‘অরণ্যের অধিকার' উপন্যাস অনুসরণে সংগীতের প্রয়োজনীয়তা কী?

‘অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসে লেখিকা বেশ কয়েকটি সংগীত ব্যবহার করেছেন। সংগীত মূলত চিত্ত বিনোদনের নিমিত্তে ব্যবহৃত হয়ে থাকে কিন্তু সর্বত্রই সংগীতের ব্যবহারিক গুরুত্ব এক নয়। কোথাও বিষাদময়তাকে তরল করতে, কোথাও প্রেম ভালোবাসার অব্যক্ত কথকে সুরের মাধ্যমে প্রকাশ করতে, আবার কোথাও প্রতিরোধের উন্মাদনায় জনজারণের নিমিত্তে সংগীতের ব্যবহার লক্ষিত হয়। আলোচ্য উপন্যাস ইতিহাসের আদিবাদী আন্দোলনের আলেখ্য, বীরসা বিদ্রোহের আলেখ্য। কাজেই এ উপন্যাসে যে সংগীতগুলি ব্যবহৃত হয়েছে, তা যে শুধু চিত্ত বিনোদনের জন্য নয় তা সহজেই অনুমান্ করা চলে। বলাই বাহুল্য, এখানে যে সংগীতগুলি ব্যবহৃত হয়েছে তা জনজাগরণের জন্য।


ইংরাজ পুলিশের অকথ্য অত্যাচার রাঁচি জেলের মধ্যে বীরসা মুণ্ডার মৃত্যু হয়েছে। জেল সুপার অ্যান্ডারসন অন্যান্য মুণ্ডা বন্দিদের ডাক পাঠিয়েছেন সরকারি নিয়মানুযায়ী বীরসাকে সনাক্ত করতে। কিন্তু কেউ কিছুতেই চোখ তুলছে না। তবে শেষ মুহূর্তে একজন বন্দি দাঁড়িয়েছিল সনাক্ত করতে, নাম তার ভরমি মুণ্ডা। সে আপনা থেকে দুর্বোধ্য মুণ্ডরী ভাষায় কান্নার মতো সুর করে গান গাইতে লাগল।


“হে ওতে দিসুম সিরজাও

নি আসিয়া আনাসি 

আলম আনদুলিয়া 

আমা রেগে ভরোসা 

বিশ্বাস মেনা !”


এ গানের আক্ষরিক অর্থ হল—“হে পৃথিবীর স্রষ্টা, আমাদের প্রার্থনা ব্যর্থ করো না। তোমাতে আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস।” ভরামির কণ্ঠের এ গান কোনো আনন্দের আবেগ মথিত ধারা নয়, এ যেন মহান আত্মার প্রতি ঈশ্বরের নিকট শান্তি প্রার্থনা এবং নিজেদের বর্তমান অসহায় অবস্থার মধ্যে থেকেও তাদের বীর নেতার প্রতি এখনো যে তারা শ্রদ্ধাবনত চিত্ত, এটাই প্রকাশ পেয়েছে।


বীরসার মতো এমনি করে একদিন তার সহকর্মী সুনারা জেলখানায় মুখে রক্ত উঠে মারা গিয়েছিল। সুনারার মাথাটা ছিল ধানীর কোলে। ধানী দুলতে দুলতে গান গাইতে থাকল—

“বোলোপে বোলোপে হেগা মিসি হেনকো।

হোই ও ডুডুগার হিজু তানা।

বোলোপে।”


গান খানি দীর্ঘ। গানখানির মূল ভাববস্তু ছিল—“ও ভাই ও বোন, ও ছেলেরা ছুটে যা, প্রাণ বাঁচা, আঁধি উঠেছে। ও ভাই...। ঝড় মাটির বুকে, আকাশ ঢাকা কুয়াশায়। আমাদের দেশ দেখে ওই ছিনে নিয়ে গেল। ও ভাই...। পরে আর পথ পাবি না রে। সব যে আঁধারে আঁধারে। ও ভাই....।” অবহেলিত, অসহায়, নির্যাতিত মুণ্ডারা দিকু এবং ইংরাজ সরকারের প্রতি কটাক্ষ হেনে এমন গান গাইত। অবশ্য এ গানটি উপন্যাস মধ্যে অনেকবার গীত হয়েছে এবং তাৎপর্যগত দিক থেকে গানটির গুরুত্বও অপরিসীম।


জীবনের সবচেয়ে বেদনার্ত মুহূর্তগুলো মুণ্ডারা গানে গানে ধরা রাখে। সে গান কে বাঁধে কে সুর দেয় কেউ জানে না। জেলার মধ্যে বসে ধনী অন্যান্য বন্দি মুণ্ডাদের গল্প করে শোনায় যে গল্পের বিষয়বস্তু ছিল মুণ্ডাদের অতীত জীবন। গল্প করতে করতে ধানীর মনে পড়ে যায় যৌবনে তাদের গাওয়া গানের কথা। সে গেয়ে ওঠে—

