বৈষ্ণব পদাবলীকে রোমান্টিক কবিতা হিসাবে বিচার করলে তার ভক্তিধর্মের প্রতি কি অমর্যাদা করা হয়? রোমান্টিকতার কোন্ কোন্ লক্ষণ বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে পরিস্ফুটতা আলোচনা করো।

কল্পনার ঐশ্বর্য, আবেগের গভীরতা, সৌন্দর্যের নিবিড়তা এবং সুদূরের ব্যঞ্জনা রোমান্টিক মনোভাবেরই লক্ষণ। রোমান্টিকতা হল একপ্রকার মানস প্রজাতি। রোমান্টিকতার মূল বৈশিষ্ট্য হল দুর্জ্জেয়ের প্রতি অভিসার, অপ্রাপনীয়ের জন্য ব্যকুলতা। মর্তচেতনা রোমান্টিকতার প্রধান উপাদান হলেও ধর্মানুভূতি ও ভাগবত চেতনাও রোমান্টিক লক্ষণ-যুক্ত হতে পারে। প্রাচীন পৃথিবীর বহু ধর্ম-সাধনায় রোমান্টিক মনোভাব উপস্থিত ছিল। অপ্রাপণীয় ঈশ্বরকে যখন একান্ত আপনার করে পেতে চাই এবং পাবার আকাঙ্ক্ষায় পার্থিব জগতের প্রতি উদাসীন হ'য়ে ভগবৎ প্রাপ্তির সুদুর্গম পথে যাত্রা করি তখনই তো রোমান্টিকতার সৃষ্টি হয়। সুফী সাধকগণ ঈশ্বরকে ‘মাশুক’ (প্রেমিকা) এর নিজেকে ‘আশিক’ (প্রেমিক) রূপে কল্পনা করে থাকেন— এও রোমান্টিক সাধনায় পরিপূর্ণ। চর্যাপদেও রোমান্টিক ধর্মলক্ষণ বর্তমান। অতএব বৈষ্ণুব কবিরা যখন ভগবানকে প্রেমিকরূপে কল্পনা করেছেন তাতে ভক্তিধর্মের ক্ষুণ্ণতা কোথায়? তবে তাঁরা নিজেরা প্রেমিকের ভূমিকা গ্রহণ করেননি। প্রেমিকা স্বয়ং রাধা। নিজেরা সখী বা মঞ্জুরীরূপে দূর থেকে কল্পনানেত্রে এই লীলা প্রত্যক্ষ করেছেন।


বৈষ্ণব পদাবলীর পশ্চাৎপটে একটা আধ্যাত্মিক জগৎ থাকলেও পটভূমিকায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, রাধাকৃষ্ণের নিবিড় মিলন-রস ও তীব্র বেদনায় রূপানুরাগে যে মর্ত্যধূলিধূসরিত এই বাস্তবজগৎকেই যে প্রতিস্থাপন করেছে তা অস্বীকার করার নয়।


“রূপলাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর, 

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।”

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক শশিভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয় বলেছেন—“দ্বাদশ শতকের জয়দেব ব্যতীত অন্যান্য কবিগণ-রচিত রাধা-প্রেমের কবিতা সমসাময়িক পার্থিব প্রেমের কবিতার সহিত সমসূত্রে গ্রথিত ; জয়দেব হইতে আরম্ভ করিয়া পরবর্তীকালের বৈষ্ণব কবিতার সহিত ও ভারতীয় চিরপ্রচলিত পার্থিব প্রেম কবিতার ধারার গভীর মিল রহিয়াছে। ” এখানে অবশ্যই পার্থিব কবিতা বলতে তার রোমান্টিক বৈশিষ্ট্যকেই নির্দেশ করা হয়েছে।


