"কাব্য নির্মাণের কৌশলের তিনভাগ—বিভাগ, অনুভাব ও সঞ্চারী…” | কবি যে কাব্যের মায়াজগৎ সৃষ্টি করেন তার কৌশলটি কী?

কবি যে কাব্যের জগৎ সৃষ্টি করেন তা মায়ার জগৎ বলেই মনে হয়। এই মায়ার জগৎ কীভাবে সৃষ্টি হল তা জানতে বড়ো কৌতুহল জাগে পাঠকের মনে। কাব্যে যে মায়ার জগৎ সৃষ্টি হয় তা মূলত অলৌকিক জগৎ, লোকে অর্থাৎ দৈনন্দিন বস্তু জগতে যা দেখা যায় না তা হল অলৌকিক, এটা সর্বজনস্বীকৃতি লৌকিক বা ব্যবহারিক জগতে মানুষ শোক পায়, হর্ষ উপলব্ধি করে, এই হর্ষ ও শোক লৌকিক কারণে হয় বলেই মানুষের মনে লৌকিক ভাবের জন্ম দেয়, সে ভাবগুলি দুঃখ ও সুখ রূপেই অভিহিত। কিন্তু এই লৌকিক ভাব কাব্যের জগতে এক অলৌকিক রূপ লাভ করে, পাঠকের মনে যে লৌকিক ভাব আছে তা অলৌকিক রূপে ‘রসে’ পরিণত হয়। রসের মানসিক উপাদান যত দুঃখময় হোক না কেন তা নিত্য আনন্দময় রূপে পরিগণিত হয়। তাই লৌকিক দুঃখের অলৌকিক পরিণতির আনন্দময়ত্ব মায়া বলে মনে হয়। এই মায়া বাস্তব জগতের দৈনন্দিন জীবনে ঘটে না, ঘটে কবিসৃষ্ট কাব্যের জগতে।


বিভাব : আলংকারিকরা কাব্য নির্মাণের কৌশলরূপে তিনটি ভাগের উল্লেখ করেছেন—বিভাব, অনুভব, সঞ্চারীভাব। এদের মধ্যে বিভাব মূলত দুই প্রকারের—আলম্বন বিভাব ও উদ্দীপন বিভাব। মূলত লৌকিক জগতে যা রতি প্রভৃতি ভাবের উদ্বোধক, কাব্যে বা নাট্যে তাকেই বিভাব বলে, লৌকিক জগতে যে সীতা ও তার রূপ গুণ দিয়ে রামের মনে রতি হর্ষ প্রভৃতি উদ্‌বোধের কারণ হয়, তা যখন কাব্যে বা নাট্যে রূপায়িত হয় তখন তাকে বিভাব বলে, কারণ তারা পাঠক বা দর্শকের মনে আস্বাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এই বিভাব সম্পর্কে বিশ্বনাথ কবিরাজ লিখলেন—যেসব বস্তু বা পারিকার্য স্বার্থ অবস্থা রসসৃষ্টির আনুকূল্য করে তাকে বলা হয় উদ্দীপনা বিভাব অর্থাৎ উদ্দীপনা বিভাব রসকে উদ্দীপিত করে। এবং আলম্বন বিভাব হল— শকুন্তলা নাটকে যেমন দুষ্মন্ত, শকুন্তলা আলম্বন বিভাব। কিন্তু মালিনীর নদীর তীর, বেতস কুঞ্জ, শকুন্তলার অসামান্য রূপ প্রভৃতি উদ্দীপন বিভাব।


অনুভাব : মনের ভাব উদ্বুদ্ধ হলে যে সকল অস্বাভাবিক বিকার বা উপায়ে তা বাইরে প্রকাশিত হয় (ভাবরূপ) সেইসব লৌকিক কার্য কাব্য বা নাট্যের অনুভাব, অর্থাৎ কারণের পশ্চাতে যাদের উৎপত্তি তাদের বলা হয় অনুভাব। বিভাব সমূহের অন্তর্গত ভাবকে যারা অনুভব যোগ্য করায় তারা অনুভাব। এ সম্পর্কে অতুল চন্দ্র গুপ্ত উদাহরণ দিলেন—

“দ্বিধায় জড়িত পদে কম্প্র বক্ষে নম্র নেত্র পাতে।

স্মিত হাস্যে নাহিচল সলজ্জিত বাসর স্তব্ধ সজ্জাতে অর্থরাত্রে।"


রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই উর্বশী কবিতায়—উর্বশীর সঙ্গে নববধূর প্রাসঙ্গিক তুলনা করেছেন উদ্বুদ্ধ রতিভাবা নববধূর যে সব স্বাভাবিক বিকার ও উপায়ের রতিভাবের প্রকাশ হল ভাব রূপ কারণের সেগুলি লৌকিক কাব্য, মিলন মধুর লজ্জার নববধূর উদ্ভূত লৌকিক কার্য হল—দ্বিধা, চরণে জড়িমা, বক্ষের কম্প্রতা, নেত্রপাতের নম্রতা, স্মিতহাস্য এগুলি সমস্তই অনুভাব।


