‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় নিয়তি ও মৃত্যুর ভূমিকা ব্যাখ্যা করো।

'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসটি জীবন্ত এবং জীবনের মতোই মৃত্যুময়। অথবা ঘুরিয়ে বলা যায় মৃত্যুচেতন জীবনময়তার উপন্যাস হল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পুতুল নাচের ইতিকথা। আর কোনো বাংলা উপন্যাসে মৃত্যু এভাবে আসেনি। যে মৃত্যু নিয়তি কর্তৃক নির্ধারিত, সাধারণ মানুষের অগোচরে অভিনিবিষ্ট, যে মৃত্যু মনুষ্যজীবনে একেবারে উপর্যুপরি এবং অন্তর্জগতের ভিতর পর্যন্ত অনুপ্রবেশ করে স্বাভাবিকতাকে বিনষ্ট করে। এই মৃত্যুর ঘটনা দিয়েই উপন্যাসের শুভ সূচনা : “খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া হারু ঘোষ দাঁড়াইয়াছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।” উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদটি মূলত ব্যয়িত হয়েছে মৃত্যুর বর্ণনার ও তার প্রতিক্রিয়ায়। লক্ষণীয় মানিকের সমকালীন কবি জীবনানন্দ যখন মৃত্যুর আগে সমস্ত ইন্দ্রিয় জাগ্রত রেখে জীবনের রূপ রস আস্বাদ আঘ্রাণ করতে চেয়েছিলেন, মানিকের এই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার জীবনও তেমনি মৃত্যুচিন্তিত ও মৃত্যুচেতন বলেই মূল্যবান। মনে রাখতে হবে হারুর মৃত্যু নায়ক শশীর ভিতরে বৈরাগ্য সঞ্চার না করে জীবনের প্রতি একপ্রকার ভালোবাসাই জাগিয়ে দিয়ে যায়ঃ “হারুর মরণের সংস্রবে অকস্মাৎ আসিয়া পড়িয়া শশীর কম দুঃখ হয় নাই। কিন্তু তার চেয়েও গভীরভাবে নাড়া খাইয়াছিল জীবনের প্রতি তার মমতা। মৃত্যু পর্যন্ত অন্যমনস্ক বাঁচিয়া থাকার মধ্যে জীবনের অনেক কিছুই যেন তাহার অপচয়িত হইয়া যাইবে। শুধু তাহার নয়, সকলের জীবনের এই ক্ষতি প্রতিকারহীন।”


উপন্যাসের এই মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই আসেনি, এসেছে অপঘাত মৃত্যু রূপে। বস্তুতপক্ষে এ উপন্যাসের সবগুলি মৃত্যুর ভিতরে আপাত পার্থক্য যাই থাক, সবগুলিই অপঘাতমূলক। এককথাই স্বাভাবিক মৃত্যু এ উপন্যাসে একটাও নেই। উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদে হারু ঘোষের মৃত্যু অপঘাত রূপেই নিষ্পন্ন হওয়ার পর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটে ভূতোর। তার মৃত্যু ঘটেছে গাছে মগডাল থেকে পড়ে। তাও তো অপঘাতমূলক। ডাক্তারের কাছে এ মৃত্যু তুচ্ছ হলেও অতি সংবেদনশীল, শশী এই মৃত্যুর কথা কখনো ভুলতে পারেনি। আর একটি মৃত্যু সেনদিদির। একসময়কার রূপসী কলঙ্কবতী সেনদিদি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রথমে রূপ হারায় ও চোখ হারায়, তারপর কোনো এক “শেষরাত্রে একটি ছেলে হইল সেনদিদির, ভোরবেলা সেনদিদি মরিয়া গেল।” এই সেনদিদির রেখে যাওয়া শিশুপুত্রটি শশী আর তার পিতা গোপালের মধ্যেকার দীর্ঘ টানাপোড়েনের ভিতর দিয়ে একটি দীর্ঘ ও স্থায়ী ফাটল তৈরি করে এবং ওই শিশুপুত্র নিয়ে গোপাল চিরকালের জন্য গাওদিয়া গ্রাম ত্যাগ করে চলে যায়।


