অভিজিৎ চরিত্রটির স্বরূপ উদ্ঘাটন করো।

অভিজিৎ মারনেওয়ালা বা মারখানেওয়ালা কোনো দলেরই নয়; সে চিরচঞ্চল এবং চিরগতিশীল মানবাত্মা, জলের প্রবাহের সঙ্গে তার যোগ— “তিনি হয়ত কোনো সূত্রে জানতে পেরেছেন যে তাঁর জন্ম রাজবাড়িতে নয়, তাকে মুক্তধারার ঝর্ণাতলা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া গেছে।” রবীন্দ্রনাথ প্রতীকের দ্বারা বলতে চেয়েছেন, যে মানুষ নিজেকে সকলের জন্য উৎসর্গ করে সে কোনো ঘরের নিয়মে বাঁধা থাকে না। মনের দিক থেকে সে উত্তরকূটের নয়। অত্যাচারীর যে অহংবোধ এবং ক্ষুদ্রতা থাকে অভিজিৎ তাকে দূরে ফেলে দিয়ে ব্যক্তিত্ববোধের বিকাশ ঘটিয়েছে। সে আবার শিবতরাইয়ের অত্যাচারিত প্রজাগোষ্ঠীর ন্যায় শুধুমাত্র আঘাত বরণ করেই ক্ষাস্ত থাকেনি। সে আঘাত যেমন বরণ করেছে তার প্রতিবাদে তেমন মুখর হয়েছে।


তত্ত্বের দিক দিয়ে মানবাত্মার স্বরূপ নির্দেশের ওপর কবি অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করেছেন এখানে। কোনো বন্ধন মানবাত্মাকে আবদ্ধ করতে পারে না, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের মুক্ত স্বরূপকে ফিরে পাওয়া যায়। সে নিজের মুক্তি এবং সমগ্র মানুষের মুক্তি কামনা করে ; অভিজিতের সাধনা, মানুষকে সর্ববন্ধন থেকে মুক্ত করা। অভিজিৎ সম্পর্কে বিশ্বজিতের উক্তি—“মুক্তধারার উৎসের কাছে কোনো ঘর ছাড়া মা ওকে জন্ম দিয়ে গেছে, ওকে ধরে রাখবে কে?” এই অভিজিৎ সম্পর্কে সমালোচক কনক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন— “অভিজিৎ জাতির প্রতিভূ। মুক্তধারা ঝর্ণার সঙ্গে তাঁহার অন্তরাত্মার যোগ। ঝর্ণার গতি তাঁহার স্বধর্ম। তাই বন্ধনের ফেনা তাঁহার মধ্যে অতিশয় প্রবল। তাই রাজসিংহাসন, ঐশ্বর্য কোনো বন্ধনই তাঁহাকে বাঁধিতে পারে নাই। গতির আবেগে ঝর্ণা যেমন অনন্তসন্ধানী, অসীমের পরশ পিয়াসী, অভিজিৎ তেমনই অমৃত সন্ধানী।”


অভিজিৎ গতিশীল মানুষ। সমস্ত দিকের সমস্ত পথ কেটে দেওয়ার জন্যই তার জন্ম। সে জানে যে বন্ধনযুক্ত মানুষ কখনও পূর্ণ হয়ে ওঠে না। অভিজিৎ সকলকে মুক্তির পথ করে দিতে চায়—“আমি পৃথিবীতে এসেছি পথ কাটবার জন্য এই খবর আমার কাছে এসে পৌঁচেছে।” অভিজিৎ জানে গতিই জীবন ; গতিহীনতা মৃত্যু। যখন ঝর্ণা বাঁধা হল তখন তারই সঙ্গে যুক্ত অভিজিৎ নিজের প্রাণের ছন্দকে কারারুদ্ধ বলে মনে করেছে। অভিজিৎ প্রাণকে ভালোবাসে বলেই ঝর্ণার কলধ্বনিকে তার পক্ষে বাঁধা সম্ভবপর নয়; সে কারগার ভাঙতে উদ্যত। রাজবাড়ি তার কাছে রাজতন্ত্রের দস্ত। পথের সন্ধান যে পায় তাকে রাজবাড়ির ভোগের বন্ধন আটকে রাখতে পারে না। “আমার অস্তরের কথা আছে ওই মুক্তধারার মধ্যে। তারই পায়ে ওরা যখন লোহার বেড়ি পরিয়ে দিল তখন হঠাৎ যেন চমক ভেঙে বুঝতে পারলুম উত্তর কূটের সিংহাসনই আমার জীবন স্রোতের বাঁধ। পথে বেরিয়েছি, তারই পথ খুলে দেবার জন্যে।


