বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে মাথুর বলতে কি বুঝায়? এ প্রসঙ্গে তামাদের পঠিত পদ অবলম্বনে মাথুরের বৈশিষ্ট্য ও ভাবসৌন্দর্য বিশ্লেষণ করো।

প্রেমকাব্যে বিরহ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বৈষ্ণব পদাবলীতেও বিরহ একটি বিশেষ রসপর্যায়ের পদ। বিরহের পদগুলি যত রসোত্তীর্ণ অন্য পদ ততটা হয়নি। প্রেমের পূর্ণতা মিলনে। কিন্তু বিরহ সেই মিলনকে গভীর করে তুলতে সাহায্য করে। উজ্জ্বল নীলমণিতে প্রবাসের সংজ্ঞা নিম্নরূপ-

“পূর্বসঙ্গত যোর্য় নোৰ্ভবেদ্দেশাম্ভবাদিভিঃ।

ব্যবধানস্ত যৎ প্রাজ্ঞৈঃ স প্রবাস ইতীৰ্য্যতে।।


অর্থাৎ পূর্বসম্মিত নায়ক-নায়িকার মধ্যে যে দেশ গ্রাম নদী বনাদি স্থানান্তরের ব্যবধান, পণ্ডিতগণ তাকেই প্রবাস বলেন। পদাবলীসাহিত্যে কেবল নায়কের প্রবাস গমনই বর্ণিত হয়েছে। বিপ্রলম্ভের চতুর্বিধরূপের মধ্যে শেষ বা চতুর্থটি প্রবাস। এই প্রবাস আবার দু'ধরনের অদূর প্রবাস ও সুদূর প্রবাস।


প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে বিরহের দুস্তর ব্যবধান, মিলনের জন্য উভয়ের মধ্যে উদগ্র ব্যাকুলতা, অথচ মিলনের কোনও পায় নেই। বিরহ-সমুদ্রের কূলে দাঁড়িয়ে প্রেমিক প্রেমিকার হৃদয় এক অব্যক্ত বেদনায় ক্রন্দনমুখর হয়ে ওঠে। বিরহের মধ্যে প্রেমিকার হৃদয়ানুভূতির প্রকাশ নিবিড় বলেই জগতের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য বিরহের উপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছে। বৈষ্ণব পদসাহিত্যেও বিরহ অবলম্বন করে বহু উৎকৃষ্ট পদ রচিত হয়েছে। মিলনের নিবিড় আনন্দে রাধাকৃষ্ণের হৃদয় উদ্বেল। মিলনের পর বিরহের ব্যথা বেদনা দু’টি হৃদয়কে দীর্ঘশ্বাসে মর্মরিত করে আবার নতুন করে মিলনের পটভূমি প্রস্তুত করে দেয়।


‘মাথুর’ বিরহেরই অন্যরূপ। কৃষ্ণ বৃন্দাবন ত্যাগ করে কংসকে দমন করবার জন্য মথুরা চলে গেলেন। আর বৃন্দাবনে ফিলে এলেন না। চিরদিনের জন্য বৃন্দাবন ত্যাগ করে মথুরাগমনকে অবলম্বন করেই মাথুরের পদগুলি রচিত হয়েছে। সাময়িক বিরহের পর মিলনের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু মাথুর চিরবিচ্ছেদ। এর পর আর মিলনের কোনও সম্ভাবনাই থাকে না। তাই মাথুর কেবল অস্তহীন ব্যথা বেদনার পদাবলী।


রাধার জীবন কৃষ্ণময়। কৃষ্ণকেই তিনি দেহমনপ্রাণ নিঃশেষ সমর্পণ করেছেন। কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে তার জীবনের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা-আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রবাহিত। কৃষ্ণের বাইরে তার কোনও জগৎ নেই। সেই কৃষ্ণ যখন বৃন্দাবন ত্যাগ করে চিরকালের জন্য মথুরায় চলে। গেলেন তখন তার দুঃখের সীমা রইল না। তাঁর ঘর শূন্য। বৃন্দাবন নগরীতে নেমে এসেছে শূন্যতার অন্ধকার। যমুনার কূল অতি প্রিয় স্থান কারণ এখানে কৃষ্ণের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কিন্তু এখন কেমন করে তিনি যমুনা কূলে যাবেন? কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের পাছে বাধা হয় তাই তিনি হার পরতেন না। স্তনে চন্দনলেপন করতেন না। সেই কৃষ্ণের সঙ্গে এখন নদী ও পর্বতের চির ব্যবধান। প্রাকৃতিক পরিবেশ এখন রাধার দুঃসহ দুঃখকে যেন বাড়িয়ে তুলেছে। বর্ষার অভিশ্রান্ত ধারাবর্ষণে প্রিয়মিলনের জন্য হৃদয় ব্যাকুল, তখন কৃষ্ণ অনুপস্থিতি তার হৃদয় বিদীর্ণ করে—

এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।

এ ভরা বাদর   মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর।।


মাথুর শীর্ষক পদগুলির কাব্যমূল্য যথেষ্ট। বৈষ্ণব কবিগণ এই পদাবলীর মধ্যে রাধার হৃদয়ার্তি বর্ণনার কালে শাশ্বত প্রেমিকার অন্তহীন ব্যথাবেদনার কথা বর্ণনা করেছেন। বৈষ্ণবকবিগণ যথার্থ জীবন রসিক। মানবজীবন প্রবাহে মিলনের আনন্দ অতি ক্ষণস্থায়ী, এবং সেই হিসাবে বিরহানুভূতিই যে জীবনের শাশ্বত সত্য, তা তাঁরা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তাদের পদাবলীতে বিরহের ব্যাকুলতা এরূপ করুণ রসনিবিড়তায় মূর্ত হতে পেরেছে। এই বিরহ এক শূন্যতাবোধে পর্যবসিত। রাধা বলেন—

শূন ভেল মন্দির শূন ভেল নগরী।

শূন ভেল দশ দিশ শুন ভেল সগরী।।


কৃষ্ণ চিন্তায় বিভোর রাধা সাধনার চরম স্তরে উঠে কৃষ্ণ ও তাঁর মধ্যে কোনও পার্থক্য দেখতে পান নি। শ্রীমতি রাধিকাই কৃষ্ণে পরিণত হয়েছেন—

“অনুখন মাধব মাধব সোওরিতে সুন্দরী ভেলি মাধাই”


এছাড়া চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস প্রভৃতি বৈষ্ণব কবিগণ মাথুরের বিরহভাব অবলম্বনে শ্রেষ্ঠ প্রেমকাব্য রচনা করেছেন।