“রামপ্রসাদই শাক্তগানের গোমুখী উৎস।”—উক্তিটির আলোকে তোমাদের পঠিত পদ অবলম্বনে রামপ্রসাদের কৃতিত্ব দেখাও।

বৈষ্ণব পদাবলিতে চণ্ডীদাসের যে স্থান, শাক্তপদাবলিতে রামপ্রসাদের সেই স্থান। এমন কথা বহু আলোচক বলেছেন। কাব্যের প্রসাদগুণের মানদণ্ডে ও হৃদয়াবেগের গভীর গাঢ় উচ্চারণে রামপ্রসাদ চণ্ডীদাসের মতোই সার্থক ভক্ত কবি। হৃদয়ভাবের অকৃত্রিম প্রকাশ যদি শ্রেষ্ঠ কবিতার সংজ্ঞা হয়, তবে রামপ্রসাদ মধ্যযুগের বাঙালি কবিদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বলে স্মরণীয়। দেবতা ও ভক্তের মধ্যে ব্যবধান ঘুচিয়ে রামপ্রসাদই প্রথম বিশ্ববিধানের নিয়ন্ত্রীশক্তির অঙ্গে লাবণ্যামৃত মাখিয়ে 'মা' বলতে শেখালেন। রামপ্রসাদ রচিত পদাবলিতে প্রথম সস্তানের বাৎসল্যে ও স্নেহের কারাগারে জগজ্জন বন্দি হলেন।- কেবল গীতিকবিতার আবেগকুল উচ্ছ্বাসের জন্য, রামপ্রসাদ বাঙালি মনের গভীর চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছেন তাঁর মাতৃসাধনার মৌলিকত্বে।


পরিচয় : কবি রামপ্রসাদ হালিশহরের অধিবাসী এবং নদীয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন রামপ্রসাদের দুই পুত্র রামদুলাল ও রামমোহন। প্রথম জীবনে তিনি কলিকাতার কোনো এক ধনীগৃহে খাতা লিখতেন। মাঝে মাঝে তিনি খাতার কোণায় ভক্তিমূলক গান লিখতেন। একদিন তাঁর নিয়োগকর্তা- ‘আমায় দে মা তবিলদারি গানখানি দেখতে পান এবং কর্মবন্ধন থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে একটি মাসিক বেতনের ব্যবস্থা করে দেন। কৃষ্ণনগরের মহারাজ তাঁর কবিত্ব শক্তির পরিচয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকে ১৪ বিঘা নিষ্কার ভূমি দান করলেন। রামপ্রসাদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন আনুমানিক ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সর্বপ্রথম তাঁর জীবনী ও কবিতা সংগ্রহ করেন। তিনি আশঙ্কা করেছেন কবির অনেক কবিতাই সম্ভবত লোপ পেয়েছে। ড. সুকুমার সেন মনে করেন, “যে গানগুলির ভনিতায় 'দ্বিজ' আছে সেগুলি কবিরঞ্জন রামপ্রসাদের নয়”। কেউ কেউ কবিওয়ালা রামপ্রসাদ চক্রবর্তী রচিত কিছু কিছু পদও রামপ্রসাদের নামে প্রচলিত বলে অভিহিত করেছেন।


রচনা বৈশিষ্ট্য : মূলত রামপ্রসাদ ছিলেন কালীসাধক। আধ্যাত্ম চেতনার সুরটি তিনি তাঁর পদে ফুটিয়ে তুলেছেন। রামপ্রসাদের রচনার শেষদিকে মায়ের জয়গান মাতৃচরণে আত্মসমর্পণটি গভীরভাবে প্রকাশিত। তিনি কালীসাধক হলেও তাঁর রচনায় বাঙালির ঐতিহ্যের সমন্বয়ের সুরটি প্রকাশ লাভ করেছে।—

“প্রসাদ হাসিছে, সরসে ভাসিছে,

বুঝেছি জননী মনে বিচারি

মহাকাল কানু শ্যামা শ্যামা তনু

একই সকল সকল বুঝিতে নারি।”


মাতৃকরুণা লাভের জন্য তাঁর ছিল তীব্র কাতরতা। তাই তাঁর মুখে অকপটেই চলে আসে—

'আমি কি দুঃখেরে ডরাই।'


তাঁর এই উক্তিতে মনে হয় তিনি সাংসারিক দুঃখকে বিশেষ আমল দিতেন না।


আগমনী বিজয়া : রামপ্রসাদের প্রতিভার চরম স্ফূর্তি ‘আগমনী-বিজয়া' গানে না হলেও সাধারণভাবে ওই পদগুলির গুণগত উৎকর্ষতা এবং কাব্যমূল্য অস্বীকার করার নয়। ‘আগমনী-বিজয়া' গানে পৌরাণিক কাহিনি আশ্রয় করে বাঙালি কবিরা বাৎসল্য রসের যে উৎসার ঘটিয়েছেন তা তুলনাহীন। বহুদিন পরে উমার পিতৃগৃহে আগমন, দীর্ঘ দর্শনের পর মাতা কন্যার মিলন মুহূর্তটির বর্ণনায় রামপ্রসাদের অসাধারণ কাব্যশক্তির পরিচয় মেলে।

“পুনঃ কোলে বসাইয়া, চার মুখ নিরখিয়া, 

চুম্বে অরুণ অধরে।

বলে জনক তোমার গিরি, পতি জন্ম ভিখারি তোমা যেন সুকুমারী দিলাম দিগম্বরে।”


রামপ্রসাদের আগমনী-বিজয়া সংগীতে আছে মাতৃহৃদয়ের বেদনা এবং তৎকালীন সমাজচিত্র আর এসব কিছুর প্রকাশ ঘটেছে অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায়। বাস্তব সংসার বড়ো কঠোর—‘যেতে নাহি দিব' বললেও ‘যেতে দিতে হয়' তাই বিজয়া প্রভাতে ডম্বরু বাজিয়ে শঙ্কর উমাকে নিয়ে যান, তখন হতাশায় ভেঙে পড়লেও মায়ের প্রচেষ্টার কসুর হয়নি—

“ফিরে চাও গো উমা তোমার বিধুমুখ হেরি অভাগিনী মায়েরে বধিয়ে কোথায় যাও গো !"


