চণ্ডীমঙ্গলের কবি : দ্বিজমাধব | চণ্ডীমঙ্গলে দ্বিজমাধব

চণ্ডীমঙ্গলে দ্বিজমাধব


ষোড়শ শতকে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রাচীনতর রূপকার দ্বিজমাধব বা মাধবাচার্য। ‘সারদা-চরিত’, ‘সারদা-মঙ্গল’ জাগরণ বা ‘মঙ্গলচণ্ডীর গীত’ (সুধীভূষণ ভট্টাচার্য সম্পাদিত, ক. বি.) ইত্যাদি একাধিক নামে তাঁর কাব্যটি সুপরিচিত। পুঁথিগুলির প্রাপ্তিস্থান যথাক্রমে চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, ত্রিপুরা এবং উত্তরবঙ্গ। অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার, পুঁথিতে উক্ত কবির জন্মস্থান-সপ্তগ্রাম ও ত্রিবেণী নদীর সন্নিহিত স্থান। অন্যদিকে আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেনঃ “কথিত আছে, মাধবাচার্য ময়মনসিংহ জেলার দক্ষিণে মেঘনা নদীর তীরস্থ নবীনপুর (ন্যানপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এইস্থান এখন গোঁসাইপুর বলিয়া পরিচিত” ( ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, পৃষ্ঠা ৪২৫)। কিন্তু (গ্রন্থমধ্যে) পূর্ববঙ্গের তেমন কোন ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণ বিরলদৃষ্ট। এই দ্বিজমাধব বা মাধবাচার্যের নামে রচিত 'শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল কাব্য বৈষ্ণবসমাজে জনপ্রিয় হয়েছিল। এই মাধবাচার্য অভ্রান্তভাবে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী, তাঁর বংশধরদের পরিচয়ও পাওয়া যায় (দ্রষ্টব্যঃ ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস', ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য)। কিন্তু এই একই কবি চণ্ডীমঙ্গল আর শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল-রচয়িতা কিনা তা বলা দুষ্কর। 'সারদা চরিত’ পড়ে জানা যায়, কবি ছিলেন ব্রাহ্মণ, পিতার নাম পরাশর। কাব্যরচনার আনুমানিক কাল ১৫৭৯ খ্রীস্টাব্দ। তার কাব্যে ‘আকবরে’র উল্লেখও বর্তমান।


দ্বিজমাধবের নাম ও কাব্য-পরিচয় সম্পর্কে সংশয় আছে। তবে তার কবিত্ব শক্তি পরীক্ষায় সমালোচকেরা বিব্রত হন নি। এখানে যেমন প্রকাশ পেয়েছে কবির পুরাণজ্ঞান, তেমনি তন্ত্র-যোগসাধন-ধর্মবন্দনা ও বিষ্ণুপদ রচনায় এবং সমাজচিত্র বর্ণনায় বিষয় বৈচিত্র্য দেখা যায়; যেমন ‘নদীতীরে খুল্লনার খেদ’

“দুই আঁখি অনিবার    বহয়ে সে জলাধার 

কুত্তল আউলাইয়া পড়ে পৃষ্ঠে।

অনিমিখ হইয়া আঁখি    নায়রা নিরখে সখী 

দাণ্ডাইয়া ভ্রমরার তটে ।”


অথবা কালকেতুর সঙ্গে কলিঙ্গরাজার যুদ্ধ-বর্ণনা

“যুঝে প্রচণ্ড ভাইয়া, কোপে প্রজ্জ্বলিত হৈয়া, মার কাট সঘনে ফুকারে। 

জনার্দ্দনের যত সেনা, শব্দেতে কম্পমানা, নানা অস্ত্র বরিষণ করে । 

পদাতি পদাতি রণে, অস্ত্র মারে ঘন ঘনে, কুঞ্জরে কুঞ্জরে চাপাচাপি। 

অস্ত্রবাছনি করি, তুরগ উপরে চড়ি, বাহুতে বাহুতে কোপাকুপি ।।”


প্রখর বস্তুনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণ-নৈপুণ্য দ্বিজমাধবের কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি অতি আনুগত্যে বাস্তবের অবিকল অনুলিপি পাঠককে সচকিত করে, কিন্তু নন্দিত করে না; যেমন

“দুলি পেলি খেলী এয়ো আইল ব্যাধ ঘরে। 

মৃগচর্ম্ম পরিধান, দুর্গন্ধ শরীরে ॥”


ব্যাধ-জীবনের প্রেক্ষিতে এ চিত্র কেবল বাস্তব নয়, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘অরুগ্ন বলিষ্ঠ হিংস্র নগ্ন বর্বরতা'য় আঁকা। অনুরূপভাবে, কলিঙ্গরাজের কাছে ফুল্লরার আত্মসমর্পণের উপদেশে ক্রোধাক্ত কালকেতুর বর্ণনাও জীবনসঙ্গত, যেমন

“শুনিয়া সে বীরবর    ক্রোধে কাঁপে থরথর

শুন রামা আমার উত্তর।

করে লৈয়া শর গাণ্ডী    পূজিব মঙ্গলচণ্ডী,

বলি দিব কলিঙ্গ ঈশ্বর ।।

যতেক দেখহ অশ্ব    সকলি করিব ভস্ম,

কুঞ্জর করিব লণ্ডভণ্ড।

বলি দিব কলিঙ্গ রায়     তুষিব চণ্ডিকা মায়

আপনি ধরিব ছত্রদণ্ড ॥ ”


বস্তুত, ব্যাধ-জীবনের প্রধান রিপু ক্রোধ ও হিংসার সুনিপুণ রূপায়ণে দ্বিজমাধব সার্থক। তবু মনে হয়, তার কাব্যে চরিত্র রূপ যতটা জৈবিক, ততটা শৈল্পিক নয়। তাঁর বর্ণনা যতটা প্রত্যক্ষ ততটা কল্পনায় বা জীবনরসে সমৃদ্ধ নয়। তাই তার চিত্রিত ভাড়ু দত্ত যতটা ভাড়ামি করে ততটা ভাবায় না; যেমন

“স্ত্রীর বচনে ভাড়ু ভাবে মনে মন।

আজুকার অন্ন আমার মিলিব কেমন ।।

ভাঙ্গা কড়ি ছয় বুড়ি গামছা বান্ধিয়া।

ছাওয়ালের মাথায় বোঝা দিলেক তুলিয়া ।। 

কড়ি বড়ি নাই ভাড়ুর বাক্য মাত্র সার।

ত্বরায় পাইল গিয়া নগর বাজার ।।”


দ্বিজমাধবের কাব্যের ভাষা সহজ, সাবলীল ও মাটির গন্ধে ভরপুর। কিন্তু মাটিতে দাঁড়িয়ে কল্পনার আকাশপানে তাকায় না। আর সেই কারণেই তাঁর কাব্য শুধু বস্তুচিত্র হয়ে ওঠে।