগৃহের বৈঠক আর গ্রন্থপাঠ ছিল মূলতঃ তার গল্পের উপাদান সংগ্রহের উৎস। হয়ত বৈজ্ঞানিক এবং কর্মী পরশুরামের বহুবিধ পরিবেশে বিচরণের অবকাশ হয়নি, কিন্তু স্বভাবজাত প্রখর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জীবনের নানা মহলে, সামাজিক নানা বিষয়ে তাঁর অনুসন্ধিৎসা অব্যাহত ছিল। তার প্রতিফলন ঘটেছে বিভিন্ন ধরনের গল্প রচনায়। এই ধরনের গল্পের মধ্যে আছে


[1] পরশুরামের প্রতারণা বিষয়ক গল্প:

ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারণার এক নিখুঁত গল্প ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড'। ভণ্ডতান্ত্রিক শ্যামবাবু, তার শ্যালক বিপিন, ধূর্ত ব্যবসায়ী গণ্ডেরীরাম বাটপারিয়া, অবসরপ্রাপ্ত হাকিম তিনকড়ি বাবুর ধূর্ত আইনজ্ঞ অটল দত্তের মতো কয়েকজন মিলে এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলে। এর উদ্দেশ্য ব্যাখ্যায় বিজ্ঞাপনে বলা হয় “ধর্মচর্চায় জাতির উপকার সাধন” অথচ ভিতরে আছে মানুষের ধর্মের প্রতি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে 'দি অটোমেটিক শ্রীদুর্গাগ্রাফ'-এর সাহায্যে অর্থ উপার্জন ও আত্মসাতের চক্রান্ত। শ্রীমৎ শ্যামানন্দ তাঁর গ্রামের জীর্ণ বসত বাড়ি ও সামান্য জমিটুকু মোটা টাকায় বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে এবং কোম্পানীর সেবায়েত্ হয়ে মাসোহারা আদায়ের সুযোগ খোঁজেন। অন্যদিকে ঘুঘু ব্যবসায়ী গণ্ডেরীরাম নিছক কাগজপত্রে এক লাখ টাকার শেয়ার কিনে মুনাফার করার সঙ্গে ঘিয়ের কারবারটিকে এর সঙ্গে যুক্ত করার ফন্দি করেন। নিজের কুকর্ম সম্পর্কে তার কৈফিয়ৎ, জোচ্চর ব্যবসায়ীর মুখে ভাষার চাতুর্য যেমন হাসায়, তেমনি ভাবায়। অনুরূপভাবে অংশীদারী কারবারের গলদ, অসৎ সঙ্গীর নোটের বাণ্ডিল বদল করে টেক্কা দেওয়ার ছবি ‘ধনুমামার হাসি’তে আছে।


