'অতিথি' গল্পের একদিকে রয়েছে সুখ দুঃখ হাসি কলহে ভরা বাস্তব জীবন এবং অন্যদিকে উন্মুক্ত প্রকৃতির নিরন্তর হাতছানি—দুইয়ের দ্বৈততানে গল্পটি তাই শ্রেষ্ঠত্বের সীমা স্পর্শ করেছে। মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো।

প্রকৃতি ও ব্যক্তির পারস্পরিক নিবিড় সম্পর্কের ছবি রবীন্দ্রনাথ এঁকেছেন অতিথি গল্পে। তারাপদ হয়ে উঠেছে তার অসামান্য উদাহরণ। তুমি কি এইমত সমর্থন করো? তোমার অভিমতের সপক্ষে যুক্তি দাও।

রবীন্দ্রনাথের গল্প জীবনে যে ক-টি গল্প তাঁর সৃষ্টি বৈচিত্র্যের বিচিত্র বিহারী রহস্যময়তার পরিচয় দানে বিশিষ্ট ‘অতিথি’ তাদের অন্যতম। মানব জীবনের ভাব-ভাবনার অতলান্ত নিয়ত বাইরের দিকে টানে প্রবহমান জীবন ও জগতের কেন্দ্রভূমিতে তাকে নিক্ষিপ্ত করায় ‘অতিথি’ তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। আসলে প্রকৃতির সঙ্গে মানব জীবনের যে গূঢ় ও গোপনচারী একটা বন্ধন আছে সেই বন্ধনের কাছে মানবে মানবে বাইরে থেকে চাপানো বন্ধন যে নিয়ত পরাজিত হয় অতিথি তার স্বার্থক প্রমাণ।


অতিথি গল্পের তারাপদর মাধ্যমে যে সব তত্ত্ব দেখানো হয়েছে তাতে স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে তারাপদ প্রকৃতির সন্তান, স্বভাব বাউন্ডুলে। মাটির টান তার নাড়ির চলাফেরাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষে মানুষে যে তৈরি করা বাঁধন সেই বাঁধনের বিপরীতে তার যাতায়াত। বিপুলা এই পৃথিবী প্রকৃতির টানের কাছে কি মানুষের সৃষ্টি বাঁধন ঢেঁকে ? না টেকে না। মানুষের বাঁধন টেঁকে না, ছিড়ে যায় প্রকৃতির ভয়ংকর রূপ সৌন্দর্য জাতটানের কাছে। নারী, প্রেম ভালোবাসা সেই বৃহত্তর টানের কাছে মূল্যহীন ধূলিমাটি ছাড়া আর কী ? কিবা তার দাম ? নেই, কোনো মূল্য নেই তার। বিপুলা পৃথিবী যার বাসস্থান মানুষের মন তার বাসা রচনা করে কেমন করে। কেবলমাত্র প্রকৃতি ছাড়া তা সম্ভব নয়। তাই আমি এই মতকে সমর্থন করি। কারণ প্রকৃতি ছাড়া যেমন তারাপদ বাঁচতে পারবে না, তারাপদ ছাড়া প্রকৃতি প্রকৃতি অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই এই মত সমর্থন যোগ্য।


