মুকুন্দরামের রসিকতা যে জীবনের লঘু ও গম্ভীর সর্বক্ষেত্রেই সমভাবে স্বতঃস্ফূর্ত ও উহার বিকাশ যে কেবলহাসির উপলক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তাহা তাঁহার চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আলোচনার দ্বারা প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করো।

বাস্তব রসের কবি হিসাবে মুকুন্দরামের কৃতিত্ব

‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রচলিত আখ্যায়িকা এবং চণ্ডীদেবীর চরিত্র পরিকল্পনার মধ্যেই জীবনবোধ এবং বস্তুনিষ্ঠার যেথষ্ট পরিচয় মিলে। মুকুন্দরামের কৃতিত্ব এই যে, তিনি রসিক শিল্পীর সামঞ্জস্যবোধ ও সূক্ষ্ম রসবোধ লইয়া, কোথাও বা নিজের কল্পনা জুড়িয়া দিয়া উহার মধ্যে বাস্তবরসের সঞ্চার করিতে সক্ষম হইয়াছেন।— আলোচনা করো।


মধ যুগের সমাজব্যবস্থা এবং জীবনবোধ এমনই ছিল যে, তাতে কোনো কবির নিকট হতে আধুনিককালের বাস্তববোধ আশা করা যায় না। তথাপি মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আখ্যানাংশে এবং চরিত্রাঙ্কনে এমন কতকগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয় যে, তাতে মুকুন্দরামকে বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতাবোধের অগ্রদূত বলা যেতে পারে। অবশ্য মঙ্গলচণ্ডী দেবীর পরিকল্পনার মধ্যেই আমরা বাস্তবতার ইঙ্গিত পাই।


মুসলমান রাজশক্তির অত্যাচারে জর্জরিত নিরুপায় বাঙ্গালী যখন কোনো দেবতার নিকট থেকে প্রতিকার পায় নি তখন একেবারে আপন ঘরের মাতারূপে এই দেবীর আবির্ভাব ঘটে। ঘরের মাতা যেমন সন্তানের ন্যায় অন্যায় বিচার না করেই তার আব্দার রক্ষা করেন এই দেবীও ভক্তের জন্য সব কিছু করতে পারেন। এই যে, সমাজের পটভূমিকায় যথাযোগ্য দেবীর চরিত্র পরিকল্পনা এর মধ্যেই বস্তুনিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায়।


মুকুন্দরাম তাঁর বাস্তবতাবোধ, সূক্ষ্ম দর্শনশক্তি, অভিজ্ঞতা, সহানুভূতি ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গীর সাহায্যে এই দেবীর মঙ্গলগীত রচনা করতে গিয়ে বাস্তবতার যথেষ্ট পরিচয় দিয়েছেন। মুকুন্দরামের কাব্যের আখ্যানাংশ ও চরিত্র সৃষ্টি এই উভয়ের মধ্যেই কবির বাস্তববোধের পরিচয় পাওয়া যাবে। তাঁর পর্যবেক্ষণশক্তি অত্যন্ত প্রবল ছিল বলে তিনি জীবনের লঘু ও গুরু সর্বক্ষেত্রেই রসের সন্ধান পেয়েছেন। কাব্যের আত্মপরিচয় অংশে ব্যক্তিগত দুঃখের বর্ণনায় তিনি যেমন ক্রোধ প্রকাশ করেননি, তেমনি ফুল্লরার বারমাসিয়া দুঃখের বর্ণনায় তিনি অশ্রু-বিগলিত হইয়া পড়েননি। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আখ্যানভাগের কয়েকটি ঘটনা এবং কয়েকটি চরিত্র বিশ্লেষণ করলেই এই জীবনরসিক কবির বাস্তবতা তথা জীবনরসবোধের পরিচয় পাওয়া যাবে।


