কিরণলেখা চরিত্রের সার্থকতা লেখো।

কিরণলেখা সুন্দর নাম। রোমান্টিক কাব্যের নায়িকাদের যেমন হওয়া উচিত। পাড়াগাঁয়ে সেকেলে-কিরণলেখা-নামকরণ রোমান্টিক কল্পনারই ফল। কিরণশশী হতে পারত। আসলে রবীন্দ্রনাথের কবিসুলভ মোহ এই নামকরণের দেহ ছুঁয়ে আছে বলে আমার বিশ্বাস। রবীন্দ্রনাথকৃত কিরণলেখার বর্ণনা :- ‘সন্তোষগুণটি মানুষের মহৎ গুণ। কিন্তু স্ত্রীর স্বভাবে এই মহৎ গুণটি তাহাকে (বনোয়ারিকে) পীড়া দেয়। তাহার স্ত্রী তো তাহাকে কেবল মাত্র সন্তুষ্ট করে নাই, অভিভূত করিয়াছে...। তাহার স্ত্রীকে তো বিশেষ কোনো চেষ্টা করিতে হয় না—যৌবনের লাবণ্য আপনি উচ্ছলিয়া পড়ে, সেবার নৈপুণ্য আপনি প্রকাশ হইতে থাকে?


অথবা/আবার : ‘কিরণলেখা তরুচ্ছায়ার মধ্যে পথহারা রশ্মিরেখাটুকুর মতো ছোটো, ছোটো বলিয়াই সে তাহার স্বামীর মনে ভারি একটা দরদ জাগাইয়া রাখিয়াছে ; এই স্ত্রীকে বসনে ভূষণে নানারকম ভাবে সাজাইয়া দেখিতে তাহার বড়ো আগ্রহ। তাহা ভোগ করিবার আনন্দ নহে, তাহা রচনা করিবার আনন্দ ; তাহা এককে বহু করিবার আনন্দ, কিরণলেখাকে নানা বর্ণে নানা আবরণে নানারকম করিয়া দেখিবার আনন্দ।'


ভোগ করার আনন্দ নয়, রচনা করার আনন্দ—একটি সাধারণ গ্রাম্য, মাঝারি মেধার যুবতী, অবশ্যই সুন্দরী—তাকে বনোয়ারি কালিদাস-অমরুশতকের কাব্যজগৎ থেকে আহরণ করে আনতে চায়, সাধারণকে অসাধারণ করে দেখতে চায়। সুতরাং মোহভঙ্গ হলেই বিপদ, বাস্তবের কণ্টকক্ষেত্রে পতন ঘটলেই তার আসল পরিচয় পড়ে নিতে অসুবিধা হবেনা। কিন্তু তখন সেই রোমান্টিক হৃদয়টির দশা কি হবে?


কিরণলেখা স্বামীর মধুকৈবর্তের পক্ষ-নেওয়া স্বাভাবিক বলে মনে করেনি। সে তো কল্পলোকে বাস করেনা। সে নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম নিয়ে থাকে। শ্বশুর-শাশুড়ি স্বামী দেওর ননদ ঝি-চাকর-পরিবৃত সংসারে সে বহাল ভবিষ্যতে গৃহধর্ম পালন করে সুখী।


এর ওপর : 'স্বামীর কাছ হইতে কোনোদিন সে কোনো বিশেষ ক্ষমতার পরিচয় পাইবার জন্য উৎত্সুক নহে। পরিবারের গৌরবেই তাহার স্বামীর গৌরব। তাহার স্বামী শ্বশুরের বড়ো ছেলে, ইহার চেয়ে তাহাকে যে আরও বড়ো হইতে হইবে, এমন কথা তাহার মনেও হয় নাই। ইঁহারা যে গোঁসাইগঞ্জের সুবিখ্যাত হালদারবংশ!'


