রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পে মানুষ ও প্রকৃতি মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। গল্পগুচ্ছের প্রথম খণ্ডের সাহায্যে এই মতামতের সার্থকতা প্রতিপাদন করো। প্রসঙ্গত কবির ছোটোগল্পে গীতিধর্ম কীরূপ প্রাধান্য পেয়েছে বুঝিয়ে দাও।

রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে পদ্মায় বাস করছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে বাংলার গ্রামের সাধারণ মানুষের নিকট পরিচয় ঘটে। এই পর্ব, অর্থাৎ বাংলা ১২৯৮ হতে ১৩১০ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রসৃষ্টি স্বর্ণযুগ। এই কালে রচিত কাব্যগুলি- 'সোনার তরী' থেকে আরম্ভ করে ‘ক্ষণিকা’ পর্যন্ত রবীন্দ্রকবিতা—বিশ্বপ্রেম, সৌন্দর্যাকৃতি, মানবপ্রীতির যুক্ত তারে ঘা দিতে থাকে। এতে যে সংগীতের সৃষ্টি হয়েছে তা অতুলনীয়। সৃষ্টির প্রতি তাঁর একটি অপূর্ব ভালোবাসা, একান্ত শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস এই সময়ের কবি-জীবনের মধ্যে বারবার প্রকাশ পেয়েছে। মনের যখন এই অবস্থা, জীবনের অতি তুচ্ছ খুঁটিনাটি বিষয়গুলিও যখন তাঁর নিকট অপূর্ব বলে মনে হয়েছে, নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ হয়ে যখন তিনি প্রকৃতির অতি তুচ্ছ সামান্য ব্যাপারটিকেও অত্যন্ত রহস্যময় বলে মনে করে আকুল আগ্রহে তা উপভোগ করেছেন, তখন ভাবকল্পনার সেই পরমলগ্নে তাঁর ছোটোগল্প রচনার সূত্রপাত হল। এই পর্বের প্রথম দিকে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছে'র সব গল্পই লেখা।


কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নিকট মানুষ স্বতন্ত্রভাবে মহিমময় নয়। মানুষকে তার বাস্তব জীবন ও সংসারের মধ্যে দেখলে তার সামান্যতা প্রকট হয়ে উঠে মনকে পীড়া দেয়। রবীন্দ্রনাথের বাস্তবতাবিরোধী মন বস্তুসত্যের তীক্ষ্ণতাকে পরিহার করতে চাইত। মানবজীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে কবি পল্লিবাংলা, নিবিড় বর্ষা এবং প্রবহমানা কল্লোলিনী পদ্মার পটভূমিকায় দেখিয়েছেন। প্রকৃতির আলোচ্ছায়ার খেলা তার বস্তুতীক্ষ্ণতাকে ঢেকেছে, রহস্যময় করে তুলেছে, সামান্যকে অসামান্যের মর্যাদা দিয়েছে।


জনৈক বিশিষ্ট সমালোচক লিখেছেন, “সেই প্রকৃতির সঙ্গে পরিপূর্ণ একাত্মবোধ, জীবনের অতি তুচ্ছ ব্যাপারগুলিকেও পরম রমণীয় ও অপূর্ব রহস্যময় বলে অনুভব করিয়া, তাদের প্রতি অপূর্ব শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস, আপনাকে একান্তভাবে নির্লিপ্ত করিয়া জীবনটিকে প্রকৃতির সকল অভিব্যক্তির মধ্য দিয়া উপভোগ করা—সমস্তই তাঁহার ছোটোগল্পগুলির মধ্যেও অপূর্ব রসে অভিষিক্ত হইয়া উঠিয়াছে।”


মানবজীবনের একটি-দুইটি নিগূঢ় উচ্ছ্বাস, সূক্ষ্ম হৃদয়ার্তি গীতিকবিতার মতো ছোটোগল্পেই প্রকাশ পেয়েছে। প্রথমত, মানবজীবন ঘটনার উপরে বেশি জোর না দিয়ে অন্তরের অনির্বাচ্য প্রায় উপলব্ধির একটি ভাবঘন প্রকাশ ; আর দ্বিতীয়ত, মানবপ্রাণ আর প্রকৃতির মধ্যে নিবিড় আত্মীয়তা স্থাপন—এই দুটি কারণে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলি হয়ে উঠেছে একান্তভাবে গীতিধর্মী।


