বাংলা কাব্যসাহিত্যে মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮ খ্রীঃ-১৯৫২ খ্ৰীঃ)

বাংলা কাব্যে মোহিতলাল মজুমদার


“আমারই নূতন দেহে ওগো সখী জীবনের দীপখানি জ্বালো”—এই ব’লে যিনি দেহ অরণীর মন্থনে অগ্নিকণা জ্বালিয়ে মদনের আরাধনা করতে চেয়েছেন, গরুড়ের তীব্র অমৃত-পিপাসার মতোই যাঁর কণ্ঠে ছিল দুরন্ত জীবন-পিপাসা, ভিনাস দ্য মিলোর মূর্তির মত যাঁর পরিশীলিত কবি-মানসে সৌন্দর্যের অনাবৃত অথচ প্রশান্ত-গম্ভীর প্রকাশ—তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর ঐতিহ্যপুষ্ট, বিবর্তনশীল যুগ-মানসের সর্বশেষ প্রতিভূ, কবি মোহিতলাল মজুমদার।


মোহিতলাল মজুমদারের জন্ম ও কর্মজীবন:

১৮৮৮ খ্রীস্টাব্দের ২৬শে অক্টোবর হুগলী জেলার বলাগড় গ্রামে কবির জন্ম হয়। বি. এ. পরীক্ষায় দু’বার সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। মেট্রোপলিটন কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেন। বেশ কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। তারপরে ১৯২৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক রূপে যোগ দেন। ১৯৪৩ সালে অবসর নেন। এই সময় নীরদ সি. চৌধুরীর মতো কিছু স্বনামধন্য ছাত্র তাঁর সান্নিধ্যে আসেন (দ্রষ্টব্য : 'An autobiography of an unknown Indian')। বাংলা ভাষা ছাড়া ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন। মধুসূদন-রবীন্দ্র-শরৎ এবং আধুনিক সাহিত্য সমালোচনায় তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।


মোহিতলাল মজুমদারের সাহিত্যচর্চা:

মোহিতলালের সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্র ছিল প্রথমে ভারতী পত্রিকা, তারপরে হয় রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে মুক্তির জন্য ‘কল্লোল’ এবং ‘কালি কলম' পত্রিকা। বুদ্ধদেব বসু সেইজন্য পরবর্তীকালে বলেছিলেন—“আমাদের তরুণ বয়সে, যখন রবিদ্রোহিতার প্রয়োজনীয় ধাপটি আমরা পার হচ্ছিলাম, তখন যে দু-জন কবিতে আমরা তখনকার মতো গত্যন্তর খুঁজে পেয়েছিলাম, তাদের একজন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, আর অন্যজন বিস্মরণীর মোহিতলাল”।


স্নিগ্ধ আলোকধারায় পরিস্নাত এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পৃথিবীই ছিল কবির যৌবন-স্বপ্নের বৃন্দাবন। এপিক্যুরাসের মত তিনিও বিশ্বাস করতেন : "Our senses are our only guide to truth"। কিন্তু তার কাব্যের জীবনবন্দনা বিদেশের কাব্য-মালঞ্চ থেকে ধার করা কোন কৃত্রিম উপাদান নয়, তা এদেশেরই পরিবেশ-উদ্ভূত। বলিষ্ঠ পৌরুষ এবং কামনার রক্তরাগ নিয়ে বাংলা কাব্যক্ষেত্রে এক ক্রান্তি মুহূর্তে তার আবির্ভাব। 'সত্যসুন্দর দাস' ছদ্মনামে মোহিতলাল প্রথমে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু ক্রমশই জীবন ও কাব্য সম্পর্কে তার নিজস্ব প্রত্যয় জেগে উঠতে থাকে। এই প্রত্যয় ক্লাসিক বা ধ্রুপদী ভাবনায় পরিশুদ্ধ। বাংলা কাব্যের ললিত কোমল আকাশচারী ভাবকল্পনার মধ্যে তিনি দেহবাদ, ক্লাসিক বজ্রকাঠিন্য এবং দৃঢ় প্রত্যয়ী গতি সঞ্চার করলেন। 'ভারতী' পত্রিকার পাতায় তখন শুরু হয়েছে পল্লীসুরের আসর। অপরদিকে বাঙালী কবি ও বুদ্ধিজীবীর দল তিক্ত-রিক্ত জীবন জিজ্ঞাসায় 'কল্লোল'-এ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় হয়েছেন নিয়োজিত। বোদলেয়ার, লরেন্স, কাউন্টি ক্যালেন, ফ্রয়েড্, হাক্সলি আর হুইটম্যানের মধ্যে তারা চাইছেন মানসিক আশ্রয়। আর সেই সময় দার্শনিক শোপেনহাওয়ারের দুঃখবাদী, নারী বিদ্বেষী জীবনদর্শনকে ‘চ্যালেঞ্জ' জানিয়ে 'কল্লোল’-এ মোহিতলাল এলেন ‘পান্থ’-রূপে। কেবল এই দীর্ঘ কবিতায় নয়, তার সমগ্র কাব্য-সাধনার মধ্যেই আছে জীবন-বাসনার বলিষ্ঠ প্রকাশ।


