ল্যাবরেটরি গল্পের নামকরণ কতটা যথোপযুক্ত লেখো।

‘তিনসঙ্গী'র শেষগল্প হল 'ল্যাবরেটরি'। রবীন্দ্রনাথ অনুমান করেছিলেন তাঁর এই গল্পটি সকলে বুঝবে না। এর অন্তরালে নিহিত তাৎপর্যটি অনুধাবন করা অসতর্ক পাঠকের পক্ষে সম্ভব নয়। সোহিনী চরিত্রের রহস্যময়তা ও গভীরতা তাদের কাছে অপরিচিত থেকে যাবে। বিজ্ঞানী নন্দকিশোরের জীবন সঙ্ঘিনী সোহিনী এই গল্পের কেন্দ্র বিন্দু। নন্দকিশোরের ল্যাবরেটরির যোগ্য অধিকারীর জন্য সোহিনীর সন্ধান এবং পরিণামে তার সকরুণ ব্যর্থতা এই গল্পের বিষয়বস্তু। সোহিনী পাঞ্জাবের মেয়ে, কোনও ভদ্র পরিবেশ থেকে তার আবির্ভাব হয়নি। নন্দ কিশোরের সঙ্গে তার মিলন শয়তানের সঙ্গে শয়তানির আত্মিক ঐক্য। তবে চিত্তধর্মে সোহিনী নন্দকিশোরের অনুব্রতা। তার প্রাণধর্মে সে স্বৈরিণী। নৈতিক বিচারে নন্দকিশোরের মেয়ে বলে পরিচিত নীলা আসলে যে কার সন্তান সোহিনী তা নিজেও জানে না। তবে নন্দকিশোরের স্নেহ থেকে কখনো সে বঞ্চিত হয়নি। তাই মৃত্যু কালে নন্দকিশোর তার সমস্ত সম্পত্তি আর ল্যাবরেটরির ভার তাকেই দিয়ে গেছে। কারণ সে জানত সোহিনীই পারবে ল্যাবরেটরির মর্যাদা রক্ষা করতে, সেই সূত্রে সোহিনীর শুরু হল নন্দকিশোরে উপযুক্ত উত্তর সাধকের অনুসন্ধান। অধ্যাপক মন্মথ চৌধুরীর মাধ্যমে সোহিনী সন্ধান পায় রেবতী ভট্টাচার্যের। কিন্তু রেবতীর ভাগ্যকাশ জুড়ে আছেন ‘স্ত্রীরাহু’। তিনি হলেন তার পিসিমা।


একনারী ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ থেকে উদ্ধার করার জন্য আর এক নারীকে ব্যবহার করল সোহিনী, সে হল তার গর্ভজাত নীলা। বোটানিক্যাল গার্ডেনের আলোছায়ায় রূপসী নীলাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে রেবতী। গল্পের দ্বাদশ পরিচ্ছেদে দেখা যায়, সভা শেষ হওয়ার পর নীলা রেবতীর শিরার মধ্যে ঢেলে দিয়েছে 'জ্বালাময় মদ'। আর তাতেই আবিষ্ট রেবতীকে দেকে সোহিনী হতাশ হয়েছে। সে বুঝেছে রেবতী বিজ্ঞান সাধনায় নন্দকিশোরের মতো নিষ্ঠা রক্ষা করতে পারবে না। এইকারণে সোহিনী রেবতীর সঙ্গে নীলার বিবাহের পরিকল্পনার ইচ্ছা ত্যাগ করেছে, যদিও রেবতীকে নিয়ে শুরু হয়েছে মা ও মেয়ের চক্রান্ত। একদিকে মেয়ে নীলা চায় রেবতীকে মোহের জালে আবদ্ধ করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করতে। আর অন্য দিকে মা সোহিনী চায় তাকে দিয়ে নন্দকিশোরের ইচ্ছাপূরণ করতে। মা ও মেয়ের এই নিষ্ঠুর চক্রান্ত থেকে রেবতীকে রক্ষা করে তার পিসিমা। আর এ ঘটনাই 'ল্যাবরেটরি' গল্পের মূল বিষয়বস্তু। নন্দকিশোরের বিজ্ঞান সাধনার প্রতীক এই ল্যাবরেটরি। সেইজন্য ল্যাবরেটরি সোহিনীর পূজার দেবতা। আর ল্যাবরেটরির টাকা তার দেবতার ভাণ্ডার। শেষ পর্যন্ত ল্যাবরেটরির যোগ্য উত্তরাধিকারী পাওয়া গেলনা। গল্পের কাহিনি একটা ল্যাবরেটরিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত ব্যঞ্জনাধর্মী এবং সার্থক হয়ে উঠেছে।


‘তিনসঙ্গী’র তিনটি গল্পের নামকরণের আলোচনায় সমালোচক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘কথাকোবিদ্ রবীন্দ্রনাথ' বইটিতে জানিয়েছেন—“তিন সঙ্গীর প্রথম গল্প দুটি প্রেম কেন্দ্রিক। ল্যাবরেটরি আইডিয়া এবং প্রতীক-প্রধান। রবিবার বা শেষকথার নামকরণ বিশেষ ভাবে কোন অর্থবহ নয়। কিন্তু ল্যাবরেটরির ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোনামের মধ্যেই গল্পের বক্তব্য উচ্চারিত হয়েছে।” সুতরাং শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতেই হয় যে তিনসঙ্গীর তিনটি গল্পের নামকরণ সার্থক এবং যথাযথ হয়েছে।