ভাবোল্লাস পর্যায়ের পদগুলির কাব্যগুণ বিচার করো। এই প্রসঙ্গে ভাবোল্লাস পর্যায়টির পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

ভাবোল্লান ও ভাবসম্মিলন পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবির কাব্য প্রতিভা

বৈষ্ণবশাস্ত্রে শৃঙ্গাররসের প্রধান দুটি বিভাগ— একটি বিপ্রলম্ভ ও অপরটি সম্ভোগ। বিপ্রলব্ধের চারটি স্তরের পর সম্ভোগ' এবং সম্ভোগজনিত ভাবোল্লাস। সম্ভোগের সংজ্ঞা নিম্নরূপ —

“দর্শনালিঙ্গনাদী নামানুকূল্যান্নিষেবয়া।

যুনোরুল্লাস সমারোহন্ ভাবঃসম্ভোগ ঈষ্যতে।।”


দর্শন ও আলিঙ্গনাদির আনুকুল্যহেতু নায়ক-নায়িকার যে ভাবোল্লাস তারই নাম সম্ভোগ। মুখ্য ও গৌণভেদে ঐ সম্ভোগ দু'প্রকার। সংকীর্ণ, সম্পন্ন ও সমৃদ্ধিবান এই তিন প্রকার মিলন গৌণ সম্ভোগ নামে অভিহিত।


কৃষ্ণ কংস দমন করবার জন্য মথুরায় গেলেন; আর ফেরেন নি। অতএব শ্রীরাধিকার সঙ্গে কৃষ্ণের আর মিলন সম্ভব নয়। কিন্তু বৈষ্ণব কবিগণ বিরহিণী রাধিকাকে মিলিত করেছেন ভাব জগতে – তাই ভাবসম্মিলন বলা হয় এই সম্ভোগের পদকে। বৈষ্ণবীয় রসশাস্ত্রে ভাবোল্লাসের কোনও উল্লেখ না থাকলেও পদকল্পতরুর চতুর্থ শাখার দ্বাদশ পল্লবে যে সকল পদ সংকলিত করা হয়েছে, তাদের ভাবোল্লাসের পদ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মাথুরের বিরহ বৈষ্ণব কবিদের আচ্ছন্ন করেছে। তাই তারা এই বিরহকে অস্বীকার করে কাল্পনিক মিলনের পদ রচনা করেছেন। রাধা কল্পনায় কৃষ্ণের সঙ্গ সুখ অনুভব করেছেন। এই ধরনের পদেই মিলনজনিত ভাবোল্লাস বর্ণিত আছে। অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “ভাব-সম্মিলনের পদগুলির আবেগের নিষ্ঠা ও রসের বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কারণ এই পদসমূহে বিরহ ও মিলনের রস একসঙ্গে পরিবেশিত হয়েছে। কৃষ্ণের মথুরা গমনের পর রাধা আর কৃষ্ণের পুনরায় মিলন হয় নাই বটে, কিন্তু বৈষ্ণব কবিগণ এই বিরহের হাহাকারে কেমন করিয়া সমাপ্তির রেখা টানিবেন? তাই তাঁরা ভাব সম্মিলনের ও ভাবোল্লাস পর্যায়ের এক পৃথক পরিকল্পনা করিয়াছেন। ভাবলোকে মনোজগতে কল্পনার আকাশে শ্রীরাধা কৃষ্ণসঙ্গ লাভ করিয়া মনে করিতেছেন, যেন কৃষ্ণ সত্যই দীর্ঘ বিরহের ব্যবধানের পর তাঁহাকে গ্রহণ করিতে আসিতেছেন—চারিদিকে তাহারই শুভ সূচনা। কিন্তু কৃষ্ণ তো মথুরা হইতে ফিরেন নাই...... পদকর্তা এ নির্মমতা সহ্য করিবেন কি করিয়া? তাই এই পর্যায়ের পদে রাধাকৃষ্ণের কাল্পনিক চিত্র আঁকিয়া তাঁহারা লীলারসের উপসংহার করিয়াছেন।”