ব্যক্তিগত প্রতারণার এক নিখুঁত গল্প 'বিরিঞ্চিবাবা'। গল্পকারের মুখ্য উদ্দেশ্য, ‘স্বামীগিরি’র ভণ্ডামীর স্বরূপ উদঘাটন। আর সেইসঙ্গে সমাজের প্রতিনিধি স্থানীয় কিছু মানুষের (গুরুপদবাবু, গোবর্ধন মল্লিক, মিস্টার ও. কে. সেন, প্রমুখ) চিত্রাঙ্কন। এদের বাবার কাছে আসার বা ধর্ণা দেওয়ার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ একটাই-অলৌকিক উপায়ে কিছু টাকা অর্জন। 'তিনখানি হৌসের মালিক’, মিহি জরিপাড় ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, গলায় সরু সোনার হার, তৃতীয় পক্ষে বিয়ে করা চূড়ান্ত ভোগী গোবর্ধন মল্লিকের কপট জিজ্ঞাসা— “বাবা প্রবৃত্তিমার্গ আর নিবৃত্তিমার্গ, এর কোন্‌টা ভাল?” ভলচার ব্রাদার্স অফিসের লেজার কিপার নিতাইবাবুর আকুল আবেদন : “সাতটি দিনের জন্যে আমায় লড়ায়ের আগে নিয়ে যান বাবা, সস্তায় লোহা কিনব-দোহাই বাবা”। বলা বাহুল্য, ‘মৃদু হাস্যমণ্ডিত প্রশস্ত ঠোটের উপর’ থেকে ‘বিরিঞ্চিবাবা’র ‘দুটি উজ্জ্বল চোখ’ জানে কোথায় এই শ্রেণীর মানুষের দুর্বলতা। এইসব ভোগী মানুষদের মন্ত্র জপ ইত্যাদি নিয়ম-কানুন পালনের বিপক্ষে কি বিরাট ভয়! তাই সূর্যের দিকে তাকিয়ে নিতাইবাবুকে ‘মার্তণ্ড মন্ত্র’ জপ করতে বলেন। বিপরীতভাবে ও কে. সেন বার এ্যাট ল, অধ্যাপক নিবারণের মতো বুদ্ধিজীবী ভক্তদের সামনে 'জিসস ক্রাইস্ট—গৌতম বুদ্ধ, জগৎ শেঠ প্রভৃতি ইতিহাস, সূর্যবিজ্ঞান, রিলেটিভিটি থিয়োরী ইত্যাদি আউড়ে দাবিয়ে রাখার কৌশলও তার করায়ত্ত। আবার গুরুপদবাবুর মতো জড়বুদ্ধি ভক্তদের সামনে মহাদেব ব্রহ্মা ইত্যাদি দেবতাদের ছায়া-শরীর যজ্ঞের ধোঁয়ার মধ্যে দেখিয়ে কিভাবে বশ করা যায়, সে সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞানও তার ছিল। অবশ্য অতিরঞ্জন কিছুটা আছেই; যেমন বৈবস্বত মনুর কাছে বিরিঞ্চিবাবার (বিরিঞ্চি’ অর্থাৎ ব্রহ্মার বাবা) উক্তি : “আমি বললুম—ভয় কি বিবু, আমি আছি, সূর্যবিজ্ঞান আমার মুঠোর মধ্যে। .... চন্দ্র-সূর্য চালাবার ভার আমারই ওপর কিনা”। এই অতিবাদের মধ্য দিয়ে অতিরঞ্জনের চেষ্টা চরিত্রটি চেহারার বর্ণনা ও স্বভাবের পরিচয়েই পরিস্ফুট। আর এই অসঙ্গতির অন্বেষণেই পরশুরামের চূড়ান্ত সিদ্ধি “সুপুষ্ট গালের আড়াল হইতে দুইটি উজ্জ্বল চোখ উঁকি মারিতেছে। দু-পয়সা দামের শিঙ্গারার মত সুবৃহৎ নাক, মৃদু হাস্যমণ্ডিত প্রশস্ত ঠোট, তার নীচে খাঁজে খাঁজে চিবুকের স্তর নামিয়াছে। স্বামীগিরির উপযুক্ত মূর্তি।” প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, এই ‘উপযুক্ত মূর্তি'র সন্ধান পেয়েই বিশ্ববরেণ্য চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায় এই গল্প অবলম্বনে ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ চলচিত্রটি নির্মাণ করেন।


পরশুরাম ও কাভ্যুর:

এই গল্পটি বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসের প্রকাশ হলেও এর মধ্যে গল্পকারের বিজ্ঞানসম্মত দূরদর্শিতা ও সমাজসচেতনতা ধরা পড়েছে। সাম্প্রতিকালে ড. আব্রাহাম কাভ্যুর তাঁর 'Begone Godmen' বইতে এই মহাপুরুষদের ক্রিয়াকাণ্ড সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে আলোড়ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, এঁদের নির্দেশিত, 'Prayers poojas, sacrifices, offerings etc. had only psychological influences on credulous believers. They all acted as narcoitics on human minds..... Godmen trade appears to be a state patronised business of secular India !.. there source of income depends on such superstitious beliefs of the gulibes (Page, 2 and 14) পরশুরাম তাঁর গল্পে দেখিয়েছেন, বিরিঞ্চিবাবার প্রভাবে 'narcoitics human mind' বিত্তবান, বুদ্ধিমান উকিল গুরুপদবাবুর অবস্থা—“বেদীর নীচে বাঁ দিকে শীর্ণকায় গুরুপদবাবু বেদীতে মাথা ঠেকাইয়া অর্ধশায়িত অবস্থায় আছেন, জাগ্রত কি নিদ্রিত বুঝিতে পারা যায় না!” আবার তিনখানি হৌসের মুৎসুদ্দী গোবর্ধন মল্লিক “বাবার জন্য তেতলা আশ্রম নির্মাণ করিয়া দিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন।” বস্তুতপক্ষে কাভ্যুর Godmen-এর Qualifications রূপে যেসব অপগুণের উল্লেখ করেছেন তার বইতে (দ্রষ্টব্য : p.14 ), যথা- "skilled in Woolly talks using meaningless jargons', 'extra-sensory perception, Kundalini etc." সেইসঙ্গে ভক্ত প্রচারকদের দ্বারা "numerous Cock and bull stories about the miraculous powers of the Godman" – হাসির গল্প লিখতে গিয়ে অনেক আগেই বৈজ্ঞানিক-লেখক পরশুরাম তার প্রায় প্রত্যেকটি দৃষ্টান্ত অদ্ভুতভাবে সাজিয়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে, দূরদর্শী পরশুরামের সমাজমনস্কতা কি আশ্চর্যভাবে সাম্প্রতিক এবং বৈজ্ঞানিক রসসত্তার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।


[2] পরশুরামের ব্যঙ্গাত্মক গল্প:

যুবমনে প্রেমের মোহ ছিন্ন করার বিষয় নিয়ে পরশুরাম গল্প লিখেছেন— ‘স্বয়ম্বরা’, ‘কচিসংসদ’, ‘উলট পুরাণ’ ইত্যাদি গল্প। ‘স্বয়ম্বরা'য় বাদলার রাতে বিনোদ উকিলের ‘একটি মোলায়েম দেখে প্রেমের গল্প' বলার অনুরোধ রেখে ‘প্রেমের নামে’ সমস্ত ‘নিছক সত্য কথা' বলতে শুরু করেছিলেন বংশলোচন বাবুর বৈঠকের বিখ্যাত ‘ক্যাদার চাটুজ্যে'। মূল প্রসঙ্গটি হল, টুণ্ডলার ট্রেনের কামরায় মিস জোন জিলটারের দুই পাণিপ্রার্থী ঢ্যাঙা সাহেব টিমথি টোপার এবং বেঁটে মোটা সাহেব ক্রিস্টোফার কলম্বসের, তৃতীয় ব্যক্তি বিল বাউন্সারের কাছে নাকাল হওয়ার কাহিনী। আর সেই সঙ্গে আছে তার নিজের পূর্বোক্ত মেমের কাছে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা। মাঝে আছে 'হ্যাংলা চ্যাংড়ার দল’-এর উদ্দেশে বর্ষীয়ান কেদার চাটুজ্যের কটাক্ষ : "... ঘরে ঘরে চা, ঘরে ঘরে প্রেম।... দু-ধারে দুই তরুণ-তরুণী আর মধ্যিখানে ধূমায়মান কেতলি।” গল্পের শেষে পাত্রী মিস জোন জিলটারের প্রতি রসিক ব্রাহ্মণের অমোঘ আশীর্বাদঃ “মা লক্ষ্মী, তোমার ঠোঁটের সিঁদুর অক্ষয় হক।”