বাংলা সাহিত্যে কারণহীন মৃত্যুর উদ্গাতা হলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। 'আটবছর আগের একদিন' কবিতায় জীবনানন্দ এক আত্মহত্তারকের বর্ণনা দিয়েছিলেন—যাকে শিশু, বৃদ্ধ, অর্থ, কীৰ্তি কিছুই বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। তাকে হত্যা করেছিল ‘এক বিপন্ন বিস্ময়’ যে অন্তত আমাদের রক্তের মধ্যে খেলা করে। এই বিপন্ন বিস্ময় আর কিছু নয়, অস্তিত্বের সংশয়, এক সর্বগ্রাসী শূন্য। মানিকও অনুরূপ দৃষ্টান্তের সামিল। 'যাদব আর পাগলাদিদি এই অভিধায় ভূষিত। ভবিষ্যতে যিনি স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণ করবেন। উপন্যাসে তিনি প্রবেশ করেন সাপের ভয়ে লাঠি ঢুকে ঢুকে। “লাঠি ঠুকিয়া যাদব পথ চলেন। শশী জানে এত জোরে লাঠির শব্দ করা সাপের জন্য। মরিতে যাদব কী ভয় পান, জীবন মৃত্যু যাঁর কাছে সমান হইয়া গিয়াছে।”শশীর সঙ্গে গল্প করতে করতে হঠাৎ যাদব আত্মগরিমায় মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন তাঁর মৃত্যু হবে রথের দিন, একথা তিনি জানেন। এমনকি কবে কোন্ সালে রথের দিন মৃত্যু হবে তাও নাকি ঠিক করা আছে। এটি অসম্ভব ব্যাপার বলে, শশী কথাটা চাপা দেবার জন্য অন্য কথা পাড়ে, অতঃপর নেহাৎ কথাচ্ছলে শশী ব্যাপারটা পরান ও কুসুমকে বললে ক্রমশ তা গাওদিয়া গ্রামের সবাই জানতে পারে এবং যাদব ও পাগলাদিদি শেষপর্যন্ত নেহাৎ এই অসম্ভব কথাটা বলে ফেলার জন্যে স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণ করে নেন।


যাদব ও পাগলাদিদির এই কারণহীন মৃত্যুর মতোই আরও একটি মৃত্যু উপন্যাসে ঘটেছে, যা বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে বড়োই অভিনব। সফল প্রেম ও ব্যর্থ প্রেমের অনেক আখ্যান রচিত হয়েছে বাংলা ভাষায়, কিন্তু কুসুম যে কথা বলেছে তা কখনো কেউ শুনেছে বলে মনে হয় না। যখন সে ছোটোবাবুর ডাকে সাড়া না দিয়ে বলে উঠেছে : “যেতাম ছোটোবাবু। স্পষ্ট করে ডাকা দূরে থাক, ইশারা করে ডাকলে ছুটে যেতাম। চিরদিন কি একরকম যায় ? মানুষ কি লোহায় গড়া চিরকাল একরকম থাকবে, বদলাবে না? বলতে বসেছি যখন কড়া করেই বলি, আজ হাত ধরে টানলেও আমি যাব না।” কিংবা আরও একটু পরে যখন সে শশীকে বলেছে : “লোকের মুখে মন ভেঙে যাবার কথা শুনতাম, কে যাবে আপনার সঙ্গে ? কুসুম কি বেঁচে আছে ? সে মরে গেছে ।” এই মন জেগে উঠে মরে যাওয়া, একদিন দুদিন নয়, অনেকগুলি সুদীর্ঘ বছর ধরে তার জন্য কুসুম পাগল হয়েছিল, তারপর ধীরে ধীরে তার সে উন্মাদ ভালোবাসা নির্জীব হয়ে এসেছে, হয়তো মরেই গিয়েছে। এই অদ্ভূত মনের মৃত্যু বাংলা সাহিত্যে আগে কখনো দেখা যায়নি। এককথায় উপন্যাসের অবয়ব জুড়ে আছে বিচিত্র মৃত্যুর চিত্র—যাকে শরীরের মৃত্যু, মনের মৃত্যু, আত্ম নির্বাসনে প্রভৃতি রূপে দৃষ্ট হয়। তবে এ সবের পরেই রয়েছে এক পরাজিত-অপরাজিত, ক্লান্ত-ক্লান্তিহীন মন্থর অভিজ্ঞতালব্ধ চলিষ্ণুতা।