অতএব দেখা যাচ্ছে যা ভাবোল্লাস তাই ভাবসম্মিলন। এটি নায়ক নায়িকার মিলনের বা সম্ভোগের একটি ভাব—এটি বাস্তব নয়—কারণ মাথুরের পদে যে বিরহ সেই বিরহের অবসান বাস্তবে হয় নি–কৃষ্ণ আর ফিরে আসেন নি। বৈষ্ণব শাস্ত্রে যে সমৃদ্ধিমান সম্ভোগের কথা বলা হয়েছে তা এই ভাবসম্মিলনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। সমৃদ্ধিমান সম্ভোগের কথা বলা হয়েছে তা এই ভাবসম্মিলনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। সমৃদ্ধিমান সম্ভোগের একটি বিশিষ্ট লক্ষণ এই যে নায়িকা এখানে সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু রাধা পরকীয়া। তাই তাঁর পক্ষে পূর্ণ স্বতন্ত্রতা সম্ভবপর নয়। এই কারণে বৃন্দাবন লীলায় সমৃদ্ধিমান সম্ভোগ কল্পনা করা কঠিন৷ পরকীয়াকে স্বকীয়া ক'রে তবেই সমৃদ্ধিমান সম্ভোগ দেখানো সম্ভব। অতএব পদাবলী সাহিত্যে যা সম্ভোগ তাকেই ভাবোল্লাস বা ভাবসম্মিলন রূপে অভিহিত করা হয়। এ প্রসঙ্গে কালিদাস রায়ের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য : “বৈষ্ণব কবিগণ রাধাকৃষ্ণের যে নিত্য মিলনের কথা বলিয়াছেন তাহা বৃন্দাবনের রূপলোকে নয়, তাহা কোনও কুঞ্জে নয়, তাহা ভাবলোকে। মহাভাবই বৃন্দাবন লীলায় রূপের মাঝারে অঙ্গ লাভ করিল–সে রূপ আবার ভাবের মাঝারে ছাড়া পাইল। ইহাই ভাব সম্মেলনের মূল কথা…"


এই মহাভাবস্বরূপা রাধা ঠাকুরাণীর ভাবমিলন কাল্পনিক। রাধা তো কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। সেই শক্তি শক্তিমানের সঙ্গে মিলিত হতে চায়। হৃদয়ের বস্তু হৃদয়ে ফিরে পাওয়াই ভাব সম্মেলনের পরম ও চরম সার্থকতা। রাধাকৃষ্ণ এক অথচ এক নয়; ভেদ আছে আবার অভেদও আছে। প্রজ্জ্বলিত কান্ঠের অগ্নির সঙ্গে কান্ঠের যেমন ভেদ রাধাকৃষ্ণের সেইরূপ ভেদ, আবার অগ্নির অবস্থান কাষ্ঠ ছাড়া সম্ভব নয়। তাই অগ্নি ছাড়া প্রজ্জ্বলিত কাষ্ঠের অস্তিত্ব কল্পনা করা কঠিন। সেইরূপ ভেদ ও অভেদের এই তত্ত্বকে অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্ব নামে অভিহিত করা হয়।


বিদ্যাপতি : বিদ্যাপতি প্রায় সকল রসপর্যায় অবলম্বন ক'রে পদ রচনা করেছেন। তবে ভাবসম্মিলনের পদে যে বিচিত্র অনুভূতির কথা প্রকাশ করেছেন তা অনুভব করলে বিস্মিত হতে হয়। এই জন্যই মহাপ্রভু তাঁর কাব্য আস্বাদন ক’রে আবিষ্ট হতেন। এই পর্যায়ের পদে বিদ্যাপতি তুলনারহিত। বিরহের পদ রচনা করলেও মিলনের পদেই যেন বিদ্যাপতিকে প্রকৃতভাবে আমরা পাই। এই মিলন ‘বাস্তব মিলনই হোক আর ভাব সম্মিলনই হোক। কৃষ্ণ আসবেন দূতীর মুখে তা শ্রবণ ক’রে রাধা আনন্দ প্রকাশ করেন—

