'ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে গল্প কথকের মুখ দিয়ে যে অতিপ্রাকৃতের চিত্র বর্ণিত হয়েছে, তা উদ্ধৃতি সহযোগে আলোচনা করো।

অতিপ্রাকৃতি তথা ভৌতিক পরিবেশে রচিত গল্প উপন্যাসে বাংলা সাহিত্যের তেমন বিশেষ দর্শিত হয় না। তথাপি হাতে গোনা যে কয়টি পাওয়া যায় তার বিশেষত্ব পাশ্চাত্য সাহিত্যে অপেক্ষায় কম চিত্তাকর্ষক হয়। বাংলা ছোটোগল্পের পথিকৃত ও জনক রবীন্দ্রনাথ এই বিষয়ে কয়েকটি ছোটোগল্প রচনা করে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রয়েছেন। এদের মধ্যে অন্যতম তাঁর ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে সমুন্নত। গল্পটি গল্পের ছলে অভিব্যক্ত হয়ে প্রাচীন কুহেলীকাচ্ছন্ন এক জাগানো পরিবেশকে উদ্ঘাটন করেছে। যা কিছু অতীত তা কেমলমাত্র পুরানো এবং বিস্মৃত প্রায় যে নয় তার বিশেষ প্রমাণ মেলে এই ক্ষুধিত পাষাণ গল্পে। অর্থাৎ গল্পের মধ্যে যে একটি শাশ্বত সত্য প্রকট সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ।


গল্পের শুরুতেই লেখক জানাচ্ছেন, 'আমি এবং আমার আত্মীয় পূজার ছুটিতে দেশভ্রমণ সারিয়া কলকাতায় ফিরিয়া আসিতেছিলাম, এমন সময় রেলগাড়িতে সেই বাবুটির সঙ্গে দেখা।” তার বেশ ভূষা দেখে পশ্চিম দেশীয় মুসলমান বলে মনে হলেও কথাবার্তা শুনে এদেশীয় বলে মনে হয়, পৃথিবীর প্রায় অনেক ভাষাই তিনি আয়ত্ত করেছেন। লোকটি যেমন বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলেন তিনি আয়ত্ত করেছেন। লোকটি যেমন বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলেন তেমনি বেদ সম্পর্কে ও আলোচনা করতে বিব্রত করেন না। জংশনে উভয়ের নামতে হল গাড়ি বদলের অছিলায়। স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বিশ্রাম কালীন সেই অপরিচিত বাবুটি শুরু করেছিল তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্জাত গল্প, যে গল্পের মধ্যে ছিল চরম রুদ্ধশ্বাস আর শিহরণ জাগানো বিস্ময়।


বরীচ নামক এক পাহাড়ী অঞ্জনের অদূরেই বয়ে চলেছে শুস্তা নদী। জায়গাটি বিশেষ মনোরম ও চিত্তাকর্ষক। এই সূত্রে বোধ হয় দ্বিতীয় শা-মামুদ ভোগবিলাসের জন্য এখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, তা প্রায় আড়াই শত বৎসর পূর্বের কতা। “তথা ইহাতে স্নানশালার ফোয়ারার মুখ হইতে গোপালগঞ্জী জলধারা উৎক্ষিপ্ত হইতে থাকিত এবং সেই শীকর শীতল নিভৃত গৃহের মধ্যে মর্মর খচিত স্নিগ্ধ শিলামনে বসিয়া কোমল নগ্ন পদপল্লব জলাশয়ের নির্মল জলরাশির মধ্যে প্রসারিত করিয়া তরুণী পারসিক রমণীগণ স্নানের পূর্বে কেশ মুক্ত করিয়া দিয়া সেতার কোলে দ্রাক্ষাবন্তের গজল গান করিত।”


কিন্তু মহাকালের করালগ্রাসে এ সমস্তই বিপুল্প প্রায়, কেবল সুউচ্চ প্রাসাদটি ভগ্ন দেহে বিরাজ করছে মাত্র, তুলা মাশুল কালেক্টরের কাজ দিয়ে একদা গল্প কথক বাবুটির এ স্থানে অকামন ঘটলে তাঁর বাসস্থান হিসাবে এই ভগ্নপ্রায় প্রাসাদের একটি এখানে থাকা যায়, কিন্তু রাত্রে নয়, কারণ এই ভগ্ন প্রাসাদ সম্পর্কে এই স্থানের মানুষের মনে ভয়ংকর সব ফুর্তি ও কাহিনি দানা বেঁধে আছে। কিন্তু কথক সে সবকথার প্রতি কোনো কর্ণপাত না করে এবার মাসে সারাদিনের কর্মশেষে সন্ধতায় সেই প্রাসাদের নির্দিষ্ট কক্ষে এসে পরম নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতেন। কিন্তু সপ্তাহ কাল না কাটতেই কথক ক্রমেই প্রাসাদটির প্রতি মোহবিষ্ট হয় পড়লেন।


প্রথম অভিজ্ঞতার কথা তিনি ব্যক্ত করলেন এভাবে সারাদিনের পর কর্মশেষে অপরাহ্নের আভায় বিশ্রামের অছিলায় শুস্তা নদীর তীরে শান বাঁধানো ঘাটে এসে বসেছেন—কখন সূর্য ডুবে গেছে পশ্চিমকাশে খেয়াল নেই, সন্ধ্যার অন্ধকার নিবিড় ভাবে ঘনিয়ে আসতেই তিনি শুনতে পেলেন অভূতপূর্ব সেই শব্দ—“এই সন্ধ্যাকালে নিস্তব্ধ গিরিতটে নদীতীরে নির্জন প্রাসাদে কোথাও কিছুমাত্র শব্দ ছিল না। তথাপি আমি যেন স্পষ্টই শুনিতে পাইলাম নির্ঝরের শতধারার মতো সকৌতুক কলহাস্যের সহিত পরস্পরের দ্রুত অনুধাবন করিয়রা আমার পার্শ্ব দিয়া স্নানাথিনীরা চালিয়া গেল। আমাকে যেন লক্ষ্য করিল না। তাহারা যেমন আমার নিকট অদৃশ্য, আমিও যেন সেই রূপ তাহাদের নিকট অদৃশ্য।”


