গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতির পদাবলীর পার্থক্য কি এবং কোথায়? আলোচনা করো।

গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতির পদাবলীর পার্থক্য


গোবিন্দদাসকে বিদ্যাপতির কবিশিষ্য বলা হয় নানা কারণে। উভয়ের কাব্যেই শব্দের ঝঙ্কার, ছন্দের দোলা এবং অলঙ্কারের প্রচুর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। উভয়েই রূপমুগ্ধ কবি। কবি বল্লভদাস সমকালীন মানুষের মনোভাবকে বুঝে নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন—

ব্রজের মধুর লীলা     যা শুনি দরবে শিলা 

গাইলেন কবি বিদ্যাপতি ৷

তাহা হৈতে ন্যূন    গোবিন্দের কবিত্ব গুণ

গোবিন্দ দ্বিতীয় বিদ্যাপতি।।


কবিশিষ্য বলতে কেবল শব্দঝংকার, ছন্দ এবং অলঙ্কারই বোঝায় তাহলে হয়তো গোবিন্দদাসকে বিদ্যাপতির শিষ্যত্ব দেওয়া যায়। কিন্তু কবিত্বে ছন্দ-অলংকার-ঝংকার নিতান্তই বাহ্য ব্যাপার। ভাবের রসে পরিণতই কবিত্ব, তা হলে গোবিন্দদাসকে বিদ্যাপতির শিষ্যত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। বিদ্যাপতি ছিলেন রাজসভার কবি, তিনি নিজে বৈষ্ণবও ছিলেন না। রাধাকৃষ্ণকে তিনি শৃঙ্গার রসমূর্তি বলেই গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর কাব্যে তাই লৌকিক প্রেমচিত্রই পাওয়া যায়। একথা ঠিক যে লৌকিক প্রেমও এক সময় গাঢ়তা পেয়ে অধ্যাত্ম স্তরে উন্নীত হতে পারে কিন্তু তা হলেও তা লৌকিকই। তাই বিদ্যাপতির রূপানুরাগ ছিল প্রবল—এ সম্বন্ধীয় পদে অলংকরণের প্রাচুর্য লক্ষিত হয়। বিদ্যাপতি রাধার মধ্যে দিয়ে নারীর রূপ উপভোগ করেছেন; তাই কৃষ্ণের রূপ বর্ণনা সেই দেহগত ভাবেরই প্রাধান্য ৷ চৈতন্যোত্তর কালের মহাজনগণ কৃষ্ণরূপের বর্ণনা করেছেন নানাভাবে।


রূপের বর্ণনায় বিদ্যাপতি সংস্কৃত আলঙ্করিক এবং বাৎস্যায়নের দ্বারা প্রভাবিত। অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু দেখিয়েছেন যে, বিদ্যাপতির রাধারূপ বর্ণনার পদগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়—(১) আলঙ্কারিক কলাচাতুর্যের পদ, (২) দেহের সর্বাঙ্গের বর্ণনামূলক পদ, (৩) বিশ্রস্তবাস দেহের কিংবা অরক্ষিত দেহের সৌন্দর্য এবং (৪) স্নানমূলক পদ। পদবিভাগ থেকে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে, কোথাও রাধাকে দেবী বা হলাদিনী শক্তি বলে গ্রহণ করেন নি বিদ্যাপতি, অথচ গোবিন্দদাসের রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক রূপানুরাগের পদে কি ভাবগভীরতার নিদর্শনই না পাওয়া যায়—কৃষ্ণের রূপ যেন মাটির পৃথিবীর সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগহীন—

ঢল ঢল কাঁচা   অঙ্গের লাবণি

অবনী বহিয়া যায়।

ঈষৎ হাসির   তরঙ্গ হিল্লোল

মদন মুরছা পায়।।


যে অঙ্গের লাবণ্য ‘অবনী বহিয়া যায় সে অঙ্গ কি দিয়ে নির্মিত? পৃথিবীর সামগ্রী তো কিছুতেই নয়, তার সামান্য হাসির হিল্লোলে কামনার অবসান। এ বিগ্রহ তো ভাবজগতের।