ফলে স্বাভাবিকভাবেই শ্বশুরের পক্ষ ছেড়ে স্বামীর পক্ষে যোগ দেওয়ার কোনো কারণ সে খুঁজে পায়নি। স্বামীর হালদারপরিবারে যে অবস্থান তা তার জানা। কাজেই‌ বনোয়ারি 'মধুকৈবর্তকে আমি রক্ষা করিব' বলে ঘোষণা করলে সে সন্দেহ প্রকাশ করে স্বামীকে বলেছে—'শোনো একবার ! তুমি তাহাকে বাঁচাইবে কেমন করিয়া! দোর্দণ্ড প্রতাপ শ্বশুর মনোহরলালের শক্তি এবং তাঁর অনুচর নীলকণ্ঠের কূটবুদ্ধি ডিঙিয়ে কোনো অসাধ্যসাধন করা যে বনোয়ারিলালের পক্ষে অসম্ভব তা কিরণ ভালোভাবেই জানে। অর্থাৎ তার প্রখর বাস্তববুদ্ধি এবং বাস্তবকে মেনে নেওয়ার সহজ প্রবণতা বনোয়ারিলালের চেয়ে অনেক বেশি।


কিরণ নিজে সন্তানহীনা, ফলে বংশীর শিশুসন্তান হরিদাসকে সে স্বাভাবিক মাতৃত্বের গূঢ় এষণায় আঁকড়ে থাকতে চেয়েছে। সহজাত প্রবণতায় শ্বশুরের বিপক্ষীয় নিজের স্বামীকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে। এইরকমই তার স্বভাব, খুব স্বাভাবিক। বনোয়ারি স্ত্রীর বন্ধ্যাত্বের কারণে নীলকণ্ঠের প্ররোচনায় দ্বিতীয় পত্নী গ্রহণ করতে অসম্মতি জানালে কিরণলেখা এই সহজ প্রবণতার বশবর্তী হয়েই স্বামীর বদান্যতায় মুগ্ধ হতে পারেনি। বরং ‘বনোয়ারি যে তাহার বংশের কথা ভাবিল না, ইহাতে অতি গোপনে কিরণের মনে বনোয়ারির পৌরুষের প্রতি একটু অশ্রদ্ধাই হইয়াছিল। বড়ো ঘরের দাবি কি সামান্য দাবি। তাহার যে নিষ্ঠুর হইবার অধিকার আছে।


হালদারপরিবারের একমাত্র বংশধর হরিদাস নিঃসন্তান কিরণের একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠে। ‘বনোয়ারি স্পষ্টই বুঝতে পারিল, এতদিন পরে কিরণ এমন একটা কিছু পাইয়াছে যাহা তাহার হৃদয়কে সত্যসত্যই পূর্ণ করিতে পারে। বনোয়ারি যেন তাহার স্ত্রীর হৃদয় হর্মের একজন ভাড়াটে….'


সেই এমন ‘একটা কিছু’ যখন পিতামহের সমস্ত সম্পত্তির অধিকার পেল, তখনও কিরণ তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে পেল না। স্বামীর প্রতি তার উক্তি : ‘ওমা! সে কী কথা! এ তো তোমারই বাপের বিষয়, আর হরিদাস তো তোমারই আপন ছেলে তুল্য। ওকে বিষয় লিখিয়া দেওয়া হইয়াছে বলিয়া তুমি রাগ কর কেন!'


এই কিরণের কাছ থেকেই চরম আঘাত এসেছে গল্পের উপান্তে। রুমালে বাঁধা দলিলের কাগজগুলো হারিয়ে আবার হরিদাসের হাত হয়ে ফিরে আসার পরে বনোয়ারি যখন আনন্দে হরিদাসকে কাঁধে তুলে অন্তঃপুরে প্রবেশ করল তখন ‘বনোয়ারির কাঁধের পর হরিদাসকে দেখিয়া সে (কিরণ) উদ্‌বিগ্ন হইয়া বলিয়া উঠিল, নামাইয়া দাও, নামাইয়া দাও—–উহাকে তুমি ফেলিয়া দিবে ।–তৎক্ষণাৎ বনোয়ারির ভ্রমের স্বর্গ ভেঙে ধূলিসাৎ হয়ে গেল, ভাইপোর হাতে বাঘের মুখ আঁকা রুমাল এবং স্ত্রীর হাতে দলিলপত্রের কাগজগুলো দিয়ে সে নিষ্কৃতি পেল, এতদিন পরে নিজেকে আবিষ্কার করল, কিরণলেখাকেও চিনতে পারল——সেই তন্বী এখন তো তন্বী নাই, কখন মোটা হইয়াছে...। এতদিনে হালদারগোষ্ঠীর বড়োবউয়ের উপযুক্ত চেহারা তাহার ভরিয়া উঠিয়াছে।'


এই বড়োবউয়ের চেহারা কিরণের মধ্যে বরাবরই বিদ্যমান ছিল, তা ক্রমশ পরিণত হয়েছে, বনোয়ারির চোখে মোহের অঞ্জন মাখানো ছিল, সে দেখতে এবং চিনতে পারেনি।