‘অতিথি গল্পের গঠনে প্রকৃতির ভূমিকার গুরুত্ব নির্ণয় করো।

তারাপদ নামক এক পনেরো ষোলো বছরের বালককে নিয়ে তার জীবনের আদ্যোপান্ত বর্ণনার মধ্য দিয়ে লেখক যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তার মধ্যে বিশেষ দৃষ্টিনন্দয় ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। প্রকৃতির নিগূঢ় রহস্য উদ্ঘাটনই হল ‘অতিথি’ গল্পের মূল উপজীব্য বিষয়। প্রকৃতিমুগ্ধ লেখক রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসংখ্য গল্পরাজির মধ্যে প্রায় সর্বত্রই প্রকৃতির অপূর্ব সুষমাকে সাহিত্য স্থান দিয়ে চির অমর করার প্রচেষ্টায় রত ছিলেন। তাঁর গল্প পাঠ করে প্রকৃতির যে স্বরূপ আমাদের নিকট ভেসে ওঠে খালি চোখে প্রত্যক্ষ করলে বোধ করি তার কনা মাত্র আবিষ্কার করা আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। 'অতিথি' গল্পের তারাপদের চোখ দিয়ে আমরা যে প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষ করি তা মূলত লেখকের দৃষ্টি নিয়ে দেখা। অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরী লিখেছেন—তারাপদ সেই প্রকৃতি সঙ্গ-তন্ময় কবি আত্মার প্রোজেকশান। রবীন্দ্রনাথের নিসর্গ চেতনা তাঁর কবি আত্মায় এক অলৌকিক সুরের সুরভী সঞ্চার করেছিল। 'অতিথি' গল্পের অপরূপ সুরের আবহ সেই তদাত্ম প্রকৃতি লীনতারই রস প্রতিশ্রুতি। “তাই বলতে হয় রবীন্দ্র ভাবনায় প্রকৃতি কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। প্রকৃতি মানুষের আত্মার দোষর।”


‘অতিথি’ গল্পটি মূলত ভাবকেন্দ্রিক, একটা বিশেষ ভাবকে গল্পের নায়ক তারাপদর জীবনে মৃত করে তোলার জন্যেই রবীন্দ্রনাথ এ গল্পের অবতারণা করেছেন। গল্পের কাহিনি, চরিত্র, প্লট সমস্তর মূলে কিশোর তারাপদর স্বভাব বৈশিষ্ট্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নিসর্গ লোকের নির্লিপ্ততা, নির্বিকারত্ব নিরাসক্ততা এবং নিত্য গতিপ্রবাহ তারাপদর চরিত্র ধ্রুবতারা, ন্যায় উজ্জ্বল। শুধু তাই নয় তারাপদর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। কোনও বন্ধন তারাপদকে বাঁধতে পারেনি—“জন্ম নক্ষত্র তারাপদকে গৃহহীন করিয়া দিয়াছে।" এরই জন্যে সে স্রোতস্বিনীর নদীর ন্যায় দিগ্‌দিগন্তে ধেয়ে গেছে, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রদক্ষিণ করেছে কখনো বিদেশি যাত্রার দলে, কখনো পাঁচালির দলে, কখনো জিমনাস্টিকের দলে ঘুরে বেড়িয়েছে। – “তারাপদ হরিণশিশুর মতো বন্ধন ভীরু।" সে ছিল সংগীত প্রেমী, শুধু তাই নয়—“গাছের ঘন পল্লবের উপর যখন শ্রাবণের বৃষ্টিধারা পড়িত, আকাশে মেঘ ডাকিত, অরণ্যের ভিতরে মাতৃহীন দৈত্যশিশুর ন্যায় বাতাস ক্রন্দন করিতে থাকিত, তখন তাহার চিত্ত যেন উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিত। নিস্তব্ধ দ্বিপ্রহরে বহুদূর আকাশ হইতে চিলের ডাক, বর্ষার সন্ধ্যায় ভেকের কলরব, গভীর পত্রে শৃগালের চিৎকার ধ্বনি সকলই তাকে উতলা করিত।”