‘গল্পগুচ্ছে’র প্রথম খণ্ডের কয়েকটি গল্পের সাহায্যে কবির এই বৈশিষ্ট্যগুলি প্রমাণ করা চলে। “পোস্টমাস্টার" গল্পটি একান্তভাবে গীতিধর্মী। একটি স্বজনহারা নিঃসহায় গ্রাম্য বালিকার স্নেহলোলুপ হৃদয় আসন্ন স্নেহচ্যুতির আশঙ্কায় এই গল্পটির উপরে এক অশ্রুসজল ছায়াপাত করেছে। রবীন্দ্রনাথের এই গীতিধর্মী গল্পগুলিতে ঘটনার মোটেই প্রাধান্য নেই, যা আছে তাও এত মৃদু, এত উত্তেজনাহীন যে আদৌ উল্লেখযোগ্য নয়। এই জাতীয় গল্পে কবির কল্পলোকের মানুষগুলি, তার ঘটনার আবেষ্টনটি বাইরের চতুর্দিকেরো জগতের সঙ্গে, প্রকৃতির ছায়া আলো গন্ধ বর্ণ ধ্বনি ও ছন্দের সাথে একান্তভাবে মিশে যায়, নিখিল বিশ্বের পারিপার্শ্বিক ভাষাময় আবেষ্টনের সঙ্গে এক হয়ে গিয়ে একটি সুরের জগৎ সৃষ্টি করে। আলোচ্য গল্পটির উপসংহারে পোস্টমাস্টার ও রতনের দুঃখ একটি উদাস সকরুণ পরিসমাপ্তি লাভ করল, এই সেই অব্যক্ত বেদনাটি যেন সমস্ত বিশ্বে পরিব্যাপ্ত হয়ে এক অপূর্ব সৌন্দর্য সৃষ্টি করল।


এই রকম সুরের জগৎ সৃষ্টি হয়েছে তাঁর অনেকগুলি গল্পে। “একরাত্রি” গল্পটিতে সেই যে ঝড়ের রাতে বনের মধ্যে একটি বিচ্ছেদ-ব্যথিত ‘মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়িয়ে অনন্ত আনন্দের আস্বাদন’ লাভ করেছিল, যার সমস্ত ইহজীবনে “কেবল ক্ষণকালের জন্য একটি অনন্ত রাত্রির উদয় হয়েছিল, সেই রাত্রিটি শুধু সেই ভাঙা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারের কাছেই তুচ্ছজীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা” হয়ে রইল না, তার জীবনের সমগ্র ট্র্যাজেডিটুকুও সেই একই রাত্রির একটি সুরের মধ্যে অপূর্ব সার্থকতা লাভ করল।


রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলির মধ্যে মানুষ ও ঘটনার সঙ্গে প্রকৃতির যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের নিবিড় ঐক্যের পরিচয় আছে, সে-পরিচয় অনেক গল্পেই পাওয়া যায়, কিন্তু তা একটি পরিপূর্ণ গীতিকবিতার রূপ ধারণ করেছে ‘সুভা' গল্পের মূক বালিকার সাথে মূক প্রকৃতির নিবিড় ঐক্যসম্বন্ধের মধ্যে।


