ঔপন্যাসিক রূপে সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালার প্রতিভা নির্ণয় করো।

সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী ওরফে নিরালা (১৮৯৮-১৯৬১) হিন্দি সাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য লেখক। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, ছোটোগল্পকার এবং ঔপন্যাসিক। হিন্দি সাহিত্যের ছায়াবাদ যুগের প্রতিনিধি স্থানীয় কবি নিরালা উপন্যাস রচনাতেও তাৎপর্যপূর্ণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। শৈশবসূত্রে কিছুকাল মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলে অতিবাহিত করার ফলে এবং শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চার প্রথম দিকে উভয়ত হিন্দি ও বাংলার চর্চায় মগ্ন থাকার ফলে তাঁর মনে স্বাভাবিকভাবে বঙ্গসংস্কৃতি প্রভাব ফেলেছিল তাঁর উপন্যাসবলিতে সেই প্রভাব বিদ্যমান। তাঁর রচিত উপন্যাসগুলি হল: 

  • ১। অপ্সরা (১৯৩১); 

  • ২। অলকা (১৯৩৩); 

  • ৩। নিরুপমা (১৯৩৬); 

  • ৪। প্রভাবতী (১৯৩৬); 

  • ৫। চেটি কি পকড় (১৯৪৬) ; 

  • ৬। কালে কারণামে (১৯৫০): 

  • ৭। ইন্দুলেখা (১৯৮২-তে সংকলিত); 

  • ৮। চামেলী (১৯৮২-তে সংকলিত)।


বিংশ শতাব্দীর নানা ভাবনা চিন্তার তরঙ্গই নিরালার সাহিত্য মননটিকে পুষ্ট করেছিল। তাঁর উপন্যাসে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে সমাজ স্তরে বিভক্ত নানা শ্রেণির মানুষের আত্মাভিব্যক্তি এবং সামাজিক সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে জীবনের বাস্তববাদী রূপালেখ্য চিত্রিত হয়েছে। উপন্যাসের বিষয় হিসাবে তিনি সামাজিক ঐতিহাসিক ও ফ্যান্টাসিকে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর উপন্যাসবলি পর্যালোচনার পর ঔপন্যাসিক নিরালার যে বৈশিষ্ট্য নজরে আসে সেগুলি হল:

  • নিরালার উপন্যাসে হিন্দি সাহিত্যে নব বাস্তববাদের জন্ম দিয়েছিল। নূতন সমাজ নির্মাণের সক্রিয়চেতনা এই বাস্তববাদের ভিত্তিভূমিতে প্রোথিত ছিল।

  • মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দর্পণে জীবন পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিরালার উপন্যাস স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছিল। মনস্তত্ত্ব এবং সমাজতত্ত্ব নিরালার উপন্যাসে প্রাধান্য পেয়েছে।

  • ব্যক্তির আত্মাভিব্যক্তির দর্পণে, সামাজিক তরঙ্গগুলির সঙ্গে ব্যক্তির সংঘর্ষের ফলে নিরালার উপন্যাস কাব্যিক ফ্যান্টাসি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। সেসব ক্ষেত্রে কাল্পনিক আদর্শবাদ উপন্যাস কাহিনিতে প্রকট হয়ে উঠেছে।


অপ্সরা, অলকা, নিরুপমা, প্রভাবতী চোটি কি পকড়, কালে কার নামে, উপন্যাসগুলির বিশ্লেষণে নিরালার ঔপন্যাসিক স্বভাবের স্বরূপ উদঘাটিত হতে পারে।


‘অপ্সরা' উপন্যাসটি গড়ে ওঠে কনক ও রাজকুমারের সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে। রাজকুমার ও তার বন্ধু চন্দনের বিপ্লবী চেতনা ও সমাজ ভাবনাকে কেন্দ্র করে দ্বান্দ্বিক সংঘর্ষই এ উপন্যাসের কাহিনির কেন্দ্র। সেখানে রাজকুমারের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন মুখ্য হয়ে ওঠে। রাজকুমারকে কল্পনার জগত থেকে বাস্তব জগতে বিচরণ করায়। কনকের সংস্পর্শে রাজকুমার তার সমগ্র বিপ্লবী চেতনা বা সংগ্রামী সংকল্প ভুলে যায় পরক্ষণে বন্ধু চন্দনের গ্রেপ্তারের সংবাদে সমস্ত মোহজাল ছিন্ন করে সে বাস্তবে ফিরে আসে।


‘অলকা’ উপন্যাসের বিষয় একই সঙ্গে গ্রাম্য সমাজ, শোষিত কৃষকের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস। মহাসমরোত্তর কালের পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাসের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অজিত, বিজয় এবং অলকা। কৃষকের উপর নেমে আসা অত্যাচারের বিরুদ্ধ লড়েছে অজিত এবং বিজয়। কংগ্রেস ও কিষাণসভা সংগঠনের মাধ্যমে যে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। শেষাবধি তা তিরোহিত হয়ে তাদের দৃষ্টি অলকার উপর নিবন্ধ হয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত অলকা রাজা মুরলীধরকে হত্যা করেছে।


‘নিরুপমা' উপন্যাসের বিষয়ের মূলকথা কুমার ও নিরুপমার প্রেম পরিণয়। লন্ডন থেকে ‘ডিলিট’ ডিগ্রি নিয়ে ফেরা বেকার যুবক কুমার চাকরি না পেলেও নিরুপমার প্রেম পেয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী যামিনীহরণ পরাজিত হয়েছে। জমিদার কন্যা নিরুপমার সঙ্গে তাদেরই অধীনস্তু কুমারের প্রেম পরিণতিতে যে সমস্যা ও দ্বন্দ্ব প্রার্থিত ছিল তার কিছুটা ঘাটতি হয়েছে।


‘প্রভাবতী' ঐতিহাসিক বিষয়কেন্দ্রিক উপন্যাস। এর বিষয়ের কেন্দ্রে রয়েছে পৃথ্বীরাজ জয়চন্দ্রের সময়কার উত্তর ভারতের রাজাদের সংঘর্ষের কাহিনি। ঔপন্যাসিক নিরালা এখানে যেন ভূমিকায় অবতীর্ণ। তৎকালে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, বিলাসিতাপূর্ণ জীবনাচরণের নিরালা বেত্রহস্ত। উপন্যাসটি নবযুগের নারী জাগরণের মহিমাতেও ভাস্বর। প্রভাবতীর মতো তরুণীর নৈতিকতা ও আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে প্রাণ বিসর্জনের সংকল্পে এ ব্যাপারের সমর্থন মেলে।


‘চোটি কি পকড়' উপন্যাসের পটভূমি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের বাংলাদেশ। উপন্যাসের নায়ক প্রভাকর বিপ্লবী সংগঠন ও সংঘর্ষে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল। মূলত স্বদেশি আন্দোলনের সময়কার সমাজ মানসের চলমান পরিবর্তনের চিত্রে সমৃদ্ধ এই উপন্যাস। এখানে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন কেন্দ্রিক সময় তরঙ্গের অভিঘাত জীবন্ত হয়ে উঠেছে।


‘কালে কারণমে’ উপন্যাসে নিরালা সমাজের এক বাস্তবসম্মত চিত্র অঙ্কন করেছেন। এক দরিদ্র লাঞ্ছিত গ্রামীণ পরিবার এই উপন্যাসের কেন্দ্রে বিরাজিত। সামাজিক শাসন শোষণে বিশেষত পুলিশের অত্যাচার যে মানুষের জীবনকে অবদমিত ও অবরুদ্ধ রাখে তার এক বিশ্বাসযোগ্যরূপ নিরালা ‘কালে কারণাম' উপন্যাস এঁকেছেন।


আসলে ঔপন্যাসিক নিরালা বাস্তবতাবাদী সাহিত্যিক। স্বাধীনতা আন্দোলনের কালকে পটভূমি করে রচিত উপন্যাসবলিতে নিরালা উপনিবেশ বিরোধী ও সামন্ততন্ত্রবিরোধী জীবন ভাবনাকে উপজীব্য করেছেন। তাঁর উপন্যাসের গদ্য হয়েছে তাঁর জীবন সংগ্রামের ভাষা। হাস্য, ব্যঙ্গ সম্পৃক্ত তাঁর গদ্য তাঁর নতুন ধরনের বাস্তবতার পরিপূরক হয়েছে। গভীর দুঃখময়তার সঙ্গে হাস্য-পরিহাস ব্যঙ্গের মিশ্রণ নিরালাকে যথার্থ জীবনরস রসিকের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। নিরালার উপন্যাস সেই জীবনরস রসিকতার অভিব্যক্তি।