জ্ঞানদাস চণ্ডীদাসের এবং গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির ‘ভাবশিষ্য' হিসেবে পরিচিত। এই পরিচিতির কারণ নির্দেশ করো। প্রসঙ্গত কোন দিক দিয়ে তাঁরা স্বতন্ত্র, তাও স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দাও।

মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদসাহিত্যে যাঁরা শ্রদ্ধার আসনে আরোহন করে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার তাঁরা হলেন চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস ও জ্ঞানদাস। পদাবলী সাহিত্য শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবে ও প্রভাবে পুষ্ট হয়ে গঙ্গার স্রোতের মতো প্লাবিত হয়ে ধর্মতত্ত্ব আর কাব্যসৌন্দর্যের মিলনে অভাবিত বিস্ময়রস সৃষ্টি করেছে। চৈতন্য পরবর্তী যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী কবি হলেন জ্ঞানদাস, আর একজন কবি হলেন গোবিন্দদাস। চৈতন্য উত্তর পর্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদগ্ধ, সৌন্দর্য মুগ্ধ চিত্রধর্মী কবি গোবিন্দদাস। তিনি ভাবকে অপরূপত্বে উত্তীর্ণ করে কাব্যালংকার স্রষ্টারূপে খ্যাত। প্রেমবৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য অপেক্ষা পরিশীলিত মূর্তি নির্মাণে তিনি দক্ষ। আনুমানিক ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে এক ব্রাক্মণ বংশে কবি জ্ঞানদাসের জন্ম। বিখ্যাত 'খেতুরীর উৎসবে' কবি উপস্থিত ছিলেন। কবি জ্ঞানদাস সম্পর্কে এর বেশী কোনও তথ্য পাওয়া যায় না।


জ্ঞানদাস হলেন ভাবের কবি, রোমান্টিক কবি, আক্ষেপানুরাগের কবি, হৃদয় ধর্মের কবি, তিনিই হলেন আস্তর রহস্যের সার্থক রূপকার। জ্ঞানদাসকে চণ্ডীদাসের 'ভাব শিষ্য' বলা হয়ে থাকে। তারও যথেষ্ট কারণ বিদ্যামান— প্রথমত দুজনই বাংলা ভাষায় মরমী শিল্পী। উভয়ের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিকতা ও কাব্যগুণের মিলন লক্ষিত হয়। দ্বিতীয়ত প্রেমের কবি হয়েও উভয়েই প্রেমের আনন্দ অপেক্ষা বেদনা বিরহকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। চণ্ডীদাস প্রেমের বৈরাগ্যময় যে প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন তাতে কবি জ্ঞানদাসও অবতীর্ণ। তিনি সেই পথের যাত্রী উভয়েই রাধিকার প্রেমের অন্তরব্যাপ্ত তীব্রতায় আত্মহারা। তৃতীয়ত জ্ঞানদাস চণ্ডীদাসের মতই সরল ও গভীর। চণ্ডীদাস হৃদয়ধর্মের এবং একান্ত নিবিড় অনুভবের কবি। জ্ঞানদাসও পূর্বরাগ ও আক্ষেপানুরাগ পর্বে প্রেম-রহস্যের অসীমতায় আকুল। প্রসঙ্গক্রমে বলা চলে,পদাবলী সাহিত্যে সহজ প্রাণময়তা, গভীরতার নিরাভরণ প্রকাশে শ্রেষ্ঠ চণ্ডীদাস। কবি জ্ঞানদাস এই একই মানসিকতার কবি। অবশ্য চৈতন্যপূর্ব পর্বের কবি চণ্ডীদাসের রচনায় গৌড়ীয় বৈষ্ণুব তত্ত্ব দর্শনের নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু চৈতন্যোত্তর যুগের স্রষ্টা জ্ঞানদাস বৈব রসতত্ত্ব অনুযায়ী পদ রচনা করেছেন। জ্ঞানদাস চণ্ডীদাসের 'ভাব শিষ্য' হলেও প্রভাব প্রকাশে জ্ঞানদাস অনেক বেশি সচেতন। তাঁর কাব্য প্রতিভা বহুস্থলে আধুনিক যুগকে স্পর্শ করেছে।


কবি গোবিন্দদাস মিথিলার কবি বিদ্যাপতির ‘ভাবশিষ্য' গোবিন্দদাসকে দ্বিতীয় বিদ্যাপতিও বলা হয়। গোবিন্দদাসের রচনা শৈলির মধ্যে মৌলিকতা কম নেই। সেই সঙ্গে তিনি বিদ্যাপতির মার্জিত, রুচিশীল, বৈদগ্ধ্যপ্রাণ কাব্যাদর্শের অনুসারী। দ্বিতীয় গোবিন্দাদাস ভাবের চিত্রিতরূপ সৃষ্টিতে তৎপর। যেমন বিদ্যাপতি। উভয় কবির অভিসার পর্যায়ের পদ সমূহ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তৃতীয়ত বিদ্যাপতির মতো গোবিন্দদাস কাব্য সৌন্দর্যবোধে উদ্বুদ্ধ। উভয় কবি অনুভূতিতে আত্মহারা না হয়ে শিল্পগুণে ও কাব্যগুণের মাধুর্যে বর্ণ বিকাশী হয়ে উঠেছেন। চতুর্থত উভয় কবির সাধারণ বৈশিষ্ট্য আবেগতন্ময়তা অপেক্ষা শব্দে, ছন্দে, চিত্রকল্পে ধ্রুপদীরূপ নির্মাণ করা। পঞ্চমত ভাষার বিচারে গোবিন্দদাস সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাপতি ব্যবহৃত ব্রজবুলি ভাষাকে স্বীকার করেছেন। ষষ্টত বিদ্যাপতি রচিত অসম্পূর্ণরূপে সংগৃহীত কয়েকটি পদ গোবিন্দদাস সম্পূর্ণ করেন। সেই পদগুলিতে উভয়েরই ভণিতা আছে। যেমন—“বিদ্যাপতি কহ নিবারণ মাধব গোবিন্দদাস রসরূপ।”


প্রসঙ্গত বলা যায় জ্ঞানদাস, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, বিদ্যাপতি, স্বতন্ত্র কবি প্রত্যেকে কয়েকটি পদ বিশ্লেষণে তা বুঝে নেওয়া যাক।


বিশিষ্ট প্রকাশ ভঙ্গিমা : সহজ সরল, অকৃত্রিম সজীব প্রাণের নিরাভরণ প্রকাশে কবি চণ্ডীদাস অনন্য ; রাজসভার কবি বিদ্যাপতি ও বাংলার কবি গোবিন্দদাস রূপ-সৌন্দর্য ভাবের রূপকার, আর জ্ঞানদাসের রচনায় গভীর, অকৃত্রিম ভাব আছে, প্রকাশ চাতুর্যও আছে। প্রত্যেক কবিই ভাব ও ভাবের প্রকাশ রীতির মধ্যে নিগূঢ় সামঞ্জস্য সৃষ্টি করতে পারেন।


আক্ষেপানুরাগ ও প্রেমবৈচিত্র্য : চণ্ডীদাসের মত জ্ঞানদাসও আপেক্ষপানুরাগের কবি জ্ঞানদাসের রাধিকা বলেছেন—'সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল। পদটির মধ্যে রাধিকার আক্ষেপের মধ্যে বাংলা সমাজে বন্দিনী নারীর আক্ষেপ মিশে গেছে।


পূর্বরাগ : চণ্ডীদাস পূর্বরাগের শ্রেষ্ঠ কবি হলেও বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস এবং গোবিন্দদাস পূর্বরাগের পদরচনায় নিমগ্ন হয়ে বৈষ্ণব পদকে অসামান্য শিল্প মূর্তি দান করেছেন। বিদ্যাপতির রাধা নবীনা, চঞ্চলা। রাধার কৃশ্বের প্রতি ভাব এমন—

হাথক দরপণ মাথক ফুল।

নয়নক অঞ্জন মুখক তাম্বুল ৷৷


কৃষ্ণ রাধার হাতের দর্পন, মাথার ফুল, নয়নের অঞ্জন, মুখের তাম্বুল, গলার হার। আর জ্ঞানদাসের পূর্বরাগ পদে যৌবনের বনে রাধা পথহারা

রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল

যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।।


পরিশেষে বলতে হয়, চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য জ্ঞানদাস সহজসরল ভাষা ও সুরে রাধার গভীর প্রেম-ভাব ব্যক্ত করেছেন। এই পদটিতে—

“বঁধু তোমার গরবে গরবিনী হাম

রূপসী তোমার রূপে, 

হেন মনে করি ও দুটি চরণ

সদা লৈয়া রাখি বুকে।”


রাধা এখানে সর্বোতভাবে কৃষ্ণে নিবেদিত। তাঁর চরণই রাধিকার একমাত্র আশ্রয়। তথাপি জ্ঞানদাস চণ্ডীদাসের ভাব শিষ্য হয়েও মৌলিক ও স্বতন্ত্র। তাই তাঁর রাধা ‘নিবেদন’ পর্যায়েও আত্মস্বাতন্ত্র্য ও সচেতনতা বিসর্জন দেননি।