রাধার রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে কৃষ্ণের যে ভাবটি ফুটিয়ে তুলেছেন গোবিন্দদাস, তার স্বাদ বিদ্যাপতি পাননি—

কোমল চরণ   চলত অতি মন্থর

উপত বালুক বেল। 

হেরইতে হামারি    সজল দিঠি-পঙ্কজ

দুই পাদুক করি নেল।।


এ মূর্তি দেবীর; কিছুমাত্র কামনা জাগায় না। উত্তপ্ত বালুকা রাশির ওপর দিয়ে রাধা সখীদের নিয়ে কালিন্দীতে স্নানে চলেছেন—বালুকার উত্তাপে তার গতি মন্থণ। কৃষ্ণের হৃদয় অস্থির হয়ে উঠেছে—রাধার চরণপদ্মের তলায় পাদুকারূপে তার সজল চোখ দুটো পেতে দেবার ব্যাকুলতায় তিনি বিভোর। কৃষ্ণের এই আত্মসমর্পণ গোবিন্দদাসেরই।


মান-এর পদে বিদ্যাপতি উৎকর্ষ দেখালেও চৈতন্যেত্তর কালের মহাজনদের মানের পদের সঙ্গে তুলনা চলে না। বঙ্গদেশে প্রাপ্ত বিদ্যাপতির কয়েকটি মানের ‘পদে যে স্নিগ্ধতা দেখা যায় তা কীর্তনীয়দের কল্যাণেই রূপান্তরিত হয়েছে বলেই অধ্যাপক বসু মনে করেন।


কাব্যের বহিরঙ্গের একটা কথা এখানে স্মরণীয়; কাব্যে সুর সৃষ্টিতে গোবিন্দদাস জয়দেবের কাছে ঋণী বিদ্যাপতির কাছে নন। ছন্দ বিষয়ে বিদ্যাপতির কাছে গোবিন্দদাসকে ঋণ স্বীকার করতেই হবে কিন্তু সুর সৃষ্টিতে বিদ্যাপতি অনেক পেছনে।


অভিসারের পদে গোবিন্দদাসই প্রধান, বিদ্যাপতি তাঁর পরে। অধ্যাপক বসু বলেছেন, “গোবিন্দদাস দ্বিতীয় বিদ্যাপতি— কিন্তু, অভিসারে অদ্বিতীয়—বিদ্যাপতিরও ঊর্দ্ধে।' অবশ্যই স্বীকার্য যে, বিদ্যাপতির অভিসার বর্ণনায় অনেক বৈচিত্র্য আছে। তাঁর রাধিকার অভিসার হয়েছে বিচিত্র পরিবেশে। গোবিন্দদাসও অবশ্যই দিবাভিসার, তিমিরাভিসার, বর্ষাভিসার প্রভৃতির ভিতর দিয়ে বৈচিত্র্য সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন কিন্তু বিদ্যাপতিতে যে জীবনের পরিচয় আছে গোবিন্দদাসে তা নেই। বিদ্যাপতির রাধা পার্থিব নায়িকা বলেই তা জীবন অনুসারী— গোবিন্দদাসের রাধা এ জগতের নয়। এই কারণেই আবার গোবিন্দদাসের পদ অনেক শোভন এবং পরিস্ফুট। গোবিন্দদাসের রাধা লোকজগতের নয় বলেই বিচিত্র নয়; বিদ্যাপতির অভিসারিকা রাধা প্রেমের দেহগত স্তর থেকে ক্রমেই গভীরতা লাভ করায় বিচিত্র, তা সত্ত্বেও বিদ্যাপতির রাধার অভিসার লৌকিক জগতের নায়িকারই অভিসার–বিভিন্ন সময়ে হয়তো তার মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু সে এ জগতের প্রেমাস্পদের জন্যেই অভিসারিকা হয়েছে। “গোবিন্দদাসের রাধার অভিসার মানবাত্মার চিরস্তন অভিসার যাত্রা, এই অভিসারের জন্যে অপেক্ষা করে থাকেন সব দুঃখহর হরি—তিনি সেবা করেন মানবাত্মাকে। গোবিন্দদাসের অভিসার পদের অন্যতম প্রেরণাও তাহাই। অর্থাৎ এক কথায় 'চরৈবেতি’ মন্ত্রের সিদ্ধি প্রতিমার রূপাঙ্কন। তাই গোবিন্দদাসের অভিসার যেন প্রতীক অভিসার, তাহা উৎকৃষ্ট ধর্মগীতি।” বিদ্যাপতির অভিসার ব্যক্তিভাবনা-জাত, গোবিন্দদাসের অভিসার গোষ্ঠীভাবনা সঞ্জাত। বিদ্যাপতির রাধা প্রায়শঃ সচেতন, সতর্ক। গোবিন্দদাসের রাধা সর্বদাই আত্মবিস্মৃত, সমর্পিত। এখানেই বিদ্যাপতি এবং গোবিন্দদাসের বিশেষ পার্থক্য।


এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিদ্যাপতি এবং গোবিন্দদাস উভয়েই বিদগ্ধ, কলাকুশলী এবং লোকাত্তর প্রতিভার অধিকারী। বিদ্যাপতির প্রতি গোবিন্দদাসের যে একটা আকর্ষণ ছিল তা অনুমান করা কঠিন নয়। বিদ্যাপতির ত্রিচরণ পদের চতুর্থপাদ পুরণ করে তিনি পূর্ণাঙ্গ কাব্যরূপে গড়ে তুলেছেন। উভয়ের যুক্ত ভণিতাযুক্ত পদও আছে। কিন্তু যুগের পার্থক্য উভয়ের কাব্যভাবে বিরাট পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। প্রাক্-চৈতন্যযুগের বিদ্যাপতির রাধাকৃষ্ণের সঙ্গে চৈতন্যোত্তর রাধাকৃষ্ণের এক বিরাট পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছিল। রাজসভার কবির সঙ্গে অধ্যাত্ম জগতের ভক্ত কবির পার্থক্য না ঘটাটাই হতো অস্বাভাবিক।


বিদ্যাপতি বৈষ্ণব পদাবলী ছাড়াও রচনা করেছেন শিববিষয়ক পদ, ঐতিহাসিক কাব্য প্রভৃতি। এ থেকে বোধগম্য হয় যে তিনি গোবিন্দদাসের মত বৈষ্ণবভাবে বিভোর থাকতেন না। অন্যদিকে, গোবিন্দদাস বিচিত্র বৈষ্ণব পদ রচনা করেছেন আরাধ্য রসামৃত মাধুরীর বিগ্রহ রাধাকৃষ্ণকে দেখে। গোবিন্দদাসের ব্রজবুলিতে রচিত পদগুলি চৈতন্যোত্তর কালে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হত, সম্ভবত তাকে দ্বিতীয় বিদ্যাপতি বলার অন্যতম কারণও এটা। কিন্তু সর্বত্রই গোবিন্দদাসের স্বকীয়তা প্রকাশিত। যেখানে তিনি বিদ্যাপতির পদের অনুসরণ করেছেন সেখানেও তিনি সৃষ্টি করেছেন। বিদ্যাপতি বলেছেন—

যাহাঁ যাহাঁ পদযুগ ধরই।

তাহা তাহা সরোরুহ ভরই।।


ঐ একই বক্তব্য গোবিন্দদাসের পদে—

যাহাঁ যাহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।

তাহাঁ তাহাঁ বিজুরি চমকময় হোতি৷৷


বক্তব্য এক হলেও গোবিন্দদাসের পদ শ্রেষ্ঠতর, তাঁর চিত্রণও অধিকতর স্পষ্ট—রাধা এখানেও যথেষ্ট গতিশীল।


কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত বৈষ্ণব পদাবলীর ভূমিকায় উভয়ের তুলনা করে বলা হয়েছে—“বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাস দুই জনেই পণ্ডিত কবি—রসশাস্ত্রে ও অলঙ্কার শাস্ত্রে দুজনেরই অসামান্য পাণ্ডিত্য। পার্থক্য এইটুকু যে গোবিন্দদাস রস সম্পর্কে রূপ গোস্বামীর অনুগত এবং বিদ্যাপতি দণ্ডী প্রভৃতির সহিত বাৎস্যায়নেরও অনুগত। দুজনেই প্রকাশভঙ্গি বিভিন্ন—বিদ্যাপতি তরল, গোবিন্দদাস যাস্ত্র।” বিদ্যাপতি অবশ্যই পরবর্তীকালে তরলতা উত্তরণ করেছিলেন। অলংকার প্রয়োগে দুজনেরই বিশেষ ঝোঁক ছিল বটে কিন্তু একই ধরনের অলংকারের দিকে দুজনের দাবি ছিল না। বিদ্যাপতির আমলে মৃদঙ্গের রেওয়াজ ছিল না।” উক্ত ভূমিকায় আরো বলা হয়েছে—“বিদ্যাপতির রাধা চলিয়াছে সহজ হৃদয়ের ধর্মের পথে এবং গোবিন্দদাসের রাধা চলিয়াছেন কঠিন দার্শনিকতার পথে। বিদ্যাপতির রস তরুণ, গোবিন্দদাসের প্রৌঢ়। গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হইলেও দুজন দুই প্রকৃতির। বিদ্যাপতি ভক্ত নহেন, কবি, গোবিন্দদাস যত বড় কবি, ততধিক ভক্ত।”


প্রাক-চৈতন্যযুগের কবি বিদ্যাপতির বৈষ্ণব পদে বৈষ্ণব ভাবনার কোনও চিহ্নই নেই, কিন্তু গোবিন্দদাসের পদে গৌড়ীয় বৈষ্ণবতত্ত্ব তার স্বাভাবিক স্থান অধিকার করে নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরীর বক্তব্য হল—“চৈতন্যজীবন ও চৈতন্য উত্তর বৈষ্ণব সাধনার সমস্ত ঐতিহ্যটিকে স্বীকার করে নিয়ে সেই ঐতিহ্যের প্রতীক রূপেই যেন গোবিন্দদাস কাব্যরচনার ব্রতী হয়েছেন।' ফলে, ভাব-ভাষা চিন্তা উপলব্ধি এবং উপভোগের বিস্তার বৈচিত্র্যভারে তার কবি প্রতিভা হয়ে উঠেছিল পরিপূর্ণ। গোবিন্দদাসের পদাবলীতে ব্যক্তিকবির বাণীকে ছাপিয়ে একটি সমগ্রযুগের যৌথ সাধনা যেন কথা বলে উঠেছে—তার রচনা একটি যুগের সামগ্রিক সাধনা ও উপলব্ধির বাঙ্ময় প্রকাশ। এখানেই গোবিন্দদাস ও ‘বিদ্যাপতির মৌলিক পার্থক্য ৷ বিদ্যাপতির পদে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির মাধ্যমে ব্যক্তিমানসের শৈল্পিক প্রকাশ, আর গোবিন্দদাসের রচনায় বৈষ্ণবতত্ত্বের যুগব্যাপী ও যুগসাধনার সুষমাময় সামগ্রিক অভিব্যক্তি।


বৈষ্ণবভক্ত কবিগণ কান্ত বা মধুরসকে শ্রেষ্ঠ রস বলে মনে করেন। আর এই রসমূর্তির অধিকারী কৃষ্ণকে মনে করেন 'শৃঙ্গার রসরাজময় পূর্ণ মূর্তি। সমগ্র বৈষ্ণব সাহিত্যেই এই মধুর রসেরই জয়গান। মধুর রসকে অবলম্বন করেই বৈষ্ণব পদাবলীর পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, মান, প্রেমবৈচিত্র্য, আক্ষেপানুরাগ, বিরহ, মাথুর, ভাবসম্মিলন প্রভৃতি পর্যায়ের অপূর্ব সব পদাবলী রচিত হয়েছে। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস প্রভৃতি বিখ্যাত পদকর্তা মধুর রসকে কেন্দ্র করেই তাদের কাব্য প্রতিভাকে উজাড় করে দিয়েছেন।