কবি তাঁহার আত্মপরিচয় অংশে তৎকালীন সমাজ জীবনের এক সুন্দরচিত্র অঙ্কন করেছেন। কবিরা সিলিমাণজ (সেলিমাবাদ) শহরবাসী গোপীনাথ নিয়োগীর তালুকে দামিন্যায় ছয় সাত পুরুষ ধরে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যেই বাস করেছিলেন। কিন্তু কবি রাষ্ট্রসঙ্কটে পড়ে দেশত্যাগ করিতে বাধ্য হন। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে পাঠান শক্তির পতন ও মোগল শক্তির অভ্যুত্থান- এর সন্ধিকালে দেশে যে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও নৈরাশ্য দেখা গিয়েছিল কবি তার ঘূর্ণাবর্তে পড় দেশত্যাগী হলেন। ঐ সময় মামুদ সরীপ নামে এক ব্যক্তি ডিহিদার ছিলেন তাঁর নায়েব ছিলেন রায়জাদা। ঐ ব্যক্তি অত্যন্ত অত্যাচারী ছিল। তার কাছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্য, বৈষুব কাহারও নিস্তার ছিল না। অত্যাচার ও অবিচারে প্রজারা ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ে, কোণাকুণি হিসাবে জমির দৈর্ঘ্য মাপা হইতে লাগিল, উর্বর জমি হিসাবে পতিত জমির উপর খাজনা চাপান হল, টাকা ভাঙ্গাতে গেলে পোদ্দারকে টাকা পিছু আড়াই আনা বাটা দিতে হয়, ধার করে টাকা পিছু প্রত্যহ একপাই করে সুদ লাগে। মজুরী দিলেও কাজ করবার লোক পাওয়া যায় না। অস্থাবর সম্পত্তি, ধান, গরু ইত্যাদি কেহই ক্রয় করে না। দেশ ছেড়ে পলাইয়া কেউ যে আত্মরক্ষা করবে তারও উপায় নি। কারণ পেয়াদারা প্রজাদের উপর কড়া দৃষ্টি রাখতে। ব্যাকুল প্রজা টাকার দ্রব্য দশ আনায় বিক্রয় করে কোনমতে দিন কাটাতে লাগল। বিপদের উপর বিপদ, কবির মুরুব্বী—

প্রভু গোপীনাথ নন্দী     বিপাকে হইলা বন্দী

হেতু কিছু নাহি পরিত্রাণে ৷৷


শেষ পর্যন্ত কবি চণ্ডীবাটী গ্রামের শ্রীমন্তর খাঁ এবং মুনির খাঁর সহায়তায় স্ত্রী শিশুপুত্র ও ভাই রমানাথকে লইয়া দেশত্যাগ করলেন। পথে ঠকের দল কবির যা-কিছু সম্বল ছিল হাতড়ে নিল। তখন যদু কুণ্ডু নামে এক ব্যক্তি কবিকে “দিবস তিনের দিল ভিক্ষা।”


অতঃপর কবি গোড়াই নদী পার হইয়া তেউট্যা গ্রামে উপস্থিত হলেন। সেখান হতে দারুকেশ্বর নদী পার হয়ে গেলেন মামার বাড়ী। মাতুল পুত্র গঙ্গাদাস কিছুদিন যত্ন করে তাদের রাখলেন। তার পর দামোদর পার হয়ে কবি উপস্থিত হলেন কুচট্যা নগরে। সেখানে,—

তৈল বিনা কৈল স্নান    করিলু উদক পান

শিশু কাঁদে ওদনের তরে।।


পুকুরের পাশে শালুকের নৈবেদ্য ও ফুল দিয়া কবি পূজা করিলেন। এবং,—

ক্ষুধা-ভয়-পরিশ্রমে    নিদ্রা যাই সেই ধামে

চণ্ডী দেখা দিলেন স্বপনে।


দেবী কবিকে,—

দেবী চণ্ডী মহামায়া    দিলেন চরণ ছায়া

আজ্ঞা দিলেন রচিতে সঙ্গীত।


কবি অতঃপর শিলাই নদী পার হয়ে আড়রা গ্রামের ভূস্বামী বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয় লাভ করলেন। কবির কবিত্ব শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে বাঁকুড়া রায় কবিকে পুত্র রঘুনাথের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করলেন।


