মধুসূদনের 'একেই কি বলে সভ্যতা' প্রহসনটির রচনার পটভূমি কী ছিল তা সবিস্তারে জানাও।

বেলগাছিয়া থিয়েটারে অভিনয়ের জন্য যখন মধুসূদনের 'শর্মিষ্ঠা' নাটকের আয়োজন ও মহড়া চলছিল তখন রাজা ঈশ্বরচন্দ্র নাটকের সঙ্গে প্রহসনের আবশ্যকতা উপলব্ধি করে মধুসূদনকে এক পত্রে জানান—“I thinking of some domestic force to follow immediately after the just representation of the-Sharmistha' and before it is repeated just to show the public that we can at the sublim and rediculous both at the same time and with same actors." এ পত্র মারফৎ জানা যায় যে রাজা চেয়েছিলেন যে, মহৎ উন্নতভাব (Sublime) এবং হাস্যরসাত্মক ভাব (rediculous) উভয় রসের নাটকের অভিনয় করা যে সম্ভব তা দেখাতে।


এ উদ্দেশ্য সফল হোক বা না হোক তাঁদের অনুরোধের ফলে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রহসন মধুসূদনের হাত দিয়ে জন্মলাভ করল। এ সম্পর্কে নগেন্দ্রনাথ সেন তাঁর ‘মধুস্মৃতি’ নামক গ্রন্থে জানিয়েছেন—“তাঁহার অন্যান্য গ্রন্থের ন্যায় এই দুইখানিও বঙ্গভাষায় প্রথম সর্বোৎকৃষ্ট প্রহসন এবং আজিও বাংলার প্রহসন সাহিত্যে অগ্রগণ্য।” প্রহসন দুটি পড়ে রাজারা আশ্চর্য হয়েছিলেন এবং রাজা ঈশ্বরচন্দ্রের ইচ্ছানুসারে দ্বিতীয় প্রহসনটির নাম ‘ভগ্ন শিবমন্দির’ (মধুসূদনকৃত)-এর পরিবর্তে 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' এই অদ্ভূত নামকরণ করা হয়েছিল।


প্রশ্ন হল, যাদের অর্থানুকূল্যে, উৎসাহে, প্রেরণায় মধুসূদন প্রহসন দুটি রচনায় প্রবৃত্ত হলেন তাঁদের নাট্যমঞ্চে কেন প্রহসন দুটি একবারের জন্যে অভিনীত হল না। এ সম্পর্কে মধুসূদনের অকৃত্রিম বন্ধু কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি পত্র থেকে জানা যায় যে, ইয়ং বেঙ্গল শ্রেণির কয়েকজন প্রতিনিধি ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ বিষয়বস্তু জানতে পেরে দারুণ হৈ চৈ বাধিয়ে দেন। কারণ তারা মনে করেছিলেন যে এই প্রহসনে তাঁদের সরাসরি বিদ্রুপ করা হয়েছে। রাজাদের ওপর প্রভাব আছে এমন একজন সম্মানিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিকে তাঁরা প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের কাছে পাঠিয়েছিলেন নাটকটির অভিনয় বন্ধ করার জন্যে। রাজারা প্রথমে রাজি হননি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন এবং অভিনয়ের পরিকল্পনা বাতিল করে দেন।


'একেই কি বলে সভ্যতার অভিনয় এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্যে রাজারা এত বিরক্ত হয়েছিলেন যে তারা দ্বিতীয় প্রহসনটির অভিনয়ের পরিকল্পনাই শুধু বাতিল করেননি, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ভবিষ্যতে বেলগাছিয়া নাট্যশালায় আর কোনো নাটকের অভিনয় করবেন না। অভিনয় বন্ধ হওয়ার প্রকৃত কারণ এবং সেই সঙ্গে রাজাদের ক্ষোভ ও বিরক্তির কথা মধুসূদনকে জানানো হয়নি; তাঁকে শুধু বলা হয়েছিল যেহেতু প্রহসন দুটির একটিতে ‘ইয়ং বেঙ্গেল' নামক নব্য সম্প্রদায়ের এবং অন্যটিতে প্রাচীনপন্থী হিন্দুদের দোষত্রুটি চারিত্রিক দুর্বলতা প্রভৃতির বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ নিক্ষেপ করা হয়েছে সেজন্য রাজারা প্রহসন দুটির অভিনয় করে উভয় সম্প্রদায়ের কাছে নিজেদের খাতির নষ্ট করতে চাননি।


মধুসূদন তাঁর বন্ধু, কেশবচন্দ্রের কাছ থেকে এ খবর শুনেছিলেন এবং মর্মে এত আঘাত পেয়েছিলেন সে তিনি তাঁকে একটি পত্রে জানিয়েছিলেন—“You broke my wings one about the farces; if you play a similar trick this time I shall for swear Bengali and write books in Hebrew or Chiness.".


তবে মনে রাখতে হবে, বেলগাছিয়া নাট্যশালায় অভিনীত না হলেও শোভাবাজারের রাজা দেবীকৃষ্ণদেব বাহাদুরের উদ্যোগে ১৮৬৫ খ্রিঃ শোভাবাজারের থিয়েট্রিক্যাল সোসাইটিতে ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রথম অভিনীত হয়। এই অভিনয়ে কালীনাথ বাবুর ভূমিকায় উপেন্দ্রকুমার দেব, প্রসন্নময়ীর—ভূমিকায় অমরেন্দ্রকৃষ্ণ দেব, হরকামিনীর ভূমিকায়—কুমার রাজকৃষ্ণদেব এবং নবকুমারের ভূমিকায়—মণিমোহন সরকার অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সে অভিনয় যে যথাযথ হয়েছিল তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় তার প্রমাণ মেলে।