পিয়া যব আওব এ মঝু গেহে। 

মঙ্গল যতই করব নিজ দেহে।।


স্বদেহকে আরাধ্য দেবতার অধিষ্ঠান-ভূমি কল্পনার মধ্যে উচ্চাঙ্গের আধ্যাত্মিক কবি কল্পনা প্রকাশিত। তারপর প্রিয়কে পাওয়ার আনন্দ

আজু রজনী হাম   ভাগে পোহায়লু

পেখলু পিয়া মুখচন্দা।

জীবন যৌবন   সফল করি মানলু

দশদিশ ভেল নিরদন্দা।।


আজ আর তাঁর জীবনে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। কোনও সংশয় নেই। আজ তাকে মিলনের মধ্যেও প্রতি মুহূর্তে বিরহের ভয়ে যন্ত্রণাবিদ্ধ হতে হবে না। এই ভাবমিলনই যে প্রকৃত মিলন— এই মিলনের মধ্যেই তার দেহ সার্থক —

আজু মঝু দেহ  গেহ করি মানলু

আজু মঝু দেহ ভেল দেহা।

আজু বিহি মোহে    অনুকূল হোয়ল

টুটল সবই সন্দেহা।।


জাগতিক মিলনে আছে হৃদয় যন্ত্রণা। প্রকৃতির বুকে ঋতুচক্রের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে জাগে আবেগের প্লাবন। বসন্তকালে বিমল জ্যোৎস্না ধারায় কোকিলের কুহতানে দেহ মন প্রিয়-মিলনের জন্য অধীর হয়ে ওঠে, সেই সময় প্রিয়কে না পাওয়া গেলে হৃদয় কাঁদতে থাকে। কিন্তু এখন ভাবমিলনের পর্যায়ে সে ভয় আর নেই—

সোই কোকিল অব    লাখ লাখ ডাউক

লাখ উদয় করুচন্দা।

পাঁচবাণ অব    লাখবাণ হোউ

মলয় পবন বহু মন্দা।।


রাধা ভাবসম্মিলনের মধ্যেই চিরশান্তি খুঁজে পেয়েছেন। তাই সখাকে আনন্দ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলছেন—

কি কহব রে সখি আনন্দ ওর।

চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।


চণ্ডীদাস আক্ষেপানুরাগের পদে অপরাজেয়, কিন্তু ভাবসম্মেলনের আন্তরিকতা আরও সুস্পষ্ট রূপে প্রকাশিত হয়েছে। জীবনভোর রাধিকা কৃষ্ণ সম্মেলনে কাটিয়েছেন তবুও তিনি বলেন— ‘জীবনে মরনে জনমে জনমে প্রাণনাথ হৈও তুমি'—তখন আর বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। বিদ্যাপতির ভাব চণ্ডীদাসের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যায়৷


(এখন)

কোকিল আসিয়া করুক গান।

ভ্রমরা ধরুক তাহার তান ।।

মলয় পবন বহুক মন্দ।

গগনে উদয় হউক চন্দ।।

চণ্ডীদাসের রাধা বলেন,

বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে।

দেখা না হইত পরাণ গেলে।। 

দুখিনীর দিন দুখেতে গেল।

মথুরানগরে ছিলে তো ভাল।। 

এসব দুখ কিছু না গনি। 

তোমার কুশলে কুশল জানি।।


আমিত্বের এমন সম্পূর্ণ লোপ চণ্ডীদাসের রাধায় সম্ভব। ভাব সম্মেলনের আনন্দে রাধার আমিত্ব লুপ্ত হয়ে সকল কিছুই কৃষ্ণে সমর্পিত হয়ে গেছে।