“বেঠবেগারী দিতে মোর কাঁধে ঝরে লৌ গো।

জমিদারের পেয়াদা ওই রাতে দিনে।

তাড়ায় মোরে, কাঁদি আমি বাতি দিনে…"

মূলত দিকুদের সর্বগ্রাসীতার চিত্র পরিস্ফূটই গানটির মূল লক্ষ্য।


বীরসা দেখলো শুধু সাধারণ মানুষের মতো সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করলে চলবে না, তার আগে দরকার জনমত গঠনের। তাই অরণ্যের সঙ্গে আঁতাত গড়ে বীরসা নিজেকে ভগবানের অবতার রূপে প্রচার করে সকল সাধারণ মুণ্ডারীদের ডাক দিয়েছিল এক হতে। দলে দলে সাধারণ মানুষ বীরসার ডাক পেয়ে ছুটে এসেছিল চালকাড়ে, আর মুখে তাদের ভেসে উঠেছিল সঙ্গীত লহরী—

“নে মুলুক দিসুম্ রে ধরতি, আবায় হাইজি লেখায়ে ভাদ্রমাসে, 

মানোয়া হোন্‌কো বসিক তামারে ভাদ্র মাসে..... "


এ সংগীতের মধ্য দিয়ে তারা বলতে চেয়েছে—এই দেশেতে ধরতি আবা জন্মালো গো ভাদ্র মাসে, মানুষ আনন্দ করে ভাদ্র মাসে, প্রার্থনা জানায় মানুষ সার বেঁধে এসে চলে যায় দল বেঁধে। এই দর্শনার্থীদের মধ্যে ছিল না কোনো জাত পাতের ব্যবধান, হিন্দু-বেনে মুসলিম—সবাই চলেছিল চালকাড়ে। একমাত্র উদ্দেশ্য—

“বীরসাকে দেখবে তারা।

মুণ্ডারা গান গাইছিল, গান গাইছিল হিন্দু-সনদরা।

পায়ে পড়ি বলো কতদূর চালকাড়?”


এ সকল গানের মধ্য দিয়ে মুণ্ডারা তাদের ধরতি আবা বীরসার গুণকীর্তনে আত্মহারা তারা বীরসাকে দেখতে আসার সময় যেমন গান গেয়েছিল আবার সেই গান অন্যেরা শুনে তাদের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল, আর গেয়েছিল—

‘চলহে মিতা চালকাড়ে যাই,

বনের বুকে চালকাড়ে যাই 

তারে দেখতে চল যাই।”


গানের সুর যে জোট বাঁধতে সহায়তা করে মুণ্ডাদের এ সকল গান তার প্রমাণ দেয়।

উপন্যাসের ষোড়শ অধ্যায়ে দেখা যাচ্ছে, বীরসা দু’বছর কয়েদ খেটে ফিরে তার বিদ্রোহী দলকে নতুনভাবে নতুন পদ্ধতিতে পরিচালনা করতে সচেষ্ট হয়। সকল বিদ্রোহীরা তাদের নিজেদের মধ্যে ব্যবধান ভুলে সমস্বরে গেয়ে উঠলো—

“সিরমারে ফিরুন রাজা জয়! 

ধরতি রে পুড়োই রাজা জয়!”


এ কথার অর্থ—জয় স্বর্গের ঈশ্বরের জয় পৃথিবীর ভগবানের। দীর্ঘদিনের নির্যাতনের পরে মুণ্ডারা তার ধরতি আবাকে পেয়ে যে সত্যিকারের বাঁচার নিশানা পেয়েছে এ গানগুলিই তার প্রমাণ দেয়।


গরিব ঘরের ছেলে ধরতি আবা হয়েছে, বীরসা অবতার স্বরূপ এ সংবাদ যেমন ক্রমেই দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তেমনি বীরসার বাবা সুগানা ও মা করমির সংসারে নেমে এসেছিল সুখের আবেশ। সুগানার নাতনী, কোমতার বড়ো মেয়ে, ও সবার মুখে মুখে ফেরে যে গান সে গানটি শিখে ফেলেছে—

“কোন দেশেতে নূতন রাজার জন্ম হল হে? 

হা তুই মুখ হল দেখ আকাশে ওই ধূমকেতু!

চালকাড়েতে নূতন রাজার জন্ম হে...।”


আসলে আকাশে বাতাসে জলে স্থলে সর্বত্রই বীরসার মহিমা কীর্তন অনুরণিত হচ্ছে। মুণ্ডারা আজ সত্যিই তাদের প্রাণের দেবতাকে ফিরে পেয়েছে।


বিপ্লবীদের সংঘবদ্ধ হওয়ার পালা শেষ। এবার তারা মেতে উঠবে হোলির উৎসবে। তবে হোলির উৎসবে তারা সংগীতের নৃত্যের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে কীভাবে ব্যবস্থা নেবে তার আয়োজন, শলাপরামর্শ করবে। স্থান হিসাবে বেছে নিল—সিয়া পাহাড়। তিনশো মুণ্ডা তীর ধনুক নিয়ে হাজির হল—

“দুন দিগারার দুখন কারেও ডরে না হে

রামগারার রোতন সাই কারেও জরে না হে।।"


এই হোলির উৎসব শুরু হয়েছিল মুণ্ডা জাতির দুই বীর দুখন সাই, রোতন সাইয়ের গান দিয়ে। এই গানের মধ্যে তারা যে নির্ভীক এমন একটি ভাব প্রকট করতে চেয়েছে।


বীরসার নির্দেশে মুণ্ডারা তাদের প্রথম কর্মসূচী হিসাবে বেছে নিয়েছিল চুটিয়া ও জগন্নাথপুরের মন্দির দখল করলেও দখল না রেখেই অরণ্যের মধ্যে আত্মগোপন করেছিল। পুলিশ বাহিনী অরণ্যে অরণ্যে চিরুণী তল্লাশী চালালো কিন্তু বীরসা বাহিনীর সন্ধান পাচ্ছিল না। ব্যর্থ হয়ে পুলিশরা ফিরে গেলে আবার তারা লুকানো স্থান থেকে বেরিয়ে এসে গান ধরতো।

“বীরসা ভগবান ডাকল, ও ভাই চল যাই 

চুটিয়া মন্দিরে.....।”


কোথা থেকে যেন অসম্ভব জোর পেয়েছিল ওরা মনের ভিতর। একটা স্থির বিশ্বাসে জ্বলে উঠেছিল ওরা। তাইতো গাইছিল—

“জমিদারের অত্যাচারের যন্ত্রণার

মানুষের দুঃখে দেশ আজ উত্তাল

চল, তুলে নাওঁ ধনুক, তীর ও বলোয়া।”.....ইত্যাদি


সেদিন—“গানটা শুনে বীরসার বুক কেঁপে উঠেছিল বারবার। একি বলছে মুণ্ডারা? বাঁচার চেয়ে মৃত্যু ভাল? কে বাঁধল এ গান? কে সুর দিল? কেউ বলতে পারেনি। বীরসা বুঝেছিল এ গানের রচয়িতা হল সময়। সুরও সময়ের দেওয়া।”


বীরসার নেতৃত্বে তার বিদ্রোহী মুণ্ডা বাহিনী একে একে আক্রমণ শুরু করল—গীর্জাতে আগুন ধরালো, জমিদারের বাড়িতে আগুন ধরালো, পুলিশদের অতর্কিত আক্রমণ করে বলোয়ার ঘায়ে নিঃশেষ করল, খণ্ড যুদ্ধে পুলিশের কাছে সপরিবারে ধরা পড়লো বিদ্রোহী গয়া মুণ্ডা। তবুও বিদ্রোহী মুণ্ডারা থেমে থাকলো না। বীরসার সৈন্যরা খুনটি থানা আক্রমণে ধাবিত হল। ওরা গাইছিল—

“জিলিবা জিলিবা জোলোবা জোলোবা পানতিয়াকানালে বীরসা হে…”


এ সংগীতের অর্থ হল— “মোদের হাতিয়ার জ্বলছে হাতে ও বীরসা ! আমরা চলেছি সার বেঁধে। বাম হাতে ধনুক ডান হাতে তীর, মোদের হাতিয়ার জ্বলছে হাতে ও বীরসা আমরা চলেছি সারবেঁধে।”—এ সংগীত যে শোষিত-বঞ্চিতের তীব্র হুঙ্কার তা বলাই বাহুল্য।


‘অরণ্যের অধিকার' উপন্যাস মধ্যে লেখিকা বীরসার গুণকীর্তনে উক্ত সংগীতগুলি ব্যবহার করলেও আসলে তা যে জয়গানের পশ্চাতে অস্তির্নিহিত জিঘাংসার বাণীরূপ, গানগুলির প্রকৃতিই তা প্রমাণ করে। দলবেঁধে মুণ্ডাদের এমনভাবে গান গেয়ে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করা তা যে ইংরাজ সরকারের টনক নড়িয়ে দিয়েছিল তার প্রমাণ মেলে—“১২ জানুয়ারি (১৯০০ খ্রিস্টাব্দে) সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইণ্ডিয়াকে বড়লাট টেলিগ্রাম করলেন-গণ-বিদ্রোহ ব্যাপ্তি লাভ করিতেছে।" আসলে বীরসার 'উলগুলান'ই তো গণ-বিদ্রোহ।