কমেডি নাটকের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য সহ একটি বাংলা কমেডি নাটক নিয়ে আলোচনা করো।

কমেডির সংজ্ঞা (Comedy) : যে নাটকে চরিত্র এবং ঘটনাসজ্জা একরকম থাকে, যাতে পাঠক আনন্দ পেতে পারে, এবং যার অস্তে মিল থাকে, তাকেই কমেডি বলে। কমেডির বাংলা পরিভাষা ‘মিলনাস্ত নাটক'। কোনো কোনো স্থানে এর বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ‘হাস্যোদ্দীপক'।


উৎপত্তি : এ সম্পর্কে বিস্তর মতপার্থক্য আছে। সাধারণভাবে মনে করা হয় গ্রিসের দেবতা ডায়োনিসাসের বসন্তকালীন উৎসব থেকে ট্র্যাজেডি এবং শীতকালীন উৎসব থেকে কমেডির উৎপত্তি ঘটেছে, অ্যারিস্টটলের মতে, কমেডির কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস নেই। গ্রিক ভাষায় ‘কমেডি’ শব্দের অর্থ আমোদকারীদের গান। একে ভিত্তি করে কোরীয়, গ্রিসের মোগরীয় এবং সিসিলির মেগরীয় প্রত্যেকেই দাবি করেন তাঁরাই কমেডির জন্মদাতা। ইংরেজি সাহিত্যে ট্র্যাজেডি ও কমেডির উদ্ভব ঘটেছে যথাক্রমে মর্যালিটি ও ইন্টারলুড থেকে। সংস্কৃত নাটকে ‘কমেডি’ নাম না থাকলেও হাস্যরসাত্মক নাটকের অভাব ছিল না, তবে তা আক্ষরিক অর্থে প্রহসনরূপে খ্যাত।


বাংলা কমেডি : বাংলা নাটকের উৎপত্তির সময় প্রহসন ধরনের নাটকই বেশি দেখা যায়। সূচনাপর্বে রামনারায়ণ তর্করত্ন এই ধরনের নাটকে প্রসিদ্ধি অজর্ন করেছিলেন, তবে কমেডি নাটকে সিদ্ধিলাভ করেন মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্র। মধুসূদনের দুটি একাংক— ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' ; দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ বা ‘জামাই বারিক’ প্রভৃতি প্রথম শ্রেণির কমেডি, পরবর্তীকালে বাংলা নাট্য সাহিত্যে এই কমেডি বিস্তর পরিমাণে রচিত হয়েছে, হচ্ছে।


কমেডির বিভাগ :

কমেডির বিষয়বস্তু, প্রকৃতি উপস্থাপন, এবং রসনিষ্পত্তির বিচারে তার শ্রেণিবিভাগ করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তবে সমালোচকের অভিমত বিশ্লেষণ করে যে কয়টি বিভাগ দৃষ্ট হয় তা নিম্নে প্রদত্ত হল—


১। রোমান্টিক কমেডি : সাধারণত প্রেমঘটিত বিষয়ই এই নাটকের মূলীভূত বিষয়, যেমন—উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়-এর 'ছদ্মবেশী' রবীন্দ্রনাথ মৈত্রের—'মানময়ী গার্লস স্কুল প্রমথ বিশীর ‘ঘৃতং পিবেৎ' প্রভৃতি এই পর্যায়ের নাটক।


২। স্যাটায়ারিক নাটক : সামাজিক আদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে বা নৈতিকতা বর্জন করে সমাজবিরোধী আচরণ যারা করে, তাদের নিয়েই লঘু ভাবে একটু অতিরঞ্জনের সাহায্যে এমন কমেডি গড়ে ওঠে। যেমন- দীনবন্ধু মিত্রের ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো', অমৃতলাল বসুর–‘কৃপণের ধন', দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের—‘পুনর্জন্ম' ইত্যাদি।


৩ । কমেডি অব ম্যানার্স : এই ধরনের কমেডি ব্যঙ্গমূলক এবং সামাজিক ব্যবস্থার ত্রুটিই এর মুখ্য আকর্ষণ। যেমন– জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের—'কিঞ্চিৎ জলযোগ', অমৃতলাল বসুর— 'কালাপানি', বা 'ব্যাপিকা বিদায়' এই পর্যায়ের নাটক।


৪। ফার্স বা গ্রহসন : ফার্স বলতে বোঝায় অত্যস্ত লঘু কল্পনাসিদ্ধ, অতিরঞ্জিত এক ধরনের হাস্যোচ্ছল নাটক। এই পর্যায়ে বাংলা নাটকের মধ্যে—জ্যোতিরিন্দ্রনাথের— ‘অলীকবাবু', দ্বিজেন্দ্রলালের—'কল্কি অবতার', অমৃতলালের— 'তাজ্জব ব্যাপার বিশেষ উল্লেখযোগ্য।


একটি বাংলা কমেডি নাটক :

রবীন্দ্রনাথের ‘বৈকুণ্ঠের খাতা' বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য কমেডি। মাত্র তিনটি দৃশ্যে এ নাটকের কাহিনি উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম দৃশ্যের কাহিনি হল—বৈকুণ্ঠের লেখা গ্রন্থ পাঠ শুনে নিজের আখের গুছিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে নিজ শালীর সঙ্গে অবিনাশের বিবাহ দিতে চায় কেদার, নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চায় সে। অবিনাশের সহপাঠী কেদার বন্ধুর কাছে এজন্য ভর্ৎসনা পেলেও শেষ পর্যন্ত বৈকুণ্ঠকে সে রাজি করায় যাতে অবিনাশ কেদারের শালী মনোরমাকে দেখতে চায়। এই দৃশ্যেই কেদারের যড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়েছে।


দ্বিতীয় দৃশ্যে অবিনাশ মনোরমাকে দেখে এসে এতই মোহিত হয়েছে যে কেদার এখন তার প্রিয় ব্যক্তি হয়ে উঠেছে। তার হাত দিয়ে সে ভাবী পত্নীকে একটি আংটি উপহার পাঠাতে চায়। কিন্তু এই উপহারের সঙ্গে কোন শব্দ নিয়ে চিঠি লেখা যায়, তা নিজে ভেবে না পেয়ে কেদার ও তিনকড়িকেও ভাবিয়ে সে অস্থির করে তুলেছে। আংটি উপহার ‘পদতলে’ না 'করতলে' দেওয়া উচিত এই চিন্তায় নিজে অস্থির হয়েছে অবিনাশ।


তৃতীয় দৃশ্যে কেদারের পরিকল্পনা মতো একে একে অনেকগুলি চরিত্র বৈকুণ্ঠের ঘরে এসে আশ্রয় নিয়েছে, এবং এরা সবাই মনোরমার আত্মীয় বা অনাত্মীয়া। মনোরমার দুঃসম্পর্কের পিসি, তার জামাইবাবু, কেদার, তার দুঃসম্পর্কের আত্মীয় বিপিন এসে ওঠে বৈকুণ্ঠের বাড়িতে। বিপিন বৈকুণ্ঠের পড়ার ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে। তার বই খাতা সব সরিয়ে দিতে থাকে। কখনও আবার সেই বই খাতা বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে গান করতে শুরু করে। বৈকুণ্ঠের ওপর অত্যাচার করার সময় সে যে গানটি করে তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ—'ভাবিতে পারিনে পরের ভাবনা'। এদের অত্যাচারে বৈকুণ্ঠ গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। তার গৃহভৃত্য ঈশানও জানায় যে অবিনাশের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত না থাকলে এই ধরনের অত্যাচার করার সাহস এদের কারোর হত না। বৈকুণ্ঠ যখন গৃহত্যাগ করতে চলেছে সেই মুহূর্তে অবিনাশ উন্মত্তের মতো ঘরে ঢুকেছে এবং সংসারের সব আপদকে একে, একে বিদায় দিয়েছে। দুই ভায়ের পুনর্মিলন ঘটেছে। হাস্যরস এ নাটকের মূলরস। সুতরাং নাটকটি যে নিঃসন্দেহে একটি সার্থক কমেডি এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।


বৈকুণ্ঠের বাতিক হাস্যরস সৃষ্টি করলেও তাঁর উদার, আত্মভোলা ও ভাইয়ের প্রতি স্নেহ মমতাপরায়ণ স্বভাব আমাদের সহানুভূতিকে আকর্ষণ করে। শেষকালে বৈকুণ্ঠ নিজের লেখার বিফলতা বুঝতে পেরেছে। তাঁকে সকলের কাছে অজ্ঞাত, উপেক্ষিত হতে দেখে তাঁর সম্পর্কে আমরা গভীর বেদনা বোধ করি, কমেডির সঙ্গে ট্র্যাজেডির যে মৌলিক বিরোধ নেই, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে; বৈকুণ্ঠের সম্পর্কে আমাদের কৌতুকবোধ বিষাদে মিশে যায়। বৈকুণ্ঠ গৃহত্যাগ করে চলে গেলে কিন্তু 'বৈকুণ্ঠের খাতা' ট্র্যাজেডিতে পরিণত হত। কিন্তু উপসংহারে দুই ভায়ের পুনর্মিলন তা হতে দেয়নি; ফলে নাটকটি কমেডির বৈশিষ্ট্যে যে শেষ পর্যন্ত সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আশা করি সেকথা আর বাড়িয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।