বৈষ্ণব পদাবলীর যে চিরন্তন সাহিত্যমূল্য, তা মূলত এই ধর্মনিরপেক্ষ রোমান্টিকতার জন্য। এর ধর্মীয় এবং দার্শনিক মূল্য তাদের কাছে গৌণ। এ প্রসঙ্গে ড. সুকুমার সেন বলেছেন—“বৈষ্ণব পদাবলীর রসগ্রহণ করিতে গেলে আমাদের বৈশ্বব ভাবাপন্ন হইবার আবশ্যক নাই। মানুষের হৃদয়ের যে প্রকৃতি মৌলিক, সেই ভালোলাগাকে চিরন্তন করিয়া ভালোলাগিবার ইচ্ছা বৈক্ষ্ণব পদাবলীর প্রেরণার উৎস। পুরানো বাংলা সাহিত্যে রোমাণ্টিক কবিতা বলিয়া কিছু থাকিলে তাহা যে বৈষ্ণব পদাবলী, রবীন্দ্রনাথ তাহা নির্দেশ করিয়াছিলেন।” অলৌকিক জগতের কথা থাকলেও রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা আমাদের মনে এক সৌন্দর্যলোকের সন্ধান দেয়। সে প্রেমের আকুলতা পৃথিবীর নায়ক নায়িকার মতই আবেগ মণ্ডিত। তাই বোধ হয় কবিগুরুর প্রশ্ন—

“রাধিকার চিত্তদীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা

চুরি করি লইয়াছ কারমুখ, কার

আঁখি হতে ?”


প্রেম মনস্তত্ত্বের উদ্‌ঘাটনে বৈষ্ণব পদাবলীকারগণ যে অপরূপ অথচ দুর্ত্তেয় উপলব্ধির স্বাক্ষর রেখেছেন, যে নির্দিষ্ট অনুভূতির পরিচয় দিয়েছেন তা এককথায় অভিনব। তাঁহারা লৌকিক নরনারীর জীবনে যে প্রেম দেখিয়েছিলেন তা আলৌকিক রসাবেশে অমর তুলিকায় অঙ্কিত । অধিকাংশ বৈষ্ণুবপদে বিশ্বনিয়ন্তা আনন্দময় পুরুষ প্রবরের বাঁশীর সুরে এক মিষ্টিক চৈতন্যবাণী আমরা ধ্বনিত হতে শুনতে পাই। কবি যখন বলেন—

“জীবনে মরণে   জনমে জনমে

প্রাণনাথ হইয়ো তুমি।” 

অথবা-

“হাথক দরপন মাথক ফুল

নয়নক অঞ্জন মুখক তাম্বুল।”


তখন আমাদের মনে হয় সীমা এবং অসীমের অপরূপ লীলা-রহস্য এইসব পদের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। হৃদয়বেগের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসকে তত্ত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে তাঁরা রোমান্টিক এবং মিষ্টিক রূপের মিলিত প্রকাশ ঘটিয়েছেন।


রোমান্টিক রহস্য-প্রিয়তার মধ্যে মাধুর্য হল অন্যতম লক্ষণ। বৈষ্ণব পদকর্তাগণ তাঁদের কাব্যকে মাধুর্য গুণান্বিত করেছেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে—রাধার জননী রাধাকে প্রশ্ন করেছেন, প্রাণনন্দিনী রাধা কোথায় গিয়েছিল? কেমন সে যেন অমৃত সেচা মুখের বাণী—

মাগো গেণু খেলাবার তাল। 

পথে চলিতে   এক গোয়ালিনী

লইয়া গেল মোরে ঘরে।।

গোপ রাজরানী   নন্দের গৃহিনি

যশোদা তাহার নাম।

তাহার বেটার    রূপের ছটায়

জুড়াইল মোর প্রাণ।।”


পরিশেষে বলতে হয়, রোমান্টিসিজিমের একদিকে রয়েছে নিমগ্ন প্রেম সমাধি অন্যদিকে আছে সর্ববস্তুতে নিজেকে বিকশিত করার বাসনা এবং জড়ের মধ্যে প্রাণের অনুভব৷ তত্ত্বরূপে বিচার করলে বৈষ্ণব কবিতাকে রোমান্টিক আখ্যা দেওয়া যায় না। কিন্তু বৈষ্ণুব কবিতার পদের সঙ্গে রোমান্টিক চেতনার যে বিকাশ ঘটেছে তা অস্বীকার করা যায় না। বৈষ্ণব কবিতাকে যখন সাহিত্যের দর্পণ হিসাবে বিবেচনা করেন তখন তাকে রোমান্টিক গীতিকবিতা রূপে গ্রহণ করা ছাড়া উপায় থাকে না।