সঞ্চারী ভাব : সঞ্চারীর সাদৃশ্যে ব্যভিচারী শব্দের উৎপত্তি, স্থায়ী ভাবের অভিমুখে সঞ্চরণ করে ভাবের গতিকে সঞ্চারিত করে বলে এর নাম সঞ্চারী। নির্বেদ, গ্লানি, শংকা, অনুসূয়া, মদ, শ্রম, আলস্য, দৈন্য প্রভৃতি তেত্রিশ প্রকার সঞ্চারী ভাব। সঞ্চারী দিয়ে রসের পরিপুষ্ট লাভ ঘটে। এই সঞ্চারী ভাবে কার্যপ্রণালী সম্পর্কে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত মহাশয় লিখলেন—“যদিও ব্যভিচারী ভাবগুলি স্থায়ী ভাবের সহিত সর্বদা যুক্ত থাকে না, তথাপি সুপক্ক ব্যঞ্জনাদিতে যেমন একই মূল আস্বাদ থাকে ও অন্যান্য প্রকারের আস্বাদ তাহার জড়িত হইয়া থাকে, তেমনি স্থায়ী রূপে যে মূল রসই থাকুক, তাহার সহিত ব্যভিচার যুক্ত হইয়া তাহাকে নানা অস্বাদে সাবলীল করিয়া তোলে।”


তাই কবি তাঁর অপূর্ব বস্তু নির্মাণ ক্ষমা প্রতিভার যাদুমন্ত্রে কাব্যের যে মায়াজগৎ সৃষ্টি করেন তা প্রাত্যহিক জীবন থেকে স্বতন্ত্র। যদিও এই অপরূপ মায়াজগতের সৃষ্টির যাবতীয় উপাদান আসে আমাদের দৈনন্দিন সাংসারিক জীবন থেকে। কাব্য শিল্পের এমন অসাধারণ মহিমা যে কাব্য রূপ লৌকিক রূপকে সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করে যায়। এখন প্রশ্ন হল—কবি যে কাব্যের মায়াজগৎ সৃষ্টি করেন তার কৌশল কী ? তবে এর মধ্যে নিখিল কবি প্রতিভার নিঃশ্বেষ পরিচয় জিজ্ঞাসা লুকিয়ে আছে। প্রতি কবির প্রত্যেক কাব্যের নির্মাণ কৌশল অন্য সকল কাব্য থেকে অল্পবিস্তর স্বতন্ত্র হলেও কাব্য কৌশলের পরিচয় দিতে গেলে বলতে হয়, দেহের রূপ ভেদ থাকলেও কঙ্কালের রূপ যেমন প্রায় এক, কাব্যে রূপ ভেদ যাই থাকুক না কেন সকল কাব্য সাধারণ কাব্য কৌশল তেমনি এক। অর্থাৎ মূল বিষয় হল কাব্য কৌশলের তিনভাগ—বিভাব, অনুভাব, সঞ্চারীভাব।


সর্বোপরি, এই তিন ভাগের স্বরূপ নির্বাচন করতে রবীঠাকুরের বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি ছত্র উদ্ধৃত করে বিশ্লেষণ করা যায়—

সুদূর গগনে কাহারে যে চায়?

ঘাট ছেড়ে ঘট কোথায় ভেসে যায়? 

নব মালতীর কচি দল গুলি

সাস মনে কাটে দশনে। (ক্ষণিক)


অর্থাৎ ‘কোনো এক নববর্ষার দিন, বিরহিণী বধূ ঘাটে গেছে ঘট ভরে জল আনতে, দূর আকাশে নবীন মেঘের সঞ্চার, মনে পড়েছে প্রবাসী প্রিয়তমের কথা। মন হয়ে উঠলো আনমনা, পবন স্পর্শে তরঙ্গ হিল্লোলে ঘাট থেকে ঘট কোথায় ভেসে গেল বধূটি জানতেই পারলো না। জ্বলে নামার সিঁড়ির ধারে নব প্রস্ফুটিত মালতী ফুলের কচি পাতাগুলি সে দাঁতে কাটতে থাকলো। এখানে স্থায়ীভাব রতি। আলম্বন বিভাব বিরহিণীর বধূ, উদ্দীপন বিভাব নববর্ষ ও আকাশের মেঘ, অনুভাব অন্যমনস্কতা, সঞ্চারীভাব হল উৎকণ্ঠা। কাজেই এগুলি কাব্যজগতে অলৌকিক হয়েও লৌকিক।