'কচিসংসদ' গল্পে দেখা যায়, সমকালীন তরুণ বা অনতিতরুণদের প্রেম-বিরহ ইত্যাদি ব্যাপারে হাস্যকর ছেলেমানুষটির পরিচয় দান। রবীন্দ্র-সংস্কৃতির বিকৃত অনুসরণের বাস্তব প্রতিমূর্তি রূপে দোদুল দে, শিহরণ সেন, লালিমা পাল (পুং), প্রভৃতি চরিত্রগুলির পোষাক এবং কথাবার্তা কৌতুককর। এদের সম্পর্কে অম্লাক্ত ব্যঙ্গ “না শিয়াল নয়, কচি-সংসদ গান গাহিতেছে। ....এক অচেনা অজানা অচিন্তনীয়া অরক্ষণীয়া বিশ্বতরুণীর উদ্দেশে কচি-গণ হৃদয়ের ব্যথা নিবেদন করিতেছে।” অবশ্য এই ব্যঙ্গ বিদ্বেষমূলক হয়, উপভোগ্য।


অনুকরণের শ্লেষাত্মক গল্প ‘উলটপুরাণ’। এখানে আপাতদৃষ্টিতে সবই উল্টো। অর্থাৎ ইংলন্ড যেন ভারতের উপনিবেশ। ইংরেজ ছেলেদের মুখে শোনা যায়, ভারত শাসকদের সুখ্যাতি। তারা ভারতীয় পোষাক পরে, মেয়েরা খোঁপা বাঁধে, দোক্তা খায়, উর্দূ গজল গায়, না বুঝে বাংলা বই মুখস্ত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। দাস মনোভাববশত মি. টোডি নাম বদল করে হয়ে যান খাঁ সাহেব গবসন টোডি। স্যার ট্রিকসি টার্নকোটকেও ভারতের কোন স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতা বলে মনে হয়। আসলে যেমন দর্পণে উলটো বিম্ব পড়ে, তেমনি ইংরেজের এইসব আচরণ অনুকরণপ্রিয় ভারতীয় চরিত্রের, বিশেষত উচ্চবিত্ত শ্রেণীর জীবনাচরণকেই পরোক্ষে প্রতিফলিত করে। পরিকল্পনার এই অদ্ভুত মৌলিকতায় গল্পটি অনন্য। ইংরেজ ও ভারতীয় দুই সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে “রসিকতার দোনলা বন্দুক” (শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়) থেকে অভ্রাক্তভাবে নামকরণের এই তীক্ষ্ণ নিষ্ঠুর শ্লেষ ছুঁড়েছেন গল্পকার।


[3] পরশুরামের কৌতুকমূলক গল্প:

পরশুরামের কৌতুকমূলক গল্পের মধ্যে ‘লম্বকর্ণ’ এবং ‘চিকিৎসা-সংকট’ উল্লেখযোগ্য। একটি রামছাগলকে কেন্দ্র করে রচিত প্রথম গল্পটিতে আছে, রায় বংশলোচন ব্যানার্জি বাহাদুরের অলস জীবন, তাঁর কৃপাপ্রার্থী মোসাহেবদের সেবা ওা চাটুকারিতা, সুন্দরী পত্নীর সঙ্গে তাঁর মান-অভিমানের দাম্পত্যলীলা, দারোয়ান চুকন্দর সিং, বেলেঘাটা কেরোসিন ব্যাণ্ডের লাটুবাবু ও অনুচরবৃন্দের কৌতুককর বিবরণ। অন্যদিকে দেখা যায়, ধনীপুত্র নিষ্কর্মা যুবক বিপত্নীক নন্দ মিত্তিরের ট্রাম থেকে পড়ে গিয়ে কাল্পনিক অসুস্থতার কারণ অন্বেষণে চিকিৎসকদের অর্থলোভ, অসততা এবং পারস্পরিক বিদ্বেষের চিত্র। নিরীহ রুগী নন্দবাবুর উপর জাঁদরেল এ্যালোপ্যাথ ডাক্তার তফাদারের সেরিব্রাল টিউমার অপারেশনের চেষ্টা, বত্রিশ টাকা ভিজিটের হোমিওপ্যাথ নেপাল ডাক্তারের প্রথমে চার টাকার ওষুধ দিয়ে এ্যালোপ্যাথির বিষ তাড়ানোর চেষ্টা, তারিণী কবিরাজের উর্দুরি ও উর্দু শ্লেষ্মা আবিষ্কার, হাজিক-উল-মুলুক হাকিমের ‘হাড্ডি পিলপিলায় গয়া’ ব্যাধি নির্ণয় ইত্যাদি বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতির বাগাড়ম্বর এবং অন্তঃসারশূন্যতাকে উদঘাটিত করে দেয়। অবশেষে লেডি ডাক্তার বিপুলা মল্লিক নন্দের সঠিক রোগ নির্ণয় করলেন, অর্থাৎ অভিভাবকহীনতা। ফলে, বিপুলা দেবীই হলেন নন্দের স্ত্রী বা আইনগত অভিভাবক। এই নির্ভেজাল কৌতুকের মধ্য দিয়ে গল্পটির সমাপ্তি ঘটে।