নিয়তিঃ উপন্যাসের প্রথম থেকে মৃত্যুর মতো নিয়তিও তার অনিবার্য কালো ছায়া বিস্তার করেছে। যেখানে খালের ধারে বড়ো বটগাছে হেলান দিয়ে হারু ঘোষ বজ্রাঘাতে মারা গিয়ে নির্জীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লেখক বিষয়টি এমনভাবে ব্যক্ত করেছেন : “আকাশের দেবতা তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।" গ্রন্থের শুরুতেই এই ভয়াবহ মৃত্যু মূলত নিয়তি নির্দিষ্ট। বজ্রাহত হারুকে ঘিরে এক জগৎ উদ্ভাসিত হয়েছে—যা প্রায় অপ্রাকৃত ও প্রতীকি। উপন্যাসের সর্বত্রই নিয়তি ও মানুষ এক রেখায় দাঁড়িয়ে। যেখানে লড়াই করে করে মানুষ শেষপর্যন্ত হেরে যায়—কিন্তু যে বেঁচে থাকে সে হল শশী। যেখানে দায়িত্বময় শশীর বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করে চলে। কিন্তু তাঁর মধ্যে যে রেষের উদ্বোধন ঘটে তা সত্যিই গভীর। বিশেষত শশীর যখন উপলব্ধি হয় গ্রামের সাধারণ মানুষজন সম্পর্কে : “রোগে ভুগিয়া অকারণে মরিয়া ওরা বড়ো আনন্দে থাকে। স্ফূর্তি নয়, আনন্দ, শান্ত স্তিমিত একটা সুখ। ওরা প্রত্যেকে রুগ্ন অনুভূতির আড়ৎ। সংকীর্ণ সীমার মধ্যে ওদের মনের বিস্ময়কর ভাঙাগড়া চলে। সতেজ উত্তপ্ত জীবন ওদের সহিবে না।” তখন মনে হয়, মানুষের সমগ্র জীবন যে নিয়তি পরিচালিত তা একমাত্র বুঝেছেন শশী ডাক্তার।


উপন্যাসের প্রায় সকল চরিত্রের পরিণাম শূন্যতায়, অন্ধ মত্ততায় পর্যবসিত। এক অলক্ষ্য হাতের অন্ধ হাতি ঘোড়া মাত্র, যারা সর্বদা নিয়তির দ্বারা পরিচালিত। কুসুমের অতৃপ্ত জীবনে শশীকে কাছে পেয়ে চেয়েছিল সুখে বাঁচতে। কিন্তু বিধাতার করুণ পরিহাসে তা সম্ভব হয়নি। শশী চেয়েছিল গাওদিয়া ছেড়ে চলে যাবে শহরে। বিলাতে গিয়ে বড়ো ডাক্তার হবে। কিন্তু তাকে চিরকাল গ্রাম আগলে পড়ে থাকতে হল। শশীকে নিয়ে গোপালের কত না স্বপ্ন, কিন্তু কী এক অদৃশ্য নির্দেশে রাতের অন্ধকারে তাকেও গ্রাম ত্যাগ করতে হয়। সেনদিদির পুত্রসন্তান জন্ম দিয়েও মৃত্যুবরণ করতে হয়। বিন্দু স্বামীর ঘরে গিয়েও পায় বারনারীর মর্যাদা। মতি ও কুসুম পাড়ি দেয় বিদেশে, যাদব ও সেনদিদি স্বেচ্ছায় বরণ করে মৃত্যু ইত্যাদি বিষয়ই প্রমাণ করে নিয়তি এ উপন্যাসের এক নিয়ামক শক্তি এবং কুসুমের বাবা অনন্তের বক্তব্যেই তা যথাযোগ্য মর্যাদা পায় : “সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর এক, চিরকাল এমন দেখে আসছি ছোটোবাবু। পুতুল বইতো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।


সর্বোপরি, নিয়তি ও মৃত্যু সমগ্র উপন্যাসখানিকে কী বিচিত্রভাবে আলোড়িত করেছে তা বাংলা উপন্যাসের জগতে বড়োই অভিনব। এই অদৃষ্টবাদ-এর গতি ও স্বরূপ কী তা সাধারণের বোধগম্যের অতীত হলেও জীবনদ্রষ্টা ক্ষণিকের প্রতিবিম্ব শশীর নিকট সার্থকভাবে ধরা পড়ে “নদীর মতো নিজের খুশিতে গড়া পথে কি মানুষের জীবনের স্রোত বহিতে পারে ? মানুষের হাতে কাটা খালে তার গতি, এক অজানা শক্তির অনিবার্য ইঙ্গিতে।"