বাংলা নাট্যসাহিত্যে রামনারায়ণ তর্করত্ন (১৮২২ খ্রীঃ–১৮৮৬ খ্ৰীঃ)

বাংলা নাটকে রামনারায়ণ তর্করত্ন


যাত্রাপালা ও পাঁচালী গানের রুচি-বিকৃতি ঘটিয়ে জনমন তৃপ্তির জন্য নানামুখী নাট্যসম্ভারে নাট্যশালাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। কখনও সংস্কৃত নাটক অনুবাদ করে, কখনও সমাজসমস্যামূলক নাটক লিখে অথবা প্রহসন রচনা করে এই ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কলকাতা ও শহরতলী অঞ্চলে ‘নাটুকে বিজ্ঞাপন' অনুযায়ী নাটক লিখে পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। রাজা-জমিদার-ধনী ব্যক্তিদের বরাত দেওয়া অভিজাত নাট্যমঞ্চ থেকে সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহস্থের বাড়ি পর্যন্ত তার নাটক অভিনীত হয়েছে। বিদ্যোৎসাহিনী-বেলগাছিয়া-জোড়াসাঁকো-পাথুরিয়াঘাটা—এই চারটি রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছেন সংস্কৃত নাটক অনুবাদের বা মৌলিক নাটক রচনার সূত্রে। পুরস্কৃত নাটক লিখে তাঁর খ্যাতি অর্জনের সংবাদের কথা জানা যায়, যেমন বাংলাদেশের এক নাট্যোৎসাহী জমিদার কালীচন্দ্র চৌধুরী ‘সম্বাদভাস্কর’ ও ‘রঙ্গপুর বার্তাবহে’ বিজ্ঞাপন (৮ নভেম্বর, ১৮৫৩) দেন যে “সুললিত গৌড়ীয় ভাষায় ছয় মাসের মধ্যে ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নামক একখানি মনোহর নাটক রচনা করিয়া রচকগণ মধ্যে সর্ব্বোৎকৃষ্টতা দর্শাইতে পারিবেন তাঁহাকে সংকলিত ৫০ (পঞ্চাশ) টাকা পারিতোষিক প্রদান করা যাইবেক” (উদ্ধৃতঃ পুলিন দাস “বঙ্গ রঙ্গমঞ্চ ও বাংলা নাটক”, পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫)।


রামনারায়ণ চার মাসের (১০. ৩. ১৯৫৪) মধ্যে নাটক লিখে সেই পুরস্কার অর্জন করেন। এর পূর্বেও তিনি পতিব্রতার উপাখ্যান রচনার জন্য এই রঙ্গপুরের জমিদারের কাছেই পুরস্কৃত হয়েছিলেন। আবার জোড়াসাঁকো থিয়েটারের সংযত মঞ্চ রুচি ও আদর্শের উপযোগী করে বহুবিবাহ বিরোধী নাটক লিখে তিনি একটি দামী শাল ও ৫০০ টাকা সাম্মানিক মূল্য লাভ করেন। এই সব পুরস্কৃত নাটকরচনা ও অভিনয়ের মাধ্যমে রামনারায়ণের নাট্যখ্যাতি বিস্তৃত হয়। বিভিন্ন মৌখিক রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে মঞ্চ-প্রকৃতি সম্পর্কে রামনারায়ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। একথা সত্য, মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাটক লেখার পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন সব চাইতে মঞ্চসফল নাট্যকার। তাঁর অনূদিত নাটক ‘রত্নাবলী’র প্রতিক্রিয়ায় সাহেব মধুসূদন যে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের উপযোগী নাটক লেখার কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন, এ সত্য বিস্মৃত হবার নয়।


রামনারায়ণ তর্করত্নের জন্ম ও কর্মজীবন:

১৭৪৫ শকাব্দে (১৮২২ খ্রীঃ ২৬ ডিসেম্বর) চব্বিশ পরগনার অন্তর্ভুক্ত হরিনাভি গ্রামে রামনারায়ণের জন্ম। পিতা, রামধন শিরোমণি। রামনারায়ণের প্রাথমিক শিক্ষা হয়েছিল চতুষ্পাঠীতে, পরে সংস্কৃত কলেজে। একসময়ে এখানে শিক্ষকতাও শুরু করেন। বাংলা রঙ্গমঞ্চ সম্পর্কে তার সচেতনতা প্রথমাবধি ছিল না। তবে সামাজিক প্রথা সম্পর্কে তিনি যে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন তা বোঝা যায় ‘পতিব্রতোপাখ্যান’ নামে গদ্যরচনার মধ্যে। এই রচনার জন্য তিনি রঙ্গপুরের জমিদারের কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করেন। তারপরেই লেখেন কৌলীন্য প্রথাকে কেন্দ্র করে নাটক। ব্যক্তিগত জীবনে অধ্যাপক তথা পুরুষানুক্রমে সংস্কৃত-নির্ভর রক্ষণশীল ধ্যান-ধারণার প্রতি অনুগত হয়েও রামনারায়ণ যেভাবে কৌলীন্যপ্রথার কুৎসিৎ পরিচয়টি উদ্ঘাটিত করেছেন তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। এই নাটক রচনায় তার সামাজিক দায়িত্ববোধের প্রকাশ ঘটেছে। আবার রামনারায়ণের রচিত কিছু পৌরাণিক নাটক এবং প্রহসনও আছে। তাঁর সৃষ্ট নাটকগুলিকে সামাজিক, অনুবাদ নাটক, পৌরাণিক এবং প্রহসন এই চারভাগে বিন্যস্ত করা যায়.


রামনারায়ণ তর্করত্নের রচনাসমূহ:

রামনারায়ণ তর্করত্নের গদ্যরচনা : ‘পতিব্রতোপাখ্যান' (১৮৫৩)।

রামনারায়ণ তর্করত্নের নাটক রচনা : (ক) সামাজিক নাটক: 'কুলীনকুলসর্বস্ব' (১৮৫৪), ‘নবনাটক’ (১৮৬৫)। (খ) অনুবাদ-নাটক : ‘বেণীসংহার' (১৮৫৬), ‘মালতীমাধব’ (১৮৫৭), ‘রত্নাবলী’ (১৮৫৮), ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্' (১৮৬০)। (গ) পৌরাণিক নাটক : ‘রুক্মিণীহরণ’ (১৮৭২), 'কংস বধ' (১৮৭৫), ‘ধর্মবিজয়’. (১৮৭৫) । (ঘ) প্রহসন : ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’, মুস্তফি সাহেব-কা পাকা তামাসা’, ‘পরীস্থান’, ‘বাজার কুঘটন’, ‘চক্ষুদান’, ‘উভয়-সঙ্কট’।


রামনারায়ণের ‘কুলীনকুলসর্বস্ব' (এ বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে টীকা-অংশে) নাটকটির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কৌলীন্যপ্রথার কুফল প্রদর্শন। এই উদ্দেশ্যে নাটকটির কাহিনী ছয় ভাগে ছয় অঙ্কে বিন্যস্ত করা হয়। প্রথমে আছে কুলপালক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যাদের বিবাহ অনুষ্ঠান, দ্বিতীয় অংশে ঘটকের কপট ব্যবহার স্বরূপ উদঘাটন নানা রহস্যজনক প্রস্তাব উত্থাপন, তৃতীয় অশে কুলকামিনীগণের আচার-ব্যবহারের পরিচয়দান, চতুর্থ অংশে আছে শুক্রব্যবসায়ীর দোষোদ্ঘাটন, পঞ্চম অংশে নানা রহস্য ও বিরহী পঞ্চাননের বিয়োগ জ্ঞাপন, ষষ্ঠ অংশে আছে বিবাহ-নির্বাহ। এইসব ঘটনাসমূহের মাধ্যমে কুলের সম্মান রক্ষার জন্য কুলপালকের চার কন্যার জীবনবঞ্চনার তথা ব্যর্থতার রূঢ় বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই নাটকটি প্রথমে (১৮৫৭ খ্রীস্টাব্দের মার্চের প্রথম সপ্তাহে) রামজয় বসাকের বাড়িতে অভিনীত হয়। প্রসিদ্ধ গায়ক রূপচঁাদ পক্ষী এ নাটকে গান সংযোজন করেছিলেন। এই নাটকটি পরে গদাধর শেঠের পারিবারিক মঞ্চে (১৮৫৮ খ্রীঃ) এবং চুঁচুড়ার নরোত্তম পালের অনুরূপ মঞ্চে (১৮৫৮ খ্রীঃ) অভিনীত হয়।


বহুবিবাহের দোষ দেখিয়ে পরবর্তী ‘নবনাটক’ লেখা হয়। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরামর্শে গণেন্দ্রনাথ ও গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জোড়াসাঁকো নাট্যশালা'র জন্য এই মর্মে বিজ্ঞাপন দেন : “বহু বিবাহের অনিষ্টকারিতা দেখাইয়া যিনি উৎকৃষ্ট নাটক লিখিতে পারিবেন, তাহাকে পাঁচশত টাকা পুরস্কার দেওয়া হইবে।” রামনারায়ণ তর্করত্ন অল্প দিনের মধ্যে 'নবনাটক' লিখে জোড়াসাঁকো থেকে এই পুরস্কার লাভ করেন।


এই নাটকের কাহিনীটি এইরকম : পরেশবাবু নামক জনৈক জমিদার স্ত্রী ও পুত্র থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয়বার প্রৌঢ় বয়সে বিবাহ করেন। তার নববিবাহিতা স্ত্রীর মন্ত্রণায় প্রথম পক্ষের পত্নীর পুত্র সুবোধ দেশত্যাগী হয়ে মৃত্যুবরণ করে। প্রথমা পত্নী সাবিত্রী দুঃখে আত্মহত্যা করেন। তারপর নবীনা স্ত্রীর প্রদত্ত বশীকরণ ঔষধ খেয়ে পরেশবাবু রোগগ্রস্ত হয়ে মারা যান। রামনারায়ণের আত্মকথার সাক্ষ্যে জানা যায় এই নাটকটি জোড়াসাঁকো মঞ্চে উপর্যুপরি ন’বার অভিনীত হয়। প্রথম অভিনয় হয় ১৮৬৭ খ্রীস্টাব্দের ৫ই জানুয়ারী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতিতে’ও এই নাটক অভিনয়ের উল্লেখ আছে।


“পণ্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্ন লিখলেন বহুবিবাহ বিরোধী নাটক। একখানা দামী শাল ও পাঁচশো টাকা পুরস্কার পেলেন। নাটকের নাম হল নব নাটক”


রামনারায়ণের রচিত অনুবাদ ও পৌরাণিক নাটকগুলি ছিল সংস্কৃত সাহিত্য ও পুরাণের প্রতিফলন বা পুনরাবৃত্তি। স্বভাবতই মৌলিকতার প্রকাশ এখানে ছিল নামমাত্র। তাঁর রচিত প্রহসনগুলির প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য ছিল সমাজশোধন। তবে এইগুলির অভিনয় বিবরণ ইতিহাস অস্পষ্ট। একথা সত্য, প্রথম পর্যায়ের নাট্যকাররূপে নাট্যকাহিনী বয়নে সংহতির অভাব, আঙ্গিক-শৈথিল্য, যাত্রাধর্মী বিবৃতিময় সংলাপ প্রভৃতি ত্রুটি রামনারায়ণের নাটকে দেখা যায়। তবু প্রথম সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে ‘সাহিত্যিক’ প্রতিবাদ প্রকাশে তার মধ্যে সংস্কারমুক্ত সমাজসচেতন মনোভাবের পরিচয় পাওয়া গেছে। আর এই কারণে বাংলা নাটকে তিনি আজও স্মরণীয় ব্যক্তি।