‘পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে গঠন বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

বাংলা উপন্যাসের নামকরণে একসময় 'ইতিকথা’ ‘উপকথা' ইত্যাদিরা বেশ গুরুত্ব পাচ্ছিল। হাঁসুলী বাঁকের উপকথা এবং পুতুল নাচের ইতিকথা তারই ফল। তবে ইতিকথার রাজ্যে পুতুল নাচ'কে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার জন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে ব্যঞ্জনার আশ্রয় নিয়েছেন তা গূঢ় তাৎপর্যমণ্ডিত। অন্তত প্রসঙ্গিক ছটি বক্তব্য উদ্ধৃত করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। ১ম হল, উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদেই আছে বৈশাখ মাসে ব্যথিতপুরের মেলায় কেনা শ্রীনাজের মেয়ের পুতুল ফেলা যাওয়া প্রসঙ্গ, মেয়ে যখন কাঁদবে পুতুলের শোকে, সকালে বকুলতলায় এসে খোঁজ করবে, দেখবে পুতুল নেই, পুতুল কে নিয়েছে মেয়েটা জানতে পারবে না। তখন— 

“শশীই কেবল অনুমান করিতে পারিবে যামিনী কবিরাজের বউ ভোর ভোর বকুলতলা ঝাঁট দিতে আসিয়া দেখিতে পাইয়া তুলিয়া লইয়া গিয়াছে”।


দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি এসেছে, একবার শেষাংশে “কুসুমের বাবা অনন্তের মুখ—

-সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর এক 

চিরকাল এমনি দেখে আসছি ডাক্তারবাবু।

পুতুল বই তো নই আমরা, একজন আড়ালে

বসে খেলাচ্ছেন'।


এবার পাশাপাশি উপস্থাপন যা দেখতে পাচ্ছি তা'হল উপন্যাসের প্রথমাংশে মানুষের হাতের পুতুল ; উপন্যাসের শেষে হয়ে গেল মানুষ অদৃশ্য শক্তির হাতের পুতুল। অর্থাৎ বাস্তবের পুতুল সরে গিয়ে দর্শনের পুতুল মানুষের মনে ভর করলো। অর্থাৎ মানুষ খেলার পুতুল এই ভাবনা উপন্যাসের নামকরণের রূপক ব্যঞ্জনার মতো নিগূঢ় ইঙ্গিতবাহী হয়ে রইল। তাই সারা উপন্যাস জুড়ে আছে নানা প্রসঙ্গে 'পুতুল' শব্দটির উচ্চারণ। এই পৃথিবী পুতুল নাচের মাঠ। মানুষেরা হচ্ছে পুতুল যাদের নাড়ায়ে অদৃশ্য সুতো দিয়ে কোনো এক বাজিকর।


মানুষের জীবনের ছোটো ছোটো স্বপ্ন-আশা, দুঃখ-বেদনা, নৈরাশ্য ব্যর্থতা সকল প্রকার ঢেউ দোলায়িত হচ্ছে বাজিকরের অদৃশ্য সুতোর টানে। সময়ের নদীতে প্রবাহমান স্রোতে সংগুপ্ত সেই অন্তর্বাস্তবকেই লেখক তুলে ধরেছেন ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র মূল অ্যাখ্যানে। এবং মূল আখ্যানের ভেতর আরও ছোটো বড়ো উপাখ্যান এনে অতীত ইতিকথা বর্তমানের প্রবাহমানতা, ভবিষ্যতের গভীর জৈবনিক ট্র্যাজেডিকে গ্রথিত করেছেন। কারণ মানুষের জীবন বৈচিত্র্যে ভরা। একই স্থান পরিবেশে মানুষের আচার আচরণ, সংস্কার কুসংস্কারে, যুক্তিবাদিতায়-আবেগে, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় একে অন্যের থেকে বড় স্বতন্ত্র ; জীবনের সাথে জীবনের ঘটনার সঙ্গে ঘটনার সমকালের সমাজ দেশের বিশাল ক্যানভাসের অঙ্গীভূত ইতিকথার মানব চরিত্র। তিরিশের দশকের মানুষের আশা নিরাশার হতাশা নিঃসঙ্গতার বহমান কাহিনির পরিচায়ক মূল আখ্যান হয়ে নানা উপকাহিনি।


লেখকের শৈশবের বাস্তব অভিজ্ঞতায় সূত্রে অন্বিত গ্রাম গাওদিয়া। লেখকের দীর্ঘকাহিনির উপকরণ এক গ্রাম্য ডাক্তার—সেও তাঁর কল্পনার ভিড় করে আসা স্মৃতিতন্ময়তা।


গল্পের নিয়ন্ত্রক নায়ক গ্রামের ডাক্তার শশী তার মানসিক দ্বন্দ্ব, অন্বেষণ, নিরীক্ষণ-ই লেখকের মূল উপজীব্য। শশীর দৃষ্টিতেই গ্রাম্যজীবনে বহুবিচিত্র রূপ, বহু মানুষের সাহচর্যে দ্বান্দ্বিক মন, স্ববিরোধ, দোলাচলতা, আশা-নিরাশা-বিষণ্ণতা-বেদনা ও ট্র্যাজিক উপলব্ধির চলমান ক্রিয়াশীলতা বিশ্লেষিত।


