ভক্তের আকৃতি কী? এই পর্যায়ের পদ অবলম্বনে কবিদের মনস্তত্ত্বের স্বরূপ নির্ণয় করো।

আকুতি শব্দের আভিধানিক অর্থ অভিলাষ বা অভিপ্রায়। 'ভক্তের আকুতি'-র অর্থ তাহলে দাঁড়ায় আধ্যাত্মিক জগতের প্রতি ভক্তের আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা। শাক্তসাধক কেউ রাজা, কেউ মাতা, কেউ ভক্ত, কেউ প্রেমিক। কিন্তু জগতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কেউ বদ্ধ, কেউ মুক্ত, কেউ বিমর্ষ। এদের প্রত্যেকের আর্তিও বিভিন্ন ধরনের। এদের প্রার্থনার মধ্যে একটা সারবস্তু লক্ষ্য করা যায়, যার বিষয়বস্তু একই। প্রত্যেকের কামনা ও আকৃতি মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল। 'ভক্তের আকৃতি' পর্যায়ের পদে দৈনন্দিন জীবনের গ্লানিতে পরিপূর্ণ চিত্র অঙ্কিত। সেই গ্লানিময় জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার কামনায় ভক্ত চান জগজ্জননীর স্নেহছায়া। শাক্তকবিরা মুক্তির জন্য লালায়িত হননি, মাতৃকৃপালাভে, মাতৃচরণে আশ্রয় পাওয়ার জন্য তারা লালায়িত। সেই কারণেই মাতৃস্নেহভিলাষী সস্তানের কাছে সংসারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অতি তুচ্ছ বিষয়। অতএব 'ভক্তের আকৃতি' পর্যায়ের পদে মোহমুক্তির সুর আভাসিত।


'ভক্তের আকৃতি' পর্যায়ের পদগুলি যে কারণে পাঠকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় তা হল– পদগুলিতে দুঃখবেদনাহত মানবজীবনের বিচিত্র মর্মস্পর্শী আলেখ্য চিত্রিত হয়েছে। মানুষ যেন দুঃখের ডিক্রি জারির আসামী। মানবজীবনের এই মর্মান্তিক দুঃখবেদনা জানানোর প্রকাশ হিসাবে মাতৃরূপের বর্ণনা উক্ত পদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অবশ্য লক্ষণীয় বিষয় হল, এই জাতীয় পদে মাতৃরূপের তন্ত্র সম্মত বর্ণনা অনুপস্থিত। মা কখনো করুণাময়ী আবার কখনো রণমূর্তিধারিণী। এই পর্যায়ে পদখানি বিশেষভাবে পাঠ করলে বোঝা যায়, পদকর্তাগণের মূল লক্ষ মাতৃস্নেহ লাভ। মাতৃস্নেহ প্রাপ্তির চিরন্তন আকৃতি এই জাতীয় পদের কেন্দ্রিয় মূলকথা। স্নেহময়ী মাতৃরূপে দেবীকে চিত্রিত করে শাক্তপদকর্তাগণ নিজেদের দুঃখবেদনা যন্ত্রণার কথা জানিয়েছেন আবার মা যখন সন্তানের দুঃখে বিচলিত নন তখন অভিমানবশত সস্তান তাঁকে পাষাণী, স্নেহহীনা নামে সম্বোধন করতে দ্বিধাবোধ করেননি। প্রকৃতপক্ষে উদ্দেশ্য একটাই মায়ের প্রতি অভিমান প্রকাশ করে স্নেহলাভের আকৃতি।


অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রামপ্রসাদ সেনের শিল্প-সৌন্দর্যমণ্ডিত অতুলনীয় সুরের পরশে শাক্ত পদাবলির যাত্রা। রামপ্রসাদ বৈশ্বব সাধোকচিত নিষ্কাম মনোবৃত্তি নিজে জগজ্জননীকে সমস্ত প্রকার স্বার্থবুদ্ধি ও সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে স্থাপন করে জননীকে বিশ্বজননীরূপে স্থাপন করেছেন। সন্তানের আকৃতির কাব্যরূপে শাক্তপদাবলি নৃতনত্বের মর্যাদা পেল। তাঁর মূল অভিযোগ হল যার জননী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পালনকর্তী তার এত দুঃখভোগ কেন। তাই কবির অভিযোগ–

“মাগো তারা, ও শঙ্করি,

কোন অবিচারে আমার 'পরে, করলে দুঃখের ডিক্রী জারি ? 

এস আসামী ছয়দা প্যাদা বল্‌মা কিসে সাফাই করি।

আমার ইচ্ছা করে ওই ছয়টারে বিষ খাওয়াইয়ে প্রাণে মারি।”


অসাধারণ কবিপ্রতিভার বলে কবি রামপ্রসাদ – ‘ভূতজন্মের ব্যর্থতা, আসক্তির আশা ভঙ্গ এবং ইচ্ছা ও অসংগতিজনিত আত্মবিদ্রূপ'কে' রূপায়িত করেছেন শাক্তপদাবলিতে। ‘আসার আশা ভবে আসা' পদটিতে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে কবির মনস্তত্ত্বটির প্রকাশ পাওয়া যায়।

দীর্ঘকাল সংসার যাত্রার পর কবি তাঁর ভুল উপলব্ধি করে আকুল প্রার্থনাই জগজ্জননীর কাছে প্রার্থনা করেছেন। জননী যেন তাঁকে তাঁর উপযুক্ত স্থানে নিয়ে যান –

“ভবের খেলায়, যা হবার তাই হল।

এখন সন্ধ্যাবেলায়, কোলের ছেলে, ঘরে নিয়ে চলো।”


রামপ্রসাদের কবিতায় জননীর প্রতি অভিমান আসলে সংসার আসক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। জগজ্জননী কবিকে সংসারী করলেও অর্থ প্রদান করেননি। তাই অভিমান প্রকাশ করেছেন কবি–

“আমি তাই অভিমান করি

আমায় করেছ গো মা সংসারী 

অর্থ বিনা ব্যর্থ যে এই সংসারে সবারি।"


'ভক্তের আকৃতি' পর্যায়ে ভবজীবন থেকে মুক্তির বাসনা অপেক্ষা পার্থিব জগতে সুখে থাকার বাসনা কবির কণ্ঠে প্রবল আকারে প্রস্ফুটিত–

“আমি ওই খেদে খেদ করি

ওই যে মা থাকিতে আমার ভাঙা ঘরে হয় চুরি।”

উক্ত পদটিতে ক্ষোভের ভাব প্রকাশিত।


দুঃখদৈন্য অভাব দুর্দশাগ্রস্ত সংসারের কর্মভোগকে রামপ্রসাদ মাতার অবিচার বলে মনে করেছেন। কোনো কোনো পদে আবার জগজ্জননীর প্রতি আন্তরিক অভিমান গ্রামীণ জীবনের পরিচিত উপমার সাহায্যে প্রকাশ করেছে –

মা আমায় ঘুরাবে কত, কলুর চোখ বাঁধা বলদের মতো ?”


তৈলনিষ্কাষণ যন্ত্রের চতুর্দিকে অন্ধ বলদের রাত্রিদিন ঘূর্ণায়মানতার দ্বারা প্রাণ ধারণের গ্লানি চমৎকার ভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। সংসার যাত্রার কর্মচক্রে নিষ্পেষিত মানুষ পারিবারিক কর্তব্য রক্ষায় কঠিন অনুশাসনে ক্রমশই নিরুদ্বিগ্ন ভক্তির শান্তিপূর্ণ আকাশ থেকে স্খলিত হয়ে ধরাতলে পতিত হয়েছে। দুঃখার্ত জীবনের পিছনে কোনো মঙ্গলময়ী চৈতন্যশক্তি আছে কিনা বাস্তব জীবনধারণের প্রতি সংশয় কবির মনে বারবার উত্থিত হয়েছে। এই সংশয় থেকেই তার অস্তিত্বের প্রতি অবিশ্বাস আসে। তবে পরমুহূর্তে অবিশ্বাস বিশ্বাসে পরিণত হয়। তিনি বিশ্বাস করেন মাতৃচরণে আশ্রয় পেলে মুক্তির রসাস্বাদনে বিফল নেই–

“তবু রব মায়ের চরণে, আর তো ভবে জন্মিব না।”


আবার কোনো কোনো পদে কবি মাতার কাছে প্রগাঢ় মাতৃবাৎসল্যের প্রাপ্য অধিকার দাবী করেছেন –

আমায় কি ধন দিবি, তোর কি ধন আছে।”


আবার মাতৃচরণে আশ্রয় পাবার জন্য এবং সমস্ত বিপদ থেকে পারাপার হবার জন্য মাতার প্রতি তাঁর উক্তি –

“ও পদের মতো পদ না পাইতো, সে পদ লয়ে বিপদ সারি।”


অতএব রামপ্রসাদের 'ভক্তের আকৃতি' পর্যায়ে মানবিক অনুভূতির দ্বারা মাতৃচরণে আশ্রয়, বাৎসল্য রসাস্বাদন, অভিযোগ মান-অভিমান এমন সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন তা তাঁর মনস্তাত্ত্বিক সম্মত রূপটি প্রস্ফুটিত হয়েছে। সেজন্য রামপ্রসাদের মতো ভক্তশ্রেষ্ঠ চরম প্রত্যাশার প্রাপ্ত ভাবে এসে জিজ্ঞাসা করেছেন স্নেহময়ীকে–

“এমন দিন কী হবে তারা, 

যবে তারা তারা বলে, তারা বেয়ে পড়বে ধারা।” 


সত্যিই এমন আবেগ মিশ্রিত ডাক অন্য কোনো কবির মধ্যে পাওয়া যায় না।