সমালোচক প্রমথনাথ বিশী তাঁর 'রবীন্দ্র নাট্যপ্রবাহ' গ্রন্থে অভিজিৎ সম্পর্কে জানিয়েছেন— “নাটকের নায়ক অভিজিৎ জন্মযাত্রী। পথের ধারেই তাহার জন্ম আবার পথের ধারেই তাহার মৃত্যু। বাঁধন ভাঙা মুক্তধারার স্রোেত তাহার দেহ ভাসাইয়া লইয়া চালিয়া গেল। মুক্তধারার মধ্যেও যে গতি, পথের মধ্যেও তো সেই গতিই। পথকাটাই যুবরাজের কাজ। নন্দি- সংকটের রুদ্ধপথ সে কাটিয়া দিয়াছে আবার যে সব পথ এখনও কাটা হয় নাই পর্বতশৃঙ্গের দিকে তাকাইয়া ভবিষ্যতের সেইসব অকৃত পথকে সে দেখিতে পায়। অবিরাম গতিতেই জীবনের সার্থকতা— গতিই জীবনের স্বরূপ। সেই গতি যেখানে কোনো কারণে ব্যাহত, জীবনরূপ সেখানে বিকৃত। এই বিকৃতির হাত হইতে মানুষকে রক্ষা করাই অভিজিতের ব্রত।”


অভিজিৎ নন্দিসংকটের যে পথ খুলে দিয়েছে সে পথ অবরুদ্ধ জীবনপথের প্রতীক) যে অন্নে মানুষের ন্যায্য অধিকার, শাসনযন্ত্রের চাপে তা বন্ধ হয়েছিল এবং জীবনের স্বাভাবিক প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। তাই অভিজিৎ অন্ন চলাচলের পথ খুলে দিয়ে তাদের দুর্গতি থেকে মুক্তি দিয়েছে। যান্ত্রিকতার চরম রূপ যে মুক্তধারার বাঁধ, অভিজিৎ প্রাণের বিনিময়ে তাকে ভাঙতে প্রস্তুত। সে ভবিষ্যতে মানুষের সমস্ত বন্ধন শেষ করবে এবং এটাই তার ব্রত। বাঁধ যদি না ভাঙা যায় তবে জীবন অর্থহীন। পৃথিবীতে মনুষ্যত্বের সত্যকার উপলব্ধির জন্য রাজ সিংহাসন তুচ্ছ করে এগিয়ে যেতে হয়। “আমার অন্তরের কথা আছে ওই মুক্তধারার মধ্যে।.... স্বর্গকে ভালো লেগেছে বলেই দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করতে যেতে দ্বিধা করিনে।....এই সূর্যাস্তের আকাশের দিকে চুপ করে চেয়ে আছে, সেই চেয়ে থাকা সুরটি আমার হৃদয়ে এসে বাজছে, সুন্দর এই পৃথিবী। যাকিছু আমার জীবনকে মুধময় করেছে সে সমস্তকেই আমি নমস্কার করি।”


অভিজিৎ মারনেওয়ালাও নয় আমার মারখানেওয়ালাও নয় ; কবি এক বিশেষ উদ্দেশ্যে তাকে রাজটীকা দিয়ে মারনেওয়ালাদের যুবরাজ করে পাঠিয়েছে। যে ভোগ জানেনা তার পক্ষে ত্যাগ মহা গৌরবের নয়। ভোগের মধ্যে থেকেই ভোগের ভোগ লোলুপতাকে জানা যায়। মুক্তমনের অধিকারী অভিজিৎকে তিনি ভোগের রাজ্যেই অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করেছেন। অভিজ্ঞতার দ্বারা মারনেওয়ালার ভয়ংকর রূপ দেখে তার অন্তর পীড়িত হয়ে উঠেছিল—এই অর্থে অভিজিৎ হচ্ছে সেই মারনেওয়ালার ভিতরকার পীড়িত মানুষ। অভিজিৎ প্রাণ বিসর্জন দিয়ে নিজেকে ও অন্যকে যন্ত্রের বজ্রমুষ্টি থেকে মুক্ত করতে চায়। তার মূল্য দেওয়ার জন্যেই অভিজিতের সাধনা কঠিনের সাধনা। সে যন্ত্র ধরণির সৌন্দর্য মাধুর্য হরণ করে জীবনকে করেছে তিন্তু বিরক্ত, অভিজিৎ প্রাণ দিয়ে সে যন্ত্র ভাঙতে উদ্যত। গোধূলির যে নীল আলো, অভিজিৎ তাকে ভালোবাসে। জগৎ ও জীবনের সৌন্দর্য্য ও মাধুর্যের আবেদন তার কাছে অত্যন্ত বেশি বলেই সে অক্লেশে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে পারে। সে জানে যা কঠিন তার গৌরব থাকতে পারে, কিন্তু যা মধুর তারও মূল্য আছে।


সবমিলিয়ে, 'অভিজিৎ প্রেমের মন্ত্রে সঞ্চলকে উজ্জীবিত করতে চায়। যখন চতুর্দিকে অন্ধকার নেমে আসে, সত্যপথ যখন খুঁজে পাওয়া যায় না, তখনই মানুষের বিশ্বাসের পথে জীবনের আলো নেমে আসে। সেই আলোতে মারনেওয়ালা আর মারখানেওয়ালা দুজনেই মহান আদর্শের সন্ধান পায়। অভিজিৎ নিজেকে দান করে উভয়ের মধ্যে সেই আদর্শের দীপশিখাকে প্রোজ্জ্বল করে তোলে।