অভিনয় ও সঙ্গতের প্রতি আসক্তিবশত বিভিন্ন যাত্রাদলে অংশগ্রহণ করলে বেশিদিন সেই যাত্রাদল তাকে বেঁধে রাখতে পারেনি, আপন চিত্তের অস্থিরতাবশত সে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে মুক্ত বিহঙ্গে ন্যায় দৌড়ে বেড়িয়েছে। এরজন্য সংসারে মা দাদার আত্মীয় পরিজনদের কাছ থেকে ক্যুৎসিত কথা ও লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছে, তথাপি সে থেমে থাকেনি। কেউ কখনো তাকে কোনও বাঁধনে বাঁধতে পারেনি।” অন্যান্য বন্ধনের ন্যায় কোনোপ্রকার অভ্যাস বন্ধনও তাহার মনকে বাধ্য করিতে পারে নাই। সেই এই সংসারের পঙ্কিল জলের উপর দিয়া শুভ্রপক্ষ রাজহংসের মতো সাঁতার দিয়া বেড়াইত। কৌতূহলবশত যতবারই ডুব দিত তাহার পাখা সিক্ত বা মলিন হইতে পারিত না।” এর থেকে বোঝা যায় তারাপদর মালিন্যহীন বন্ধনমুক্ত জীবন এক সত্য-সুন্দরের আলোয় উদ্ভাসিত। বাহর পরে তার সংগে সংসারের ঘনিষ্ঠ পরিচয় হলেও প্রকৃতির সূচিশুভ্র আহ্বানে সে পথে নেমেছে, স্বভাবজাত কৌতূহলবশত অজানা কোনও নিগূঢ় রহস্য-কে আবিষ্কারের জন্য উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে।


‘অতিথি’ গল্পের পটভূমি বিশ্লেষণে বারে বারে এসেছে নদীর প্রসঙ্গ, তারাপদর কর্মক্রিয়া চলন-বলন সমস্তই যেন নদীর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। লেখক কেন এই ভাবধারা অবলম্বন করলেন। এই উত্তরে বলা যেতে পারে নদী তার দুকুলপ্পাবী জল ধারার মধ্য দিয়ে যেমন নানা রকম আবর্জনা ভাসিয়ে দিয়ে গিয়ে সারা ধরিত্রীকে কলুস মুক্ত করে তোলে, ঠিক অনুরূপ, তারাপদ তার প্রকৃতি প্রেমের মধ্য দিয়ে সংসারের স্থবির, জড়তা বিষাদ শোক গ্লানি তাপ সমস্তই তার সংসার ত্যাগের মধ্য দিয়ে বিমুক্ত করে এক সুস্থ সাবলীল মুক্ত জীবনের সন্ধান দেয়। নির্বিকার চিত্তে তারাপদ যখন সমাজ-সংসারকে অবহেলা করে প্রকৃতির টানে ছুটে চলে তখন আর যাই হোক আমাদের মনে এই বন্ধন ছেঁড়ার সাড়া জাগে, সেখানে কোনও স্থিরতা নেই শুধু চলা আর চলা। আর এই চলার মধ্যে জীবনের আসল স্বরূপ ফুটে ওঠে। তাই তো পদ্মায় বোটের উপর জমিদারপত্নী অন্নপূর্ণার সঙ্গে সামান্য কথোপকথন সেরে প্রকৃতির অপূর্ব শোভা প্রত্যক্ষ করে—“...বর্ষা নদী পরিপূর্ণতার শেষ রেখা পর্যন্ত আপস আত্মহারা উদ্দাম চাঞ্চল্যে প্রকৃতি মাতাকে যেন উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিয়াছে, মেঘ নিমুক্ত রৌদ্রে নদীতীরের অর্ধ নিমগ্ন কাশ তৃণশ্রেণি এবং তাহার ঊর্ধ্বে সরস সঘন ইক্ষুক্ষেত্র এবং তাহার পরপ্রান্তে দূর দিগন্ত চুম্বিত নীলঞ্জন বনরেখা সমস্তই যেন কোনও এক রূপকথার সোনার কাঠির স্পর্শে জাগ্রত নবীন সৌন্দর্যের মতো নির্বাক নীলাকাশের মধ্যে দৃষ্টির সম্মুখে পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছিল।" তারাপদর এই স্নিগ্ধ দৃষ্টি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে প্রত্যক্ষ করে ক্ষান্ত থাকেনি, প্রকৃতির প্রতি একটা গভীর আকর্ষণ বোধের জন্ম দিয়াছিল।


প্রকৃতির নয়নাভিরাম স্বপ্নময় জগতে তারাপদ সর্বদা বিচরণ করলেও লোকালয়ের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো সম্পর্কে সে ছিল একেবারেই উদাসীন। কাঠালিয়ার জমিদার মাখনবাবু যখন সস্ত্রীক তাদের একমাত্র কন্যা চারু শশীকে তারাপদর রূপে গুণে মুগ্ধ হয়ে তারই হাতে অর্পণ করতে বদ্ধপরিকর ঠিক তখনই তারাপদর অন্তরে জেগে ওঠে বন্ধন ছেঁড়ার ডাক। চারুশশীর বান্ধবী সোনামণির সঙ্গে তারাপদ মাখামাখি, হাসাহাসি দেখে চারুশশী কেমন ঈর্ষা অনুভব করে ক্রুদ্ধ হলে, সেই সাংসারিক আবেগ-উত্তাপ, দ্বন্দ্ব মধ্যে অনুপ্রবেশ না করে তারাপদ এক অবিচল উদাসীনতায় সমস্তকে ভরে দেয়। এবং চারুশশীর স্নেহ মিশ্রিত পীড়নকে হাসিমুখে বরণ করে নেয়। কারণ—“তারাপদ এই অনন্ত নীলম্বর বাহী বিশ্বপ্রবাহের একটি আনন্দ উজ্জ্বল তরঙ্গ ভূত ভবিষ্যতের সহিত তাহার কোনও বন্ধন নাই।” তাই তো সে—নিত্য সচলা প্রকৃতির মতো সর্বদাই নিশ্চিন্ত উদাসীন থাকত।


