অ্যাবসার্ড নাটকের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করে, একটি বাংলা অ্যাবসার্ড নাটক নিয়ে বিশ্লেষণ করো।

উদ্ভট নাটকের অন্তর্নিহিত যে দর্শন তার শুরু বলা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে। অভিব্যক্তিবাদ, পরাবাস্তববাদ (Expressionism, Surrealism)-এর মতো ব্যক্তি-চিত্তার উকেন্দ্রিকতায়। কাকার The Trial ও Metamorphosis-এর ধোঁয়াটে জগতে। সেখানে ব্যক্তি মানুষ বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ, ভয়-যন্ত্রণা বিকারের অসহায় লক্ষ্যবস্তু। তবে অর্থহীনতা ও শূন্যতার অ্যাবসার্ড দর্শন পূর্ণতার রূপ পেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অস্তিবাদী দার্শনিক লেখক জাঁ পল সার্ত্র ও আল বেয়ার ক্যামুর রচনায়। মানুষকে দেখা হল এক নির্বান্ধব, বৈরী বিশ্বে বিচ্ছিন্ন, বিপন্ন এক জীব হিসেবে, যার সামনে কোনো উদ্দেশ্য নেই, যার দিন যাপনের কোনো অর্থ নেই। শূন্য থেকে শুরু আর শূন্যেই শেষ। এ এক পীড়িত উদ্ভট অস্তিত্ব, মোটের ওপর দ্বিতীয় বিশ্বোযুদ্ধোত্তর ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে অ্যাবসার্ডবাদীরা এমনটি ভাবতে শুরু করেছিলেন।


অ্যাবসার্ড নাটকের সংজ্ঞা: ক্যামু তাঁর The Myth of Sisyphus-এ অ্যাবসার্ড নাটকের স্বরূপ এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন— "In a Universe that a suddenly deprived of illusions and of light, man feels a stranger. He is an irremediable exile.... This divorce between man and his life, the actor and his sething, truly constitutes the feeling of absurdity".


ক্যামুর এই বক্তব্য ব্যাখ্যাতে যে কথাগুলি মূর্ত হয়ে ওঠে তা হল—“সুসংহত নিয়মবদ্ধ নাটক, যাকে পরিভাষায় বলা হয়ে থাকে ‘well made play' তারই বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় পাশ্চাত্যের আধুনিক নাট্যচর্চার অন্যতম ফসল অ্যাবসার্ড বা উদ্ভট নাটক। বিষয়বস্তু, আঙ্গিক, মঞরীতি, অভিনয় ইত্যাদি সমস্ত বিভাগেই যে নাটক স্বতন্ত্র, দুর্বধিগম্য মহাযুদ্ধোত্তর জীবনদর্শন ও প্রশ্ন জিজ্ঞাসার এক দুঃসাহসিক অভিজ্ঞান তাই হল অ্যাবসার্ড নাটক।


অ্যাবসার্ড নাটকের বৈশিষ্ট্য : অ্যাবসার্ড নাটকের যে বৈশিষ্ট্যগুলি অতি সহজেই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়, তা যথাক্রমে—

১। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে এই চিন্তার প্রসার ঘটে। 

২। জীবন সম্বন্ধে আপাত অবহেলা বা অশ্রদ্ধার ভাব এ নাটকে থাকে।

৩। আপাত অবাস্তব ঘটনার সমাবেশে তুলে ধরা হয় গভীর বাস্তববোধকে।

৪। মানুষের বিপন্ন অস্তিত্বের কথাও থাকে।


দৃষ্টান্ত : উনিশ শতকের ফরাসি নাট্যকার আলফ্রেড জারি এ নাট্যধারার পথিকৃৎ। জার্মান ঔপন্যাসিক কাফকার ‘The trial' (1925), 'Metamorphosis (1972) ফরাসি ঔপন্যাসিক আলবেয়ার কাম্যুর 'The Myth of Sisyphus (1942) । অ্যাবসার্ড নাটকের প্রকৃতিবিস্তার ১৯৫০ এরপর আয়োনেস্কো (lonesco), বেকেট (Beckett), প্রমুখের হাতে। উল্লেখযোগ্য রচনা—আয়োনেস্কোর ‘Rhinoceros (1960) প্রভৃতি। বাংলা সাহিত্যে বাদল সরকার সার্থক অ্যাবসার্ড নাটক রচনা করেছেন। 'ক্যাপ্টেন হুররা’, ‘এবং ইন্দ্রিজিৎ 'বাকি ইতিহাস প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক।


একটি বাংলা অ্যাবসার্ড নাটক :

নাট্যকার বাদল সরকারের 'এবং ইন্দ্রজিৎ' একটি নিখুঁত অ্যাবসার্ড নাটক। তাঁর ‘বাকি ইতিহাস' নাটকেও অ্যাবসার্ড দর্শনের লক্ষ্মণ প্রকট। এছাড়া মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘মৃত্যু সংবাদ’ ও ‘রাজরক্ত' উদ্ভট নাট্যধারার প্রতিনিধিত্ব করে। বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিং' নাটকে দেখা যায়, নাটকের সকল চরিত্ররা যেন কয়েকটি নামমাত্র– অমল, বিমল, কমল, নির্মল, মানসী, মাসিমা, সকলেই একই পরিবেশের একই ঘটনাচক্রে বিভিন্ন ব্যক্তি স্বরূপ। একটা নামের পর আর একটা, একদিনের পর আর একদিন এইভাবে উদ্দেশ্যহীন আবর্তে কেবল শূন্য পরিণামের দিকে চলতে থাকে। অমল, বিমল ও কমলের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা নাম নির্মল, যে কিন্তু মনে মনে ইন্দ্রজিৎ। ব্যক্তিসত্তার লোপ ও সমাজতন্ত্রের তুচ্ছ অংশমাত্র হয়ে ওঠাকে সে মানতে পারে না। মানসী তার ঘরে আসেনি, এসেছে অন্য কেউ। এখন কেবল—‘আমি বাজার করি, আমার বউ রান্না করে'। মানসী ঘরে এলেও এর কোনো ব্যতিক্রম হত না। তাই নির্মল ও ইন্দ্ৰজিৎ তাদের চাওয়া পাওয়ার হিসেব মেলাতে পারে না; তাই সামাজিক সত্তার আড়ালে মুখ লুকিয়ে ব্যক্তিসত্তা নির্মলের আড়ালে ইন্দ্রজিৎ অর্থহীন জীবনযাপন করে, প্রতীক্ষা করে মৃত্যুর, আয়োনেস্কোর 'আমোর্ড নাটকে যেমন স্বামী-স্ত্রী তাদের মাঝখানে থাকা একটি শবদেহ নিয়ে রাগ করেছিলো, যে শবদেহটি ওদের মৃত প্রেমের প্রতীক যে শবদেহটি ফুলে ফেঁপে উঠে ক্রমেই দম্পতির মধ্যবর্তী ব্যবধানকে বাড়িয়ে তুলেছিল। কাজেই ‘এবং ইন্দ্রজিৎ' নাটকের ভাবধারা যে উদ্ভটরূপে সুপ্রথিত সেকথা আর বিস্তারিত বলার অপেক্ষা রাখে না।