তারাপদর এই অতিথি সত্তার রূপায়ণের সূত্রে এ গল্পের প্রকৃতি ও মানুষ একাকার হয়ে গেছে। প্রকৃতি তার মনোরঞ্জনকারী সমস্ত রকমের উপাদান নিয়ে তারাপদকে আত্মার আত্মীয় রূপে বেঁধে রাখতে চেয়েছিল। এই চাওয়া তারাপদর স্বভাব বাউল জীবনে ও হৃদয়ে বড় রকমের আকর্ষণ তৈরি করেছিল। ফলে মানুষের বাঁধন তার কাছে কখনো শেষ করা হতে পারেনি। সে তাই মানুষের বাঁধন বারে বারে ছিন্ন করেছে। প্রথমবার তারাপদ তার পারিবারিক স্নেহের বাঁধনটিকে ছিন্ন করেছে। পরে ঘরের বাঁধন রূপে স্নেহসিক্ত আকুলিত চিত্তমায়ের কথা প্রসঙ্গে অনায়াসে জানিয়ে দেয় তার আরও চারটি ছেলে এবং তিনটি মেয়ে আছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে একযাত্রা দলের অধিকারীর স্নেহোচ্ছায়া থেকে পালিয়ে যায় তারাপদ মানুষের বন্ধন ছিন্ন হয় পাঁচালি গানের সুর সংগীতে মানবের কারণে। পাঁচালি দলের দলাধক্ষ্যের বক্ষপিঞ্জর থেকে পালিয়ে যায় তারাপদ। এবার তার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে এক জিমনাস্টিকের দলের আশ্চর্য ব্যায়াম নৈপুণ্য। জিমনাস্টিকের দলটিও তাদের মানব বন্ধন দিয়ে তারাপদকে ধরে রাখতে পারনি। ফের সে নান্দীগ্রামের জমিদারবাবুর সখের যাত্রায় যোগদানের জন্য খাঁচা ছেড়ে পালায়। শেষ পর্যন্ত সে কাঁঠালিয়ার জমিদার মতিলালবাবুর পরিবারে হাজির হয়। সেখানে সে খুবই স্বচ্ছন্দে ছিল। কিন্তু মতিলালবাবু যেই তাকে আত্মীয়ের বাঁধনে বাধার চেষ্টা করলেন তখন প্রকৃতির ভিন্ন এক বৈচিত্র্যের টানে ডানা মেলে পালিয়ে যায় তারা-রূপক পাখিটি। একস্থান থেকে এক স্থানে এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে তারাপদর এই যে স্থানান্তর গমন তার মধ্যে আছে তার অতিথি সত্তা। এ পৃথিবীর মানুষ একে অন্যের অতিথিমাত্র হতে পারে। কিন্তু এ পৃথিবী প্রকৃতি লোকের ক্রোড়ভূমি মানুষের চিরকালের সম্পর্কের আশ্রয় হিসাবে চিহ্নিত। তারাপদ বারেবারে বাঁধন ছিড়ে পালিয়ে যেই আশ্রয়ের সন্ধান করেছে। প্রকৃতি জগৎ এখানে স্বভাব বাউল মানব জগতের চালক শক্তি হয়েছে।


মানুষকে মানব মনের ও জীবনের বিচিত্র ঘটনা ও প্রকাশকে প্রকৃতির সঙ্গে মুক্ত করে দেখা রবীন্দ্রনাথের শিল্পী হৃদয়ের ধর্ম। যার স্পর্শে পৃথিবীর ধুলো মাটি, আমাদের কাছে যা তুচ্ছ তা সোনা হয়ে গেছে। পৃথিবীর সঙ্গে একাগ্রতার ফলে পৃথিবী তাকে একটা অচঞ্চল শুভ্র, সংযত শুচিময় অবসানের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছেন। কোনোভাবে তার সমাপ্তিটুকুও আন্দোলিত হতে দেননি। তিনি তাঁর চরিত্র ও ঘটনা বস্তুগুলিকে পৃথিবীর ধুলোমাটির সঙ্গে এক করেছেন এবং যেগুলো পৃথিবীর ধুলোমাটির সঙ্গে পর্যায়ভুক্ত করেছেন। দেখেছেন, তারই প্রমাণ অতিথি গল্প। কিশোর তারাপদ কোথাও স্থির হয়ে থাকে না, কারো নিবিড় বন্ধনে ধাঁধা পড়ে না, মতিবাবু, অন্নপূর্ণা অথবা চারু, সোনামণি কারো স্নেহে প্রেম বন্ধুত্বের মধ্যে ও যে শেষ পর্যন্ত বাঁধা পড়লো না তার চলি চিত্ত একদিন বর্ষার মেঘ অন্ধকার রাত্রে আসক্তি বিহীন উদাসীন জননী বিশ্ব পৃথিবীর নিকট চলে গেল। আর এই ছবি রবীন্দ্রনাথ খুব সূক্ষ্মভাবে অঙ্কিত করেছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে অতিসচেতন ভাবে।