মধ্যবিত্ত অবক্ষয়িত বাঙালি যুব মানসের আত্মিক মন্ত্রণায় দীর্ণ শশী। সত্য উপলব্ধি, সত্য ও আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে না পারার বেদনায় অসহায় নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছে শশী। শরৎচন্দ্রের পল্লিসমাজের রমেশের মতো গ্রাম থেকে মুক্তি চেয়ে যে শহর অভিমুখে যাত্রা করতে চেয়েছিল, রমেশের মতো সেও বাঁধা পড়ল গ্রামেরই বদ্ধ আকর্ষণে। কিন্তু রমেশ নিজের স্বপ্নকে গড়ল গ্রামের মাটিতেই। কিন্তু শশী স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা বহন করেছে। অসহায় নিঃসঙ্গতায় নিজেকে যে ভেবেছে “মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করিবার ভাড়া করা সৈনিক। যাদব পণ্ডিতের অন্ধবিশ্বাস, গাওদিয়ার মানুষজনের আবেগ নির্ভর ভক্তির প্রাবল্য : সামন্ততান্ত্রিক সমাজের জটিলতা, শশীর দাঁড়িয়ে থাকা তটে সাক্ষ্য রেখে চলে গেছে। তেরোটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এই উপন্যাসের কাহিনি বৃত্ত বা প্লট। মূল প্লটটি গড়ে উঠেছে শশীকে কেন্দ্র করে। ডাক্তার হয়ে গাওদিয়ার গাঁয়ে ফেরার পথে বর্ণনার দিয়ে কাহিনির সূচনা হয়েছে। সেই থেকে শশীর দোলাচলতা, গাঁয়ে না থাকায় সংকল্প অথচ গ্রামের জীবনযাত্রার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় দশবছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার কাহিনি একটি বৃত্তে সম্পূর্ণতা পেয়েছে। আর সেই চলমান কাহিনির সঙ্গে এসে মিশেছে নানা আর্বত। শশী গোপালের সম্পর্ক ; শশী সেনদিদির ঘটনা ; শশী যাদব পণ্ডিতের সম্পর্ক এবং শশী কুসুমের রাগ অনুরাগ, মান অভিমানের কথা। এদের মধ্যে প্রবল প্রাধান্য লাভ করেছে গোপাল শশী এবং শশী কুসুম সম্পর্ক। আর যে উপকাহিনিগুলো শশীর আত্মিক যন্ত্রণাকে প্রবল করে তুলেছে তা হল মতি কুসুম উপাখ্যান ও বিন্দু নন্দলাল উপাখ্যান। এই উপাখ্যানগুলিও আদি মধ্য অন্ত সমান্বিত একটি কাহিনির সমন্বয় হয়ে উঠেছে। বোহোমিয়ান কুমুদের সঙ্গে মতিও যখন অজানা উদ্দেশ্যের সঙ্গী হল তখন এই উপাখ্যানটি মূল কাহিনির বিষাদময়তার মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পেল। মৃত্যুই সেখানে আঁধার প্রবাহের বৃত্ত গড়ে তুলেছে।


সেনদিদির মতো রূপসী বসন্ত রোগে চোখ হারিয়ে বেঁচে গেলেও অবৈধ সন্তানের জননী হয়ে কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে মারা গেছে। শশীর বাবা গোপাল সম্পর্কে জটিল আবর্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে আত্মসমতায় গড়া নিজ প্রতিপত্তি ত্যাগ করে নীরব যন্ত্রণায় গাওদিয়া ছেড়ে চলে গেছে।


যাদব পণ্ডিত ও পাগলাদিদি স্বেচ্ছামৃত্যুর নামে যে ভাবে আত্মবিসর্জন দিয়েছে তাতে আত্মপ্রবঞ্চনার যে ট্র্যাজিক সত্যটি ধরা পড়ে তাকেও লেখক মিথ্যার মহত্ত্ব ঘেরা আদি মধ্য সমন্বিত একটা প্লুটে পরিণত করেছে। শশীর বোন বিন্দু নন্দলালের সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হয়েও স্ত্রী স্বীকৃতি পায়নি সে নন্দলালের রক্ষিত রূপে পালিত। এবং শশীর সঙ্গে গ্রামে ফিরে আসা আবার শেষে নন্দলালের কাছে ফিরে যাওয়ার ঘটনায় কাহিনির পল্লবিত রূপটি ধরা দিয়েছে।