ভক্তের আকুতি : রামপ্রসাদের শ্রেষ্ঠত্ব অবশ্য সাধনা আশ্রয়ী পদগুলির জন্য। এই পদগুলির মধ্যেই রামপ্রসাদের প্রতিভার যথার্থ বিকাশ ঘটেছে। রামপ্রসাদ সাধক কবি, তাই সাধনা বিষয়ে তিনি অনেক বেশি পদরচনা করেছেন। 'উমাসঙ্গীতে’ কন্যার প্রতি সন্তানের বাৎসল্যের পরিচয়। 'ভক্তের আকুতি' পর্বে জননীর প্রতি সস্তানের প্রতিবাৎসল্যের চিত্র প্রকাশিত। শ্যামাসঙ্গীতের প্রথম ধারাটি আবেগমূলক, দ্বিতীয় ধারায় পদগুলি সাধনতত্ত্ব কালিকে মা সম্বোধন করে শাক্ত কবিগণ তাঁর চরণে হৃদয়ের সমস্ত অনুরাগ ঢেলে দিলেন, তাঁকে কন্যারূপে নিজগৃহে প্রতিষ্ঠা করলেন তাতে প্রকাশ পেল বাঙালি হৃদয়ের নিবিড় স্পর্শ।


ভক্তের আকুতি পর্যায়ের পদে দেখা যায় রামপ্রসাদের একমাত্র আকৃতি কোনো পার্থিব সম্পদ অথবা মুক্তি আকাঙ্ক্ষা নয়, মায়ের অভয় চরণই তাঁর একমাত্র কাম্য। জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে কাব্য রচনা করায় বাস্তব জীবনের সুখদুঃখের বিচিত্র মূৰ্চ্ছনা তাঁর কাব্যে আধ্যাত্মিক সাধনার সুরে বিচিত্র ঝংকার তুলেছে। তান্ত্রিক আচারাদির মধ্যে বিশ্বেশ্বরীর স্নেহঘন জননীমূর্তি আবিষ্কার এবং স্নেহ-কাঙাল সস্তানের ব্যাকুলতা রামপ্রসাদের কবিতাবলীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এডওয়ার্ড থম্পসন তাঁর বেঙ্গলী লিরিকস্ গ্রন্থের ভূমিকায় যথার্থই বলেছেন – “The latter side of Saktaism is the one which is generally present in Ramprasad.” সহজ ভাবের সাধনার জন্যই তাঁর সৃষ্টি সহজেই ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে প্রবেশ করে। প্রসাদীসংগীত তৎকালীন সমাজ-মানসের প্রাণরসে জারিত। প্রসিদ্ধ আছে তিনি তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধিপ্রাপ্ত। তাই তাঁর পদে পঞমকার ও পঞ্চমুণ্ডির আসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন—

“হৃৎকমল মঞ্চে দোলে করালবদনী শ্যাম 

সন পবন দুলাইছে দিবস রজনী ও মা।”


কোনো কোনো পদে তিনি ব্রহ্মময়ীর স্বরূপ উদ্‌ঘাটনে ব্রতী হয়েছেন। সেখানে মুক্তিলাভের তত্ত্বটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত—

“প্রসাদ বলে, ব্রহ্মময়ী কর্মডুরি দেনা কেটে

প্রাণ যাবার বেলা এই কর মা, ব্রহ্ম রন্ধ যায় যেন ফেটে।”


এই সংসারবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে শুধু মায়ের নাম করেই তিনি অবশিষ্ট দিনগুলি কাটিয়ে দিতে চান–

“এমন দিন কি হবে তারা

যবে তারা তারা তারা বলে তারা চেয়ে পড়বে ধরা।"

ভক্তমনের আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা হয়েছে বলেই ‘ভক্তের আকৃতি' পদ নামে এই পদগুলি ভূষিত হয়েছে।


সাধক কবি রামপ্রসাদের কবিপ্রতিভার মূল্যায়ন ও বাংলা সাহিত্যে তাঁর আসন প্রসঙ্গে অরুণ কুমার বসু তাঁর 'বাঙলা কাব্যসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত' গ্রন্থে যথার্থ বলেছেন— “শাক্ত পদতরঙ্গিনীর গোমুখী রামপ্রসাদ শক্তি উপাসনাকে শাস্ত্রানুমোদিত আচারপরায়ণতা ও তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ থেকে মুক্ত করে তাকে সাধারণ মানুষের কর্মপীড়িত জীবনের সহজিয়া মাতৃব্যাকুলতা ও সংস্কারহীন ভক্তিতে পরিণত করেছিলেন। অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেন একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, ছন্দ বিষয়েও রামপ্রসাদ-এর কতখানি দক্ষতা ছিল এবং এ বিষয়ে তিনি 'আধুনিক কালের অগ্রদূত। সুতরাং বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ প্রসাদী সংগীতের মধ্য দিয়েই প্রথম অঙ্কুরিত হয়েছিল বলা যেতে পারে।