[4] পরশুরামের পৌরাণিক গল্প:

রাজশেখর বসু ‘পরশুরাম’ ছদ্মনামে যেন পুরাণকে নতুন ভাবনায় ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পূরণের জন্যই সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর লেখা পৌরাণিক গল্পগুলির মধ্যে বিশেষত্ব হল


(১) পুরাণ-সম্পর্কে আমাদের মনের ধর্মার্জিত পুণ্য ধারণা, সম্ভ্রম, ঐতিহ্যবোধ, দেবদেবী-মুনিঋষিদের সম্পর্কে অন্ধ ভক্তিশ্রদ্ধার ভাবটিকে যুক্তি প্রয়োগে ধ্বসিয়ে দেওয়া।


(২) পুরাণের পরিবেশকে অক্ষুণ্ণ রেখে প্রচলিত বহুবার শোনা কাহিনীকে বর্তমান কালের বিশেষ কোন ঘটনার সাদৃশ্যে নতুনভাবে নির্মাণ করা।


(৩) কোন পৌরাণিক চরিত্রকে নতুন কালের চিন্তা বা উদ্দেশ্যের বাহন করে তোলা।


(৪) প্রচলিত ঘটনার মধ্যে ঈষৎ কোন নতুন কাল্পনিক ঘটনার সংযোজন।


(৫) পৌরাণিক চরিত্রের মুখে প্রকাশে স্থূল ভাষা ও সংলাপ আরোপ।


(৬) অসংগত প্রত্যাশিত পরিণতি দেখিয়ে আপন উদ্দেশ্যসাধন।


(৭) ঋষিদের বা দেবতাদের সমাজে আধুনিক সমস্যা প্রবর্তনের দ্বারা কৌতুককর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা।


(৮) তর্মানের দৃঢ় নিয়মবদ্ধতার উপর পৌরাণিক অতীতের অলৌকিক শক্তির ক্ষণস্থায়ী অধিকার-বিস্তার’ (শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়) ইত্যাদি।


তার লেখা পৌরাণিক গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—'জাবালি', ‘নির্মোক নৃত্য’, ‘তৃতীয় দ্যূতসভা’, ‘রেবতীর পতিলাভ' 'ভরতের ঝুমঝুমি' প্রভৃতি।


পরশুরামের শ্রেষ্ঠ গল্প জাবালি। একাধিক সমালোচক এই গল্পের প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত। অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় : “জাবালি পরশুরামের অবিস্মরণীয় কীর্তি।... বিদ্যা ও বৈদগ্ধ্যের এমন সাযুজ্য বাংলা গল্প সাহিত্যে আর নেই। লোকায়তনিক দর্শনের নির্ভয় ধ্বজধারী শালপ্রাংশু পুরুষ জাবালি চরিত্রের মধ্য দিয়ে পরশুরামের একটি সংস্কারমুক্ত বলিষ্ঠ বুদ্ধির অসামান্য দৃষ্টান্ত রচনা করেছেন” (বাংলা গল্প বিচিত্রা')। অন্যদিকে পরশুরাম গ্রন্থাবলীর ভূমিকায় অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী বলেছেনঃ “স্বাবলম্বী মুক্তমতি যশোবিমুখ সংস্কারের ছিন্নবন্ধন জাবালি মানব সমাজের বিরুদ্ধে একটা মূর্তিমান প্রচ্ছন্ন তিরস্কার।”