পরদিন প্রাতঃকালে বিষয়টি অনুধাবন করতে গিয়ে কথক বুঝলেন বড়োই হাস্যকর, কাউকে বললে বিশ্বাস ও করবেন না। কাজেই বিষয়টি কাউকে না বলে অপেক্ষায় রইলেন পরবর্তী রাত্রির জন্য এই রাত্রিতে তিনি যেন ঘরের মধ্যে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলেন—“ঝর্ঝর শব্দে ফোয়ারার জল সাদা পাথরের ওপরে আসিয়া পড়িতেছে, সেতারে কি সুর বাজিতেছে বুঝিতে পারিতেছে না, কোথাও স্বর্ণভূষণের শিঞ্জিত, কোথাও নূপুরের নিক্কন, কখনও বা বৃহৎ তাম্র ঘণ্টায় প্রপর বাজিবার শব্দ, অতিদূরে নহবতের আলাপ, বাতাসে দোদুল্যমান ঝড়ের সঠিক দোলকগুলির ঠুন ঠুন ধ্বনি, বারান্দ হইতে খাঁচার বুলবুলের গান, বাগান হইতে পোষা সাবসের ডাক আমার চতুর্দিকে একটা প্রেতলোকের বাগিনী সৃষ্টি করতে লাগিল।” এই রাত্রিতেই তিনি ঘুমের ঘোরে প্রত্যক্ষ করেন—কে যেন তাঁকে ডেকে নিয়ে দীর্ঘ পর্দা ঝোলানোর ঘরের সম্মুখে এনে দাঁড় করেছেন, তখন যেন ঘরের মধ্যে বসেছিল গজলের জলসা। “আমি যেন অন্ধকার নিশীথে সুপ্তিমগ্ন বোগাদাদের নির্বাপিত দীপ সংকীর্ণ পথে কোন এক সংকট সঙ্কুল অভিসারে যাত্রা করিয়াছে।” আরও আরও অনেক টুকরো টুকরো শিহরণ জাগানো ভৌতিক আবেশের মধ্যে দিয়ে সে রাত্রির স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল।


দ্বিতীয় রাত্রিতে স্বপ্নের মধ্য দিয়ে ঘুমের ঘোরে তিনি শুনতে পেলন কোনো এক যৌবনবতী রমণী কেঁদে কেঁদে তাকে বলছে—“তুমি আমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া যাও—কঠিন মায়া, গভীর নিদ্রা, নিষ্ফল স্বপ্নের সমস্ত দ্বার ভাঙিয়া ফেলিয়া, তুমি আমাকে ঘোড়ায় তুলিয়া, তোমার বুকের কাছে চাপিয়া ধরিয়া, বনের ভিতর দিয়া, পাহাড়ের ওপর দিয়ে, নদী পার হইয়া তোমাদের সূর্যালোকিত ঘরের মধ্যে আমাকে লইয়া যাও। আমাকে উদ্ধার করো।” তৃতীয় রাত্রিতে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন—” একজন রমণী পালঙ্কের তলদেশে গালিচার ওপরে উপুড় হইয়া পড়িয়া দুই দৃঢ় বদ্ধ মুষ্টিতে আপনার আলুলায়িত কেশজাল টানিয়া ছিঁড়িতেই তাহার গৌরবর্ণ ললাট দিয়া রক্ত ফাটিয়া পড়িতেছে, কখনও সেও শুষ্ক তীব্র অট্টহাস্যে হাহা করিয়া উঠিতেছে, কখনও ফুলিয়া ফুলিয়া ফাটিয়া কাঁদিতেছে, দুই হস্তে বক্ষের কাঁচুলি ছিড়িয়া ফেলিয়া অনাবৃত বক্ষে আঘাত করিতেছে....।" যখন ক্রমশ এই অপ্রাকৃত স্বপ্নের কাহিনি জমতে ঠিক সেই সময় পাগলা মেহেবালির তীব্র কণ্ঠস্বর—'তফাৎ যাও, তফাৎ যাও। সব বুটি হ্যায়, সব ঝুট হ্যায় । শুনে তার ঘুম ভেঙে যায়। কাহিনির যবনিকা পতন হয়।


পরদিন অপিসে ফিরে কথক কবি ফাঁকে ডেকে স্বপ্নের রহস্য আর মেহেবালির কথার অর্থ কি জমতে চাইলে করিম খাঁ জানায়—“একসময় ওই প্রসাদে অনেক অতৃপ্ত বাসনা, অনেক উন্মত্ত সম্ভোগের শিখা আলোকিত হইত....সজীব মানুষ পাইলে তাহাকে লালায়িত পিশাচীর মতো হইয়া ফেলিতে চায়। যাহারা ত্রিরাত্রি ওই প্রাসাদে বাস করিসারে, তাহাদের মধ্যে কেবল মেহের আলি পাগল হইয়া বাহির হইয়া আসিয়াছে। এ পর্যন্ত আর কেহ তাহার গ্রাম এড়াইতে পারে নাই।” করিম খাঁ এবক্তব্য থেকে স্পষ্ট শা-মামুদের ভগ্ন রাজপ্রাসাদটি কেবল ক্ষুধিত পাষাণের ন্যায় বিরাজ করছে। যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে অতিপ্রাকৃত তথা ভৌতিক চিত্র।