পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসের সেনদিদি চরিত্র।

চরিত্র চিত্রণ বিষয়টি সাহিত্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কারণ চরিত্রের হাত ধরেই নাট্য কাহিনির পরিণতি ঘটে। শেকস্‌পিয়র তাই বলেছেন— “The character is the destiny, the destiny is character" আসলে চরিত্র না থাকলে কাহিনির অস্তিত্ব ম্লান হয়ে যাবে। এই প্রসঙ্গে আমরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসের সেনদিদি চরিত্রটি আলোচনা করবো।


যামিনী কবিরাজের স্ত্রী সেনদিদি। সেনদিদির আসল নাম ‘সরোজ'। নিঃসন্তান সেনদিদি বকুলতলা ঝাঁট দিতে এসে শ্রীনাথ মুদীর মেয়ের ফেলে যাওয়া পুতুলকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে ঘরে তুলে নিয়ে যায়। শশীকে সে পুত্রের মতো ভালোবাসে। সেনদিদি রূপসী। তার রূপের জৌলুষে চোখ ধাঁধিয়ে যায় সবার। রূপের জন্য গোপালদাস যামিনী কবিরাজের সঙ্গে সেনদিদির বিয়ের দালালি করেছিল। গ্রামের কলঙ্কিনীদের মধ্যে সেনদিদির খ্যাতিই সর্বাধিক। সেনদিদি সম্পর্কে ঔপন্যাসিক বলেছেন—“কিন্তু যামিনী কবিরাজের বউ শশী যাহাকে সেনদিনি বলিয়া ডাকে এবং শশীকে যে অপুত্রবতী রমণী গভীরভাবে স্নেহ করে, স্বামীকে সে এত যত্ন এত সাবধানে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে যে শীঘ্র যামিনী কবিরাজের মরিবার সম্ভাবনা নাই । যামিনী কিন্তু মরিতে চায়।......গ্রামের বউ-ঝিদের কলঙ্ক দিগ্‌দিগন্তে রটিয়া যায়। গ্রামের.....কলঙ্কিনীদের মধ্যে শশীর সেনদিদির প্রসিদ্ধিই বেশি। গোপালের সঙ্গেই তার নামটা জড়ানো হয় বেশি সময়। লোকে নানা কথা বলাবলি করে।” গোপালের সঙ্গে সেনদিদির একটা অবৈধ সম্পর্ক আছে তা উপন্যাসের কাহিনি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়।


গোপালদাসের ব্যাবসাগত কলঙ্কের একমাত্র জীবিত স্মৃতি সেনদিদি। গোপালদাস নাকি জীবন্ত মানুষ কেনাবেচার ব্যাপারেও দালালি করত। তিনটে বৃদ্ধের সে বউ জুটিয়ে দিয়েছিল। এই কলঙ্কিত ঘটনার একমাত্র নিদর্শন যামিনী কবিরাজ ও সেনদিদি। টাকার বিনিময়ে গোপালদাস যামিনী কবিরাজের সঙ্গে সেনদিদির বিয়ে দিয়েছিল। গ্রাম্য প্রচার যামিনী কবিরাজকে সন্দেহপরায়ণ করে তুলেছে। তার মন এত বিষাক্ত যে সে গোপালের ছেলে শশী ও নিজের স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ করে। অন্যদিকে সেনদিদির সঙ্গে শশীর সপ্রতিভ ব্যবহার ও মেলামেশায় গোপালের আপত্তি। একসময় শশীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে—“যুবতী স্ত্রীলোক, নানারকম কুৎসা শুনতে পাই।....তোমার পসারের সময় এখনই একটা বদনাম রটে গেলে—এও কি তোমাকে বলে দিতে হবে।”