মতিলালবাবু যখন তারাপদকে বিবাহ বন্ধনে বাঁধতে সম্পূর্ণ তৈরি, চারু যখন মোহিনী মায়ার দ্বারা তারাপদর অন্তরে অনুপ্রবেশের পথ খুঁজছে, জমিদারপত্নী তার স্বভাবজাত স্নেহে অপু এক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার তাগিদে তারাপদকে মনেপ্রাণে পুত্রস্নেহে ভালোবেসে কাছে ডেকে নিতে এগিয়ে আসে ঠিক তখনি তারাপদর অন্তরাত্মার বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে রথযাত্রা উপলক্ষ্যে কলহাস্যময় উৎসুক্য সৃষ্টিকারী চলমান মানবজীবনের অনন্ত উদ্দীপনা। পূর্ব আকাশের ঘনকালো মেঘ, আচ্ছন্ন চাঁদ ও প্রকৃতির অনন্ত মেলবন্ধন, পুঞ্জীভূত অন্ধকার, ঝিল্লিধ্বনি, তাকে মুগ্ধ বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দিল। তাই স্নেহ প্রেম বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্র বন্ধন' অস্বীকার করে আসক্তিহীনতায় উদাসীন জননী বিশ্ব পৃথিবীর নিকট’ চলে গেল। প্রকৃতি ও ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদ এই জন্যেই একই মহিমায় ভূষিত। অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে অমূলক মন্তব্য করেছেন—“রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় এক নিত্যকালের বালক বীর আছে যে চিরযাত্রিক, সে প্রকৃতির প্রাণসত্তার প্রতীক, প্রতিটি ঋতু যার ‘নবীন রক্তে জাগায় চঞ্চলতা, বলে চল্‌ চল্, অশ্ব তোমার আনহে? এই প্রকৃতির প্রাণকে এই Spirit of Nature-কে কখনো জোর করে ধরে রাখা যায় না; স্নেহ শাসন প্রেম বোধ কেউ তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। 'বসন্তের যাত্রা চলে অনন্তের পানে। এই সত্তার মানব রূপ ‘অতিথি' গল্পের তারাপদ।"


‘অতিথি’ গল্পের নায়ক তারাপদর দ্বারা কেবলমাত্র প্রকৃতির আসল স্বরূপ ব্যঙ্গিত হয়েছে একথা সম্পূর্ণ রূপে বলা যায় না। গল্পের নেপথ্যে লেখক রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি তন্ময়তা যে বারে বারে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তা মেনে নিতেই হয়। সমস্ত গল্পের এক তৃতীয়াংশে প্রকৃতির অবস্থান লক্ষিত হয়। কিন্তু এই প্রকৃতি অনেক সময় তারাপদর অনুপস্থিতিতে মুখ্য হয়ে উঠেছিল—তা মূলত লেখকের মানস তাগিদে। গল্পের প্রেক্ষাপটে প্রকৃতির কায়া নির্মাণে পাই—রৌদ্র বৃষ্টি-বর্ষার আকাশ, নদীস্রোত, নদীতীরবর্তী শরবন, ছায়াবেষ্টিত গ্রাম, শস্যের খেত অপূর্ব বর্ণনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। তবে প্রকৃতির যে অমোঘ টান তার স্বরূপ প্রত্যক্ষ কবি–চারুশশী, মতিলালবাবু, ও অন্নপূর্ণার সাংসারিক বন্ধন যখন চিৎকার করে ওঠে 'যেতে নাহি দিব' ঠিক তখন সমস্ত কাতর আহ্বান উপেক্ষা করে তারাপদর নিরুদ্দেশ যাত্রা আমাদের ক্ষণিক ব্যথিত করলেও প্রকৃতির নির্মম আকর্ষণ সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞাত কিছু থাকে না। তাই তো 'অতিথি' গল্পের প্রকৃতি চেতনা এতই উপভোগ যে, রবীন্দ্রনাথের আর পাঁচটি ছোটোগল্পের থেকে এটি স্বতন্ত্রের দাবিদার। বাংলা সাহিত্যের ছোটোগল্পের ইতিহাসে এই অতিথি গল্পটি এক অনন্য সৃষ্টি তা গভীর আগ্রহে মেনে নিতে হয়।