সমগ্র উপন্যাসের সেই সব উপকাহিনির নিয়ন্ত্রক শশী। সে প্রধান চরিত্র। লেখক নিরপেক্ষ দূরত্বে দাঁড়িয়ে নানা আকর্ষণ দিয়ে প্রবাহমান জীবনের নানা তরঙ্গ ভঙ্গিকে দেখাচ্ছেন। নানা আকর্ষণ বিকর্ষণ সূত্রে প্রতিটি উপাখ্যান তথা চরিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে শশী। এদের কেন্দ্র করেই শশীর মানসিক সংকট আত্মিক দ্বন্দ্ব, অনুভব অভিজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে। গোপাল, কুসুম, পরাণ, সেনদিদি, যাদব পণ্ডিত বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্কের ঘাত প্রতিঘাতে সংবেদনশীল শশীর অন্তর্বাস্তব মনস্তত্ত্ব, দ্বন্দ্ব আখ্যানও উপাখ্যানের পরিণাম সংঘটনে সক্রিয় হয়েছে।


শশীর বাবা গোপাল নিজ সন্তানের সঙ্গে চিরস্থায়ী বিরোধ এড়াবার জন্য গাওদিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছে। ন বছর ধরে শশী কুসুমের ভালোবাসা চললেও শেষপর্যন্ত কুসুমের আহ্বানে সাড়া দিতে পারেনি। অপমানিতা কুসুম ঘোষ পরিবারের সকলকে নিয়ে পিত্রালয়ে চলে গেছে। অথচ যে শশী সবার আগে গাওদিয়া ছেড়ে মুক্তি চেয়েছিল সেই-ই যেতে পারল না শেষ পর্যন্ত। মহাশ্মশানের প্রান্ত ভূমিতে দাঁড়িয়ে নিঃসীম বেদনায় সাক্ষাৎ হয়ে গেল রয়ে গেল ইতিকথার রাজ্যে।


শেষ অংশে লেখকের বর্ণনা তাই–জোরে আজকাল শশী হাঁটে না। মন্থর পদে হাঁটিতে হাঁটিতে গ্রামে প্রবেশ করে। শশীর চোখ খুঁজিয়া বেড়ায় মানুষ। যারা আছে তাদের আর যারা ছিল তাদের”। শশীর এই নিঃসঙ্গতাবোধের ট্র্যাজেডি গত শতাব্দীর বিশেষ দশকের যুব মানসের ট্র্যাজেডি। এই ভাবে লেখক কাহিনির মধ্যে কাহিনি, বড়ো কাহিনির মধ্যে ছোটো কাহিনির নিখুঁত বুননে শিল্পবোধের চূড়ান্ত পরিচয় দিয়েছেন।


গাওদিয়া গ্রামে শশী দাঁড়িয়ে পড়ে না ভাঙ্গা বৃক্ষের মত। যাকে কেন্দ্র করে যাদব পণ্ডিতের স্বেচ্ছামৃত্যুর বিড়ম্বনা, গোপালের সংসার বাসনার লড়াই, বিন্দুর ভোগজীবনের ট্র্যাজেডি, কুসুমের প্রেমবাসনার টানাপোড়েন প্রভৃতি শাখাপত্র পল্লবিত হয়েছে নিবিড় রহস্যে। লেখক বলেন, “আত্মীয় পরে মৃত্যুতে যাহারা শোক করে শশী তাহাদের মতো নয়”। শশীর মনস্তত্ত্বের স্রোত বড়-ই অন্তর্লীন।


কাহিনি বিন্যাসে ‘পুতুল’ ‘তালবন’ ‘টিলা' প্রভৃতি প্রতীক ব্যবহার দ্বারা লেখক উপন্যাসটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। গাওদিয়ার সমতল মন্থর জীবনে উঁচু টিলাটি শশীর আদর্শ আকাঙ্ক্ষার মতই উঁচু, তালবন শশীকুসুমের মুক্তির স্থান।


আর শশীর সযত্নে লাগানো গোলাপ চারা তো বুকের মধ্যে স্বপ্ন লালন। আর কুসুম তা বার বার মাড়িয়ে শশীর উদাসীন সৌন্দর্যের দৃষ্টিকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছে এ বিষয়টিও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তাই কুসুম তার অধিকার অর্জনের মতই বলেছে—ইচ্ছে করেই দিয়েছি ছোটোবাবু। চারার জন্য এত মায়া কেন ?”


এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রতীক, ব্যঞ্জিত হয়েছে নানা চরিত্রের মুখের বক্তব্য। উপন্যাসের শিল্পরূপ প্রকাশে যা অত্যন্ত জরুরি। যেমন কুসুমের মুখে চাঁদ ওঠবার আভাস, চাঁদনি রাত প্রেমাসক্তির ব্যঞ্জনায় অব্যক্ত আবেগ প্রকাশের সহায়ক হয়েছে।


ইতিকথার শশীকে পৌত্তলিকতার বাইরে আনার লড়াইয়ে ভেতরের নিত্য যুগদ্ধ সম্পাদিত হয়েছে কাহিনি—উপকাহিনি প্রতীকব্যঞ্জনার আন্তরিক প্রচেষ্টায়।