এই সুন্দরী সেনদিদির চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে গোপাল শশীর দ্বন্দ্ব তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। মানসিক সংঘাত ক্রমে জটিলতর হয়েছে। বৃদ্ধ যামিনী কবিরাজ অসমবয়সী সুন্দরী পত্নীর মৃত্যু কামনা করে, গোপালও চায় বিনা চিকিৎসায় বসন্ত ব্যাধিতে সেনদিদির মৃত্যু হোক। কারণ তার ও সেনদিদিকে ঘিরে যে কলঙ্ক গ্রামে রটেছে তার অবসান ঘটুক। আসলে প্রভুত্বকামী গোপাল পুত্রের কাছে প্রতিষ্ঠা পাবার মোহে ক্রমে নিজেকে অতীতের কলঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে। আর এই মানসিকতা নিয়েই সে বয়স্ক উপযুক্ত সন্তানকে বস করতে চায়। আর জেদী শশী অধিক আগ্রহ নিয়ে সেনদিদির সেবা করে তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু রূপসী সেনদিদির বসন্তরোগের জন্য মূল্য দিতে হয় অনেকখানি। তার সৌন্দর্য রূপই শুধু ক্ষয় হয় না, একটা চোখও নষ্ট হয়ে যায়। নিজের কুৎসিৎ রূপ নিজেই সহ্য করতে পারে না সেনদিদি। তাই বলে—“এতো রূপ নষ্ট হওয়া নয়, এযে কুৎসিত হওয়া, কদর্য হওয়া।...এর চেয়ে আমার মরাই ভালোছিল শশী।”


সেনদিদির রূপ গেলেও অন্তরের স্নেহ ফল্গুধারার কমতি নেই। শশী রোগীর ভিড়ে সেনদিদির কাছে সেরকম আসিতে না পারলেও সেনদিদি তাকে বাৎসল্য স্নেহের আবেশে সন্তানের ন্যায় আশীর্বাদ করে তার উন্নতি প্রত্যাশা করে—“আঃ বেঁচে থাক বাবা, তাই হোক। আরও রোগী হোক, লক্ষপতি হও।–বিয়ে করে সংসারী হও, দেশজুড়ে তোমার নাম হোক, তাই দেখে যেন মরতে পারি।”


যামিনী কবিরাজের সঙ্গে সেনদিদির বিয়ের পরেও গোপালের সঙ্গে সেনদিদির একটা সুপ্ত সম্পর্ক ছিল। এই উপকাহিনিতে সেনদিদির ইন্দ্রসভা বাসনা, অচরিতার্থ কামনার বঙ্কিম গতিই প্রকাশিত হয়েছে। যামিনী কবিরাজের সন্দেহ ও প্রতিশোধ পরায়ণতা, গোপালের বিকৃত অবৈধ নির্লজ্জ কামনা ও মনের বিচিত্র গতি-প্রকৃতি বর্ণনা করে লেখক প্রবৃত্তি শাসিত জীবনের ক্রীড়নক রূপ তুলে ধরেছেন। ঔপন্যাসিকের বিবৃতিতে সেনদিদি চরিত্রের যে রূপটি ফুটে ওঠে তা এইরকম—“কিছুদিন হইতে সেনদিদি হামেশাও বাড়িতে আসিতেছিল। গোপালের সঙ্গে তার যেন একটা সন্ধি হইয়াছে...শশীকে তা যেন অপমান করে।” গোপালের সঙ্গে সেনদিদির সম্পর্কের গভীরতার জন্য সেনদিদি গর্ভবতী হয়ে পড়ে কিন্তু অধিক বয়সে সন্তান আসার বিষয়টির সেনদিদির কাছে সৌভাগ্যের হল না, হল বিপজ্জনক।–“শেষ রাত্রে একটা ছেলে হইল সেনদিদির, ভোরবেলা সেনদিদি মরিয়া গেল।”


পরিশেষে বলা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আলোচ্য চরিত্রগুলিকে বাস্তবধর্মী অভিজ্ঞতার দ্বারা সমৃদ্ধ করে পরিবেশন করেছেন আর উপন্যাসের বিচিত্র চরিত্ররাজির মধ্যে যামিনী পত্নী সেনদিদির চরিত্রটি একটি বিশিষ্ট সার্থক জীবন্ত নারী চরিত্রের মর্যাদা পেয়েছে। ঔপন্যাসিক বিভিন্ন দিক থেকে উপন্যাসে তার উপযোগী তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে চরিত্রটি জীবন্ত করে তুলেছেন।