এই অংশে কবির ব্যক্তিগত দুঃখ তাঁর বস্তুনিষ্ঠা তথা বাস্তবতা-বোধকে অতিক্রম করতে পারে নি। তেমনি ব্যাধঞ্জীবনযাত্রা, অরণ্যের পশুদের দুঃখের কাহিনী, নগর পত্তন, নগরে আগমনকারী বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের পরিচয় প্রভৃতি বর্ণনা প্রসঙ্গে মুকুন্দরামের বাস্তবতাবোধ সদা জাগ্রত ছিল।


চরিত্র সৃষ্টির মধ্যে মুকুন্দরামের বাস্তবজ্ঞানের পরিচয় আরও স্পষ্ট। তিনি একদিকে দেব দেবীর চরিত্রগুলিকে যথাসম্ভব মানবধর্মের দ্বারা জীবন্ত করেছেন অন্যদিকে মানব চরিত্রাঙ্কনে যে সহানুভূতি, বাস্তবজ্ঞান ও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় দিয়াছেন তা এককথায় মধ্যযুগের সাহিত্যে তুলনারহিত। মুরারি শীলের বণিকসুলভ শাঠ্য, ভাঁড়ু দত্তের দুঃসহ ভণ্ডামি কবি পরিহাসপ্রিয়তার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন।


কবির অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি একদিকে যেমন তৎকালীন বঙ্গসমাজের সার্থক চিত্র অঙ্কন করতে তাঁকে প্রেরণা দিয়াছে, তেমনি তাঁর সহানুভূতি ও স্বচ্ছ মনোভাব সার্থক চরিত্র রূপায়ণে সক্রিয় হয়েছে। ফলে আমরা লক্ষ্য করি যে, মঙ্গলকাব্যের অপ্রাকৃত পটভূমিকায় মুকুন্দরাম এক বাস্তব জগতের ছবি এঁকেছেন। তবে একথা ঠিক যে, মুকুন্দরামে কাব্যে বস্তুনিষ্ঠার পরিচয় থাকলেও তিনি বস্তুতান্ত্রিক কবি ছিলেন না। 'আসলে তাঁহার কৃতিত্ব কেবল বড়ু সঞ্চয়ে নহে, বাস্তব রসের পরিবেশন নৈপুণ্যে। বস্তুপুঞ্জ থেকে বাস্তব রস নিষ্কাশন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিল্পবোধ সাপেক্ষ। মনে রাখিতে হইবে যে, ‘বস্তুর কারবারী ও বাস্তব রসের স্রষ্টা এক নহে।


মুকুন্দরামের কৃতিত্বের প্রধান কারণ এই যে, তিনি কাব্যে বাস্তব তথ্যের সহিত জীবনরসের কল্পনার জগতের সহিত জীবন সত্যের এক অপূর্ব সমীকরণ ঘটিয়েছেন। তিনি যদি পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তু স্তূফীকৃত করতেন তবে তাঁকে বস্তুর কারবারী বলতাম কিন্তু মুকুন্দরাম ঐ বস্তুপুঞ্জ হইতে অপ্রয়োজনীয় অংশ ছাঁটাই করে প্রকৃত জীবনরসের সন্ধান করেছেন। অতিপল্লবিত অহেতুক বিস্তারের স্থলে অর্থঘন সংক্ষিপ্তি, অনিয়ন্ত্রিত ভাবাবেগের স্থলে মিতভাষিতা, নির্বিচার প্রথানুবর্তনের স্থলে বাস্তব স্বীকৃতির প্রখর মৌলিকতা এবং জীবনবাদসম্ভূত রসিকতা—এই সমস্তই তাঁর রচনারীতির বৈশিষ্ট্য। মুকুন্দরাম মূলতঃ আদর্শবাদী রোমান্টিক কবি। কিন্তু তাঁর কাব্যের উপাদানগুলি তদানীন্তন সমাজ থেকে গৃহীত বলে তাঁর কাব্যে বর্ণিত ঘটনা, দৃশ্য বা চরিত্রকে অত্যন্ত বাস্তব বলে বোধ হয়।