মোহিতলাল মজুমদারের রচনাসমূহ:

(ক) কাব্যগ্রন্থ : ‘দেবেন্দ্রমঙ্গল’ (১৯২২, কবির আত্মীয় দেবেন্দ্রনাথ সেনের প্রশস্তিমূলক ১৬টি সনেটের সংকলন), 'স্বপনপসারী’ (১৯২২), ‘বিস্মরণী' (১৯২৭), ‘স্মরগরল’ (১৯৩৬), 'হেমন্ত-গোধূলি' (১৯৪১), ‘ছন্দচতুর্দশী' (১৯৪১)।


(খ) সম্পাদনা : ‘কাব্যমঞ্জুষা' কাব্য সংকলন এবং ‘বঙ্গদর্শন' (নব পর্যায়) এবং ‘বঙ্গভারতী’ পত্রিকা।


(গ) প্রবন্ধগ্রন্থ : 'আধুনিক বাঙলা সাহিত্য' (১৯৩৬), ‘সাহিত্যকথা’ (১৯৩৮), ‘বিবিধ কথা’ (১৯৪১), 'বিচিত্র কথা' (১৯৪১), ‘সাহিত্য বিতান’ (১৯৪২), ‘বাঙলা কবিতার ছন্দ’ (১৯৪৫), ‘বাঙলার নবযুগ' (১৯৪৫), ‘জয়তু নেতাজী' (১৯৪৬), ‘কবি শ্রীমধুসূদন’ (১৯৪৭), ‘সাহিত্য বিচার' (১৯৪৭), 'বঙ্কিমবরণ’ (১৯৪৯), ‘রবিপ্রদক্ষিণ’ (১৯৪৯), ‘শ্রীকান্তের শরত্চন্দ্র’ (১৯৫০), ‘জীবন জিজ্ঞাসা’ (১৯৫১), ‘বাঙলা ও বাঙ্গালী’ (১৯৫১), 'কবি রবীন্দ্র ও রবীন্দ্রকাব্য' (১ম খণ্ড ১৯৫২, ২য় খণ্ড ১৯৫৩), ‘বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস' (১৯৫৫)।


ক্ল্যাসিক ও রোমান্টিক ভাবনা, বৈষ্ণব ও তান্ত্রিক মনোভঙ্গীর বিচিত্র সমন্বয়ে মোহিতলালের কবি-মানস অভিব্যক্ত। কোথাও বলেছেন

“দেহ ভরি কর পান কবোষ্ণ এ প্রাণের মদিরা 

ধুলা মাখি খুঁড়ি লও কামনার কাচ মণি হীরা”


কোথাও বা হুইটম্যানের মতো ("From no man under the sky /Lives twice out living his day") দৃঢ় প্রত্যয়ে সতর্ক করেছেন

“সত্য শুধু কামনাই- মিথ্যা চির মরণ-পিপাসা

দেহহীন স্নেহহীন, অশ্রুহীন বৈকুণ্ঠ স্বপন

যমদ্বারে বৈতরিণী, সেথা নাই অমৃতের আশা

ফিরে ফিরে আসি তাই, ধরা করে নিত্য আমন্ত্রণ”


প্রেম ও নারী-রূপের মধ্যে শোপেনহাওয়ার দেখেছিলেন সমস্ত অমঙ্গল ও সর্বনাশের ইঙ্গিত : "The lovers are the traitors who seek to penetrate the whole world and drudgery which could otherwise speedily reach and end..." আর মোহিতলাল এর বিপরীতে নারীর মোহিনীরূপে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন

“সুন্দরী সে প্রকৃতিরে জানি আমি মিথ্যা সনাতনী

সত্যেরে চাহি না তবু সুন্দরের করি আরাধনা”


এইভাবে শোপেনহাওয়ারের কাছে যা 'perpetual drudgery' ('পাহ্’), মোহিতলালের কাছে তাই-ই হয়ে উঠেছে অখণ্ড অফুরস্ত জীবন পিপাসা।


মোহিতলাল মজুমদারের কাব্যে রবীন্দ্র-বিরোধিতা:

শোপেনহাওয়ারের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের দেহাতীত ভাবকল্পনার বিরুদ্ধেও মোহিতলাল হয়েছিলেন সোচ্চার। প্রশ্ন করেছিলেন কখনো অলক্ষ্যে—'‘কতদিন ভুলাইবে মর্ত্যজনে বিলাইয়া মোহন-আসব হে কবি বাসব?” ('মোহমুদগর'), কখনো রবীন্দ্রনাথের ‘ঊর্বশী' কবিতার বিপরীত-ভাবের উপস্থাপনায়

“নও গৃহিণী, নও ঘরনী-সেইটি যে গো সকল ভুলের ভুল! 

সংসার ত’ তারেই বলে-নিত্য ঝরা পলকা বোঁটার ফুল। 

একটু আছে গন্ধ মধু, তাতেই করে অমর-

পরশ মণির পরশ সে যে-বধূ-বরের অধর।”


রবীন্দ্রনাথের নারী যেখানে অর্ধেক মানবী আর অর্ধেক কল্পনা, সেখানে মোহিতলালের নারী মানুষের কামনা-বাসনায় ভরা। কিন্তু রবীন্দ্র-বিরোধিতা করলেও শেষ পর্যন্ত দেহের মাঝে দেহাতীত ক্রন্দনই তাঁকে বিচলিত করেছে। সংসার লতার কাঁটায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রবীন্দ্রনাথ যেমন অনন্ত প্রেমে জড়াতে চেয়েছেন, ভোগের সমস্ত বেদনার মধ্য দিয়ে মোহিতলালের দাবী ছিল সেইরকম। তাই দেহবাদকে আশ্রয় করেও শেষপর্যন্ত তিনি যাত্রা সাঙ্গ করেছেন উনিশ শতকের রোমান্টিক বেদনাবাদে

“যত ব্যথা পাই-তত গান গাই, গাঁথি সে সুরের মালা, 

নয়নে আমার ওগো সুন্দর নীল কাজলের জ্বালা!...

যত সে কাঁদায় তত বুকে বাঁধি, তত তারে ভালোবাসি-

ধরণীর এই শ্যাম মুখখানি, আঁধার অলকরাশি।”

এ বেদনা তাঁর কণ্ঠে “গীত হয়ে বাজে, ব্যথায় বৃহৎ হয়ে সে ফুল বিরাজে”।


মোহিতলাল মজুমদারের কাব্যে মানবতাবাদ:

মোহিতলালের কাব্য নব মানবতাবোধের সুষ্ঠ গীতোচ্চারণ। ঈশ্বর, জাতি, সমাজ বা রাষ্ট্রের যূপকাষ্ঠে বলির যোগ্য ব’লে ধরে নিয়ে ব্যক্তিমানুষের সমাপ্তিহীন আত্মসম্প্রসারণ বাসনাকে দলিত করার যে ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, মোহিতলাল ছিলেন তার পরম শত্রু। তার ‘কালাপাহাড়’ কবিতায় আছে সেই বন্ধনহীন মানুষের আবাহন মন্ত্র

“ভেঙ্গে ফেল মঠ মন্দির চূড়া দারু শিলা কর নিমজ্জন 

বলি-উপাচার ধূপ-দীপারতি রসাতলে কর বিসর্জন।

নাই ব্রাহ্মণ ম্লেচ্ছ যবন, নাই ভগবান ভক্ত নাই, 

যুগে যুগে শুধু মানুষ আছে রে, মানুষের বুকে রক্ত চাই।”


এখানে কালাপাহাড় কেবল ধ্বংসের প্রতীক নয়, দেবতা-জয়ী বীর্যবান্ মনুষ্যত্বের জীবন্ত বিগ্রহ। বস্তুতঃ কালাপাহাড় রহস্যাচ্ছন্ন এক ঐতিহাসিক চরিত্র। তিনি ছিলেন বাংলার নবাব সুলেমান ও পরে তার পুত্র দায়ুদের সেনাপতি। তাঁর দেবতা ও হিন্দু বিদ্বেষ কুখ্যাত। দুটি জনশ্রুতি তার সম্পর্কে সুপ্রচলিত। একটি মতে, প্রথমে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ, পরে এক নবাবকন্যার প্রণয়াকর্ষণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় কিংবদন্তী হল, তার প্রচণ্ড হিন্দু দেব-দেবী বিদ্বেষের প্রমাণ সূচক তাঁর আগমন বার্তা জ্ঞাপক কাড়া নাকাড়া বেজে উঠলে মন্দিরের পাষাণ বিগ্রহগুলি নাকি ভয়ে কেঁপে উঠত। এই জনশ্রুতির ভিত্তিতে মোহিতলাল তার কল্পনেত্রে অন্ধ আচার ও নিষ্ঠুর সংস্কারের অচলায়তন রূপী মন্দিরগুলির শঙ্কাতুর চিত্র এঁকেছেন

“আঁধার গহ্বরে জাগে হাহাকার। বিগ্রহ-শিলা আপনি ফাটে 

পূজারি-পাণ্ডা ঝাণ্ডা নামায়ে প্রাঙ্গণতলে খায় আছাড় !

ঐ আসে-ঐ বাজায় দামামা, ভীম নির্ঘোষে কাড়া-নাকাড় কালাপাহাড়!”


মানুষের কায়ার পিছনে দেবতার ছায়া চিরদিন শৃঙ্খলের মত তার দৃপ্ত গতি রুদ্ধ করেছে। ফল হয়েছে শুধু আত্মপ্রবঞ্চনা। সেই যুগান্তের মোহ ভাঙবার দুন্দভি বেজেছে কালাপাহাড়ের বিজয় উল্লাসে

“জীবের চেতনা জড়ে বিলাইয়া আঁধারিল কত শুক্ল নিশা, 

রক্তলোলুপ লোল রসনায় দানিল নিজেরি অমৃত-তৃষা, 

আজ তারি শেষ! মোহ অবসান! দেবতা দমন যুগাবতার 

আসে ওই! তার বাজে দুন্দভি-বাজায় দামামা কাড়া-নাকাড় কালাপাহাড়!”


মানুষের কাছে দেবতার এই পরাজয়ের মধ্যে আত্মমহিমায় উজ্জীবিত যে তার তপ্ত আত্মপ্রসাদ, কালাপাহাড়ের বিজয় উল্লাস তারই প্রতীক। আধুনিক গীতিকবিতার ইতিহাসে ‘কালাপাহাড়’ সম্ভবতঃ সর্বোত্তম মানব-বন্দনাগান। মনুষ্যত্বের এরকম নিঃশঙ্ক মহান রূপ বিরল। গম্ভীর বৈদিক মন্ত্রের মত একেকটি সুডৌল স্তবক রচনা করে কবি এখানে বাজিয়েছেন আধুনিক মানবতার দুঃসাহসিক বিজয়-দুন্দভি।


মোহিতলাল মজুমদারের কাব্যে দেহবাদ:

আমাদের মাতৃভূমিতে ত্যাগের মিথ্যা মহিমা প্রচারে বার বার জীবের ভোগস্পৃহা হয়েছে স্তিমিত ও দমিত। জীবনবিমুখ মায়াবাদে ও পারলৌকিক তত্ত্বচিন্তায় প্রাণের স্বাভাবিক প্রকাশের পথ হয়েছে অবরুদ্ধ। এই ভাবপন্থী চিন্তাধারা লক্ষ্য করে মোহিতলাল নিক্ষেপ করেছেন ‘মোহমুদগর’। “চিরমৃত্যু মোক্ষ অভিলাষী”-কে ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ করেছেন, মায়াবাদী শঙ্করাচার্য এবং বামমার্গী কাপালিক তান্ত্রিকদের ধিক্কার দিয়েছেন

“শ্রেয়সী নারীর মুখে হেরি বিভীষিকা 

আপনারই বক্ষ-রক্তে পড়ি জয়টিকা

কি লভিলে, ওহে বীর, বামমার্গী কাপালিক

নাস্তিক তান্ত্রিক? 

ধিক্ তোমা ধিক্!”


তারপরে কল্পনার ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনুচ্ছটা বিস্তার করে কবি-সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথের নির্দেহ নীতি-নিষ্ঠ শুচিতাকে সমালোচনা করেছেন। নিবৃত্তিমার্গের দুর্গে আশ্রয় নিলেই যে মদনকে এড়ানো যায় না সে সম্বন্ধে সতর্ক করেছেন। কারণ, দুর্লভ এই দেহময় মনুষ্য জীবন : “দেহ-দ্রুমে বিকশিল মনোজ মন্দার / শুক্তিগর্ভে সুদুর্লভ মুকুতা-সঞ্চার।” অথচ মানুষ তাকে অবহেলা করে “শূন্যে বাহু প্রসারিয়া নিত্য হাহাকার করে।” এ জীবন অলীক স্বপ্ন নয়। ব্ৰহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা, এ বাক্যও অর্থহীন। পৃথিবী রূপসী। “বিষ্ণু নাভি পদ্মশায়ী স্রষ্টা প্রজাপতি”-র আলিঙ্গনে বাঁধা যুবতী বধূ কোন মতেই ক্ষণচ্ছায়া নয়। তাই কবির বলিষ্ঠ আহ্বান

“এসো কবি, এসো বীর, নির্মম সাধক এসো, এসো হে সন্ন্যাসী,

ছিঁড়ে ফেল অদৃষ্টের ফাসী

দেহ ভরি কর পান কবোষ্ণ এ প্রাণের মদিরা 

ধুলা মাখি খুঁড়ি লও কামনার কাচ মণি হীরা।”


মোহিতলাল মজুমদারের কাব্যে কল্লোল-গোষ্ঠীর সঙ্গে ভিন্নতা:

বাংলা কাব্যে দেহবাদের প্রবক্তা হয়েও মোহিতলাল কিন্তু যাযাবরী উদ্দামতাকে প্রশ্রয় দেন নি। তাই ‘কল্লোলে’র কবিদের কাছে ‘দ্রোণাচার্য’ হয়েও তার সঙ্গে মোহিতলালের সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। কল্লোল গোষ্ঠীর তীব্র নিরাশা আর আদিমতার আসক্তিতে তিনি ছিলেন নিঃস্পৃহ। কল্লোলীয়দের সঙ্গে মোহিতলালের মানসিকতার পার্থক্য আছে: মোহিতলালের বিদগ্ধ কবি-মানসে শেষ পর্যন্ত ‘কাম’ দেহকে আশ্রয় করে সার্থক হয়ে উঠেছে। কিন্তু কল্লোলীয়দের কাছে কামের জন্যই দেহ, অথচ সেই সম্ভোগের মধ্যে নেই কোন আধ্যাত্মিক তৃপ্তি। এমিল জোলার ন্যাচারিলিজম্, লরেন্সের সেক্স ও ঈডিপাস তত্ত্ব, ‘লেডী চ্যাটার্লি’র সংস্কার মুক্তি, নুট হামসুনের ‘ক্ষুধা' ইত্যাদি সবকিছুই তার কাছে ভোগ্য ও আস্বাদ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু মোহিতলাল দেহের সৌন্দর্য ধ্যানেই শেষ পর্যন্ত তন্ময় হয়ে ভালোবাসার মহিমা উপলব্ধি করেছেন : “আমার দেবতা সুন্দর সে যে, পূজা নয়—ভালোবাসি।” মানুষের মাঝে দেবতার, দেহের মাঝে আত্মার স্বীকৃতিদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কবিতার ভাববৃত্ত পূর্ণ হয়েছে।


মোহিতলাল মজুমদারের কাব্যে রূপরীতি:

কবিতার ভাবানুসঙ্গ ও রূপনির্মিতিতে মোহিতলাল ক্ল্যাসিকপন্থী। কবিতার রূপ বা Form সম্পর্কে তিনি বিশেষ সচেতন ছিলেন। তাঁর মতে, "Form বলিতে রচনার একটি পারিপাট্য ও পরিচ্ছন্নতা বুঝায়—ভাষাও যেমন গাঢ়বদ্ধ হইবে, কবিতার গঠনও তেমনই সুসম্বন্ধ ও আকার সুপরিকল্পিত হইবে।” তাঁর কবিতায় বলিষ্ঠ ভাবচেতনা ভাস্করের কারুকার্যে সুগঠিত। হয়ত অনেক সময় ভাবাবেগের প্রাবল্য আছে, কিন্তু তা দৃঢ়তায় পূর্ণ, কবিতার আঙ্গিকের সঙ্গে সামঞ্জস্যময়। খেয়ালী কল্পনা ও লঘু ভাবনার অবসর সেখানে নেই। মননের দীপ্ত বিলাসে, আত্মকেন্দ্রিক আভিজাত্যে এবং ব্যক্তিচেতনার সজাগ অভিমানে কবি মোহিতলাল রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যে যেন এক নিঃসঙ্গ দৃষ্টান্ত।