“সমাপ্তি” গল্পটি অবশ্য ঘটনাপ্রধান। কিন্তু এর মধ্যেও প্রকৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ঔপন্যাসিকসুলভ বিশ্লেষণপটুত্বের সাথে কাব্যসৌন্দর্য-সৃষ্টির সহজ মিলন এই গল্পে খুবই সুন্দরভাবে ঘটানো হয়েছে। দুরন্ত বন্য মৃন্ময়ীর অভাবনীয় আমূল পরিবর্তন, যে অদৃশ্য প্রভাবে তার বালসুলভ চপলতা নিমেষমধ্যে রমণী-প্রকৃতির স্নিগ্ধ সজল গাম্ভীর্যে পরিণত হয়েছে, তার চিত্রটি যেমন কবিত্বপূর্ণ তেমনি মনস্তত্ত্বের দিক দিয়ে অনবদ্য। মৃন্ময়ীর এই পরিবর্তনের মূল কারণ মনস্তাত্ত্বিক সন্দেহ নেই। কিন্তু বহু ঘটনায়, নাটকীয় ঘটনা-সংস্থান তার যে প্রথম চিত্তাবরণ উন্মোচন দেখাতে হত, কবি নদীযাত্রার প্রকৃতির পটভূমিতে একটিমাত্র গীতিকবিতা বর্ণনার সাহায্যে তাকে সরিয়ে নিয়ে এক অভিনব আস্বাদ দান করেছেন।


“ছুটি” একটি বিশিষ্ট গল্প। গ্রামের মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে যে সহজ প্রাণলীলা তা থেকে চ্যুত বালকেরো বেদনাময় পরিণতি এই গল্পে স্থান পেয়েছে ঘটনাবিরলতায়। দুরন্ত ছেলে ফটিক যেন গ্রামপ্রকৃতির নিজের ধন। দৈন্যে, স্নেহে এবং মুক্তিতে তার সহজাত অধিকার। অন্য লেখক হলে মামির গলগ্রহের লাঞ্ছনার উপরে সব জোরটা দিতেন। নিঃসন্দেহে তাই সবচেয়ে বাস্তব। রবীন্দ্রনাথ সেই বাস্তবকে অস্বীকার করেন নি, কিন্তু প্রাধান্য দিয়েছেন প্রকৃতির শ্যামলতার ও আনন্দের জগৎ হতে ফটিকেরো নির্বাসনের বেদনাকে। “বধূ” কবিতার সঙ্গে এর নৈকট্য চোখে পড়বে। 'বধূ' কবিতায় নগরে বালিকার পল্লিকামনার আবেগটুকু মাত্র ব্যক্ত, এখানে ফটিকেরো সেই আবেগ মুক্ত প্রকৃতি সঙ্গে জড়িত হয়ে নামরূপে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে। লক্ষণীয়, উভয় ক্ষেত্রেই প্রকৃতি এবং প্রকৃত স্নেহ সমার্থক হয়ে উঠেছে।


“কাবুলিওয়ালা” রবীন্দ্রনাথর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প। এর মধ্যেও ঘটনাগত উত্থান-পতন বা চরিত্রসৃজনের বিস্ময় কিছু নেই। একজন কাবুলিওয়ালার অন্তরের বিরহকাতর পিতৃস্নেহ একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো গল্পটির মধ্য হতে উত্থিত। সেই স্নেহের মধ্যে যেন নিখিলের কাতরতার সুর বেজেছে। কাবুলিওয়ালার পিতৃহৃদয় বিশ্বমানবের স্নেহকাতর হৃদয়ের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে মুহূর্তেই। এটা সম্ভব হয়েছে কবির গীতিপ্রাণতার গুণে। বিশেষ একটি মানুষের বিশেষ দুঃখ আশ্চর্য কৌশলে, নির্বিশেষে মানববেদনার সুর ধরিয়েছে, এটাই তো গীতিকবিতার কাজ।


'খাতা' গল্পটি যেন একটি গীতিকবিতারই গল্পরূপ। একটি বালিকার গোপন কামনা পিতৃগৃহের দিকে ধাবিত হত। আগমনী, বিজয়ার গানের সুরে কবি তার হৃদয়ভাবটিকে বেঁধে দিয়েছেন। সেই অতৃপ্ত এবং গোপন মাতৃস্নেহলোলুপতা তাঁর গোপন এবং অকিঞ্চিৎকর সাহিত্যচর্চার রূপ ধরে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তার এই হৃদয়টি অস্নেহ এবং বিরূপতার আঘাতে কীরূপে শতচ্ছিন্ন হয়েছিল, তার বর্ণনা গল্পটির সমাপ